Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইমাম বুখারীর (রহ:) অনবদ্য সংকলন সহীহ বুখারী শরীফের বৈশিষ্ট্য

মাওলানা মুহাম্মদ মুনিরুল হাছান | প্রকাশের সময় : ২৪ জুন, ২০২১, ১২:০২ এএম

হাদীস অর্থ কথা, বাণী, সংবাদ ইত্যাদি। পরিভাষায় রাসূলে পাক (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কথাবার্তা, কাজকর্ম, অনুমোদন, মৌন সম্মতিকেই হাদীস বলা হয়। ব্যাপক অর্থে বলা যায়, রাসূলে পাক (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সাথে সম্পর্কিত যে কোন কথা, কাজ, মৌন সম্মতি, তার গুণাগুণ ও অবস্থার বিবরণ, এমনকি তার সজাগ কিংবা নিদ্রাকালের প্রতিটি নড়াচড়া ও স্থিরতা ইত্যাদির বর্ণনাকেই হাদীস বলা হয়। হাদীস হলো ইসলামী শরীয়তের দ্বিতীয় উৎস। হাদীসও একপ্রকার ওহী। কেননা নবীজী (সাঃ) নিজে কোনো কথা বলতেন না। যা বলতেন ওহীর আলোকেই বলতেন। কুরআন বুঝার জন্য হাদীসের উপর নির্ভর করতে হয়। আর ঐ হাদীসকে যাচাই-বাছাই করে বিশুদ্ধ পন্থায় গ্রন্থাকারে সংকলনের পথিকৃৎ হলেন ইমাম বুখারী (রহঃ)। সমগ্র মুসলিম বিশ্বে পবিত্র কুরআনের পর সবচাইতে বিশুদ্ধ হাদীসগ্রন্থ হলো তারই সংকলিত হাদীসগ্রন্থ। যার পুরো নাম হলো “আল জামি আস সহীহু আল-মুসনাদু আল মুখতাসারু মিন উমুরি রাসূলিল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ওয়া সুনানহী ওয়া আইয়্যামিহী”।

বাল্যকাল ঃ তার আসল নাম মুহাম্মদ। উপনাম আবু আবদুল্লাহ। তার উপাধি ছিল “আমিরুল মুমেনিন ফিল হাদীস”। পিতার নাম হলো ইসমাঈল। তার মা ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক ও তাকওয়াবান। তিনি ১৯৪ হিজরীর ১৩ শাওয়াল জুমুআর সালাতের পর বর্তমান উজবেকিস্থানের বুখারা নগরীতে জন্মগ্রহন করেন। তিনি মাত্র ছয় বছর বয়সে পবিত্র কুরআন হিফজ করেন। দশ বছর বয়সে হাদীস শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হন। ২১০ হিজরীতে ষোল বছর বয়সে মা ও বড় ভাইকে সাথে নিয়ে পবিত্র হজ পালনের জন্য মক্কায় গমন করেন। হজ পালন শেষে তার মা ও ভাই দেশে ফিরে আসলেও ইলমে হাদীস অর্জনের জন্য তিনি সেখানে থেকে যান। অতঃপর তিনি পবিত্র মদিনাতুল মুনওয়ারায় গিয়ে আঠারো বছর বয়সে পবিত্র রওজায়ে পাকের পাশে বসে “কাজায়াস সাহাবা ওয়াত তাবেয়ীন ও আততারীখুল কবির” গ্রন্থ দুটি রচনা করেন।

সহীহ বুখারী সংকলনের পটভূমি ঃ একদা তিনি স্বীয় শায়খ ইসহাক ইবনে রাহবিয়ার (রহঃ) মজলিসে ছিলেন। এতে শায়খ ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেন, “যদি আল্লাহ তায়ালা কোনো বান্দাকে এই তাওফিক দিতেন যে, তিনি এমন একটা হাদীসগ্রন্থ সংকলন করতেন। যা সংক্ষিপ্ত এবং মর্যাদার দিক থেকে উন্নত। সাথে সাথে আমলকারীরাও যা থেকে নিঃসন্দেহে আমল করতে পারত”। কথাটি ইমাম বুখারীর মনে রেখাপাত করে। তাই তিনি নিজেই এই দায়িত্ব পালনে মনস্থির করেন।

এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানী (রহঃ) বলেন, “অধিকাংশ হাদীস বিশারদগন যখন সনদ আকারে হাদীস সংকলন করতেন, তাদের মধ্যে যারা অধ্যায় ও সনদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে হাদীস লিপিবদ্ধ করতেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, আবু বকর ইবনে আবু শায়বা (রহঃ)। ইমাম বুখারী (রহঃ) যখন উক্ত সংকলনগুলোর বর্ণনা ধারা, লিখন ও বিন্যাস পদ্ধতি অবলোকন করেন, তখন তিনি দেখতে পান ঐ সমস্ত কিতাবে সহীহ ও হাসান হাদীসকে একই স্তরে বিন্যাস করা হয়েছে। পাশাপাশি অসংখ্য যঈপ বা দূর্বল হাদীসও সেখানে বিদ্যমান রয়েছে। তখন ইমাম বুখারী (রহঃ) এর মনে দৃঢ়তার সাথে সাড়া দিল যে, এমন হাদীস গ্রন্থকে মহামূল্যবান বলা যাবেনা। ফলে তিনি সহীহ হাদীস সংকলনে আতœনিয়োগের জন্য সুদৃঢ় পরিকল্পনা করেন। [ইবনে হাজর আসকালানী, হুদাস-সারী:পৃঃ ৭]

স্বপ্নযোগে ইশারা ঃ বাল্যকাল থেকে ইমাম বুখারী চরিত্রে তাকওয়া, পরহেজগারী, বিশ্বস্থতা ইত্যাদি গুণাবলী ভেসে উঠেছিল। শরীয়তের পূর্ণাঙ্গ অনুসারী ছিলেন। প্রিয় নবীজীর প্রতি অত্যাধিক ভালোবাসা পোষণ করতেন। ফলে বেশ কয়েকবার প্রিয় নবীজীকে স্বপ্নে দেখার সুযোগ হয়েছিল। তিনি বলেন, “আমি একদা প্রিয় নবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্বপ্নে দেখি যে, আমি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার হাতে পাখা ছিল যা দিয়ে তাকে বাতাস করছিলাম”। স্বপ্নের ব্যাখ্যাকারককে জিজ্ঞাসা করলে তারা এর ব্যাখ্যায় বলেন, নবীজীর দিকে সম্পর্কিত অসত্য কথাগুলো থেকে তুমি শুদ্ধ কথাগুলো বের করে আনবে। তখন থেকেই আমার মনে এ ধরনের গ্রন্থের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। যার জন্য আমি আমার জীবনের ষোলটি বছর অতিবাহিত করেছি। বিশিষ্ট মোহাদ্দিস নজম ইবনে ফুযাইল (রহঃ) বলেন, “একদা আমি রাসূলে পাক (সাঃ) কে স্বপ্নে দেখলাম যে, তিনি রওজা মোবারক থেকে বের হয়ে আসছেন আর ইমাম বুখারী তার পেছনে পেছনে হাঁটছেন। নবীজী যে স্থানে পা মোবারক রাখেন তার পা তোলার পর ইমাম বুখারী ঠিক সে স্থানেই পা রেখে হাঁটছেন”। [খতিব বাগদাদী, তারীখু বাগদাদ, খন্ড-২য়: পৃঃ- ১০]

মনীষীদের মূল্যায়ন ঃ ইমাম বুখারী মুসলিম বিশ্বে এতই মর্যাদাবান যে, তার সহপাঠীরাতো বটেই তার সম্মানিত উস্তাদগণও তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। ইবনে আল মুরজী (মৃত্যু - ২৪৯/৮৬৩ খ্রিঃ) বলেন, “তিনি হচ্ছেন মহান আল্লাহর নিদর্শনাবলীর মধ্যে অন্যতম, যা ধরণীর বুকেবিচরণ করছে।[ইবনে কাসির, আল বিদায়াওয়ান নিহায়া, পৃঃ ৪৮২]

মুহাম্মদ ইবনে বাশশার (মৃত্যু ২৫২ হিঃ/ ৮৬৬ খ্রিঃ) বলেন, “সারাবিশ্বে হাফিজুল হাদীস হলেন চারজন (র) রায় নগরীতে আবু যুরআহ (রর) নীশাপুরে মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ (ররর) সমরকন্দে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুর রহমান আদ-দারিমী (রা) বুখারায় মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইল আল বুখারী। [খতিব বাগদাদী, তারীখু বাগদাদ - ২য় খন্ড, পৃঃ ১৬]

মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক ইবনে খুযাইমা (রহঃ) মৃত (২২৩হিঃ/ ৮৩৭খ্রিঃ) বলেন, “আকাশের নীচে ইমাম বুখারী অপেক্ষা হাদীস শাস্ত্রে সর্বাধিক জ্ঞানী ও অধিক সংরক্ষণকারী আমি আর কাউকে দেখিনি। [ইবনে হাজর, তাজকিরাতুল হুফফাজ, খন্ড-২, পৃঃ-৫৫৬]

প্রিয় নবী (সাঃ) এর দরবারে গ্রহণযোগ্যতা ঃ রাসূলে পাক (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এটিকে নিজের কিতাব বলেছেন, হযরত আবু যায়দ মরওয়াজী (রঃ) বলেন, আমি একদা পবিত্র কাবা ঘরের হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইবরাহীমের মাঝে শায়িত ছিলাম। তখন স্বপ্নে দেখতে পেলাম প্রিয় নবী (সাঃ) আমার সামনে উপস্থিত। তিনি আমাকে সম্বোধন করে বললেন, হে আবু যায়দ! তুমি আর কতকাল ধরে ইমাম শাফেয়ী এর কিতাব পড়তে থাকবে? তুমি আমার কিতাব শিক্ষা শুরু কর। আমি সবিনয়ে আরজ করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আপনার কিতাব কোনটি? তিনি জবাব দিলেন, মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইল বুখারী (রহঃ) এর সংকলনটিই হলো আমার কিতাব। ইবনে হাজার, হুদাস সারী- পৃঃ ৬৭৬]

সহীহ বুখারীর বৈশিষ্ট্য ঃ ইমাম বুখারী অনেক যাচাই-বাছাই করে লক্ষ লক্ষ হাদীস থেকে গবেষণা চালিয়ে এই বিশুদ্ধ গ্রন্থটি সংকলন করেন। তিনি বলেন, “আমি ছয় লক্ষ হাদীস যাচাই-বাছাই করে সুদীর্ঘ ষোলো বছরে এ সহীহ গ্রন্থটি সংকলন করেছি এবং এ গ্রন্থটিকে আমার ও আল্লাহ তায়ালার মাঝে নাজাতের উসীলারূপে স্থাপন করেছি। [ইবনে হাজার, হুদাস সারী - পৃঃ ৬৭৫]

এ প্রসঙ্গে মুহাম্মদ ইবনে হামদুবিয়া (রহঃ) বলেন, আমি ইমাম বুখারীকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমি এক লক্ষ সহীহ ও দুই লক্ষ গাইরে সহীহ হাদীস মুখস্থ করেছি। ইবনে হাজার, পূর্বোক্ত- পৃঃ ৬৭৪]

এছাড়া ইমাম বুখারী (রহঃ) এর নিকট আরও তিন লক্ষ সহীহ হাদীস বিদ্যমান ছিল। মোট ছয় লক্ষ হাদীস তার আয়ত্বাধীন ছিল। [ডঃ সুবহী সালিহ, উলুমুল হাদীস ওয়া মুসতালাহুহু- পৃঃ ৩৯৬]

পৃথিবীর সকল মোহাদ্দিসগণ একমত যে, ইমাম বুখারী (রহঃ) সংকলিত ‘সহীহুল বুখারী’তে সহীহ হাদীস ব্যতিত অন্য কোন হাদীস স্থান দেননি। এ প্রসঙ্গে ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, সহীহ হাদীস সম্মলিত নিখুঁত ও একনিষ্ঠভাবে প্রথম জামে গ্রন্থ রচনা করেন ইমাম বুখারী।

ইমাম বুখারী আরো বলেন, “আমি এ গ্রন্থে সহীহ হাদীস ব্যতীত একটি হাদীসও সংযোজন করিনি। আর গ্রন্থের পরিধি বেড়ে যাওয়ার কারণে অনেক সহীহ হাদীস লিপিবদ্ধ না করে ছেড়ে দিয়েছি। অর্থ্যাৎ, এ গ্রন্থের বাইরেও অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে। [বদরুদ্দীন আইনী, উমদাতুল কারী, খন্ড - ১ম, পৃঃ - ১০]
ইন্তেকাল ঃ ইলমে হাদীস জগতের উজ্জ¦ল এই নক্ষত্র এক শাওয়াল ২৫৬ হিজরীতে ঈদুল ফিতর এর রাতে এশার নামাযের পর সমরকন্দে ইন্তেকাল করেন। ঈদের দিন যোহরের সালাতের পর তাকে দাফন করা হয়। দাফনের পর তার কবর থেকে মিশক আম্বরের ন্যায় সুগন্ধি বের হতে থাকে এবং কবর বরাবর আকাশে লম্বাকৃতি একটি সাদা রেখা দেখা দিলে মানুষ তা বিস্ময়করভাবে প্রত্যক্ষ করে।
লেখক :শিক্ষাবিদ, ইসলামী গবেষক।

 



 

Show all comments
  • রানা ২৫ আগস্ট, ২০২১, ৪:৫৮ পিএম says : 0
    বুখারির টিকা কয়টি ও কি কি
    Total Reply(0) Reply
  • Kazi robayed ahmed ২৯ জানুয়ারি, ২০২২, ৯:১৩ এএম says : 0
    সহীহ বুখারীর শরীফের বৈশিষ্ট্য অতঃপর ৬ টি বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থের বুখারী, বুখারী শরীফের মর্যাদাগত অবস্থান লিখ
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ