হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
কামরুল হাসান দর্পণ
মানুষের নীতি-নৈতিকতা, মানবিকতা, দয়া, মায়ার মতো মানবীয় গুণাবলী হ্রাস পাওয়ার বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত হয়ে আসছে। এর প্রতিকারে সমাজবিজ্ঞানীরা অনবরত পরামর্শ দিচ্ছেন। সভা, সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক, মানববন্ধনসহ নানা সচেতনতামূলক কর্মসূচিও পালিত হচ্ছে। আলোচকদের কথায় অনেক মূল্যবান পরামর্শ উঠে আসছে। সেগুলো পত্র-পত্রিকায়ও ছাপা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব পরামর্শ মানুষ কতটা আমলে নিচ্ছে এবং সচেতন হচ্ছে? বড় বড় দুর্ঘটনা এবং মর্মান্তিক ঘটনাগুলো মানুষের মনে কতটা দাগ কাটছে? কিছু কিছু অমানবিক ও অনৈতিক ঘটনার ব্যাপক বিস্তার দেখে মনে হয় না, মানুষের টনক নড়ছে। মোবাইলের যুগে এসে সেলফি সংস্কৃতির কথা যদি ধরা হয়, তবে দেখা যাবে, মানুষের মধ্যে এটি এতটাই সংক্রমিত হয়েছে যে, মোবাইল হাতে থাকলেই যেন সেলফি তুলতে হাত নিশপিশ করে। ঘটাঘট সেলফি তোলাও হয়ে যায়। মুহূর্তে ফেসবুকেও আপলোড করা হয়। শ্রেণি নির্বিশেষে প্রায় সকলকেই যেন সেলফি মেনিয়ায় পেয়ে বসেছে। হ্যাঁ, প্রযুক্তিকে অস্বীকারের উপায় নেই। আবিষ্কার মানুষের প্রয়োজনকে উসকে দেয়। এই প্রয়োজনীয়তা এতটাই তীব্র করে তোলে যে, এ ছাড়া একটি দিন অতিক্রম করা অনেকে কল্পনাই করতে পারে না। মোবাইল তেমন একটি প্রযুক্তি। যারা মোবাইল ব্যবহার করেন, হাতের কাছে তা না থাকলে মনে করেন শরীরের একটি অঙ্গ যেন নেই। মোবাইল ছাড়া অচল হয়ে পড়েন। আবার মোবাইলে যারা ফেসবুক ব্যবহার করেন, তারা ফেসবুক ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারেন না। এ এক ভয়ংকর নেশা। প্রযুক্তির এ আবিষ্কার একদিকে যেমন মানুষের কল্যাণ বয়ে এনেছে, তেমনি ভয়াবহ ক্ষতিও ডেকে আনছে। ফেসবুকের মাধ্যমে অপপ্রচার, তরুণ-তরুণী পরিচয়, বিবাহিত পুরুষ-মহিলার অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি এখন অনেকটা সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এর ফলে অনেক তরুণ-তরুণীর মধ্যে প্রণয় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এবং তা বিয়ে পর্যন্ত গড়িয়েছে। অনেক সময়, তরুণ কর্তৃক তরুণী প্রতারণার শিকারও হয়েছে। তরুণ নিজের আসল পরিচয় ও অবস্থান গোপন রেখে তরুণীটিকে স্বপ্ন দেখিয়ে বিয়ে করে। বিয়ের পর তরুণী যখন দেখেছে সবই মিছে ও প্রতারণা, তখন তার মতো দুঃখী পৃথিবীতে আর কেউ হয়নি। শুধু এ ধরনের প্রতারণাপূর্ণ সম্পর্কই নয়, ফেসবুকের কারণে শহরাঞ্চলে বিয়ে বিচ্ছেদের সংখ্যাও আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে উচ্চবিত্ত পরিবারে এ হার বেশি। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাজধানীতে মাসে গড়ে তিন হাজারের মতো বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। বিচ্ছেদের মূল কারণ ফেসবুক। প্রযুক্তির এ ব্যবহার যে শুধু নেতিবাচক ফল বয়ে আনছে, তা নয়। অনেক ইতিবাচক ফলও বয়ে আনছে। যুগের পর যুগ দেখা না হওয়া মানুষকে খুঁজে পাওয়া, পুরনো সম্পর্ক নতুন করে ঝালাই করা, জনসচেতনতা সৃষ্টি, প্রতিবাদের ক্ষেত্র, ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তৃতিসহ জ্ঞান আহরণ করার মতো অসংখ্য পেজ খুঁজে পাওয়া যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রকৃতিগতভাবে আমাদের দেশের মানুষের কৌতূহল অনেক বেশি। যে কোনো বিষয়ে তাদের কৌতূহলের সীমা থাকে না। এই কৌতূহল কখনো কখনো অতি কৌতূহলে পরিণত হয় এবং তা সীমা লংঘনের পর্যায়ে চলে যায়। সেলফিতে একটা সময় কৌতূহল ছিল, এখন এটি নেশায় পরিণত হয়েছে। এ নেশা এখন অনৈতিক ও ভয়াবহ ঘটনারও জন্ম দিচ্ছে। সম্প্রতি সেলফি তোলা নিয়ে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যা অত্যন্ত দুঃখজনক। ঈদের সময় ফেসবুকে আপলোড করা দুয়েকটি ঘটনা সচেতন মানুষকে খুবই পীড়িত করেছে। একটি ঘটনায় দেখা যায়, ঈদের দিন গরু জবাই করার সঙ্গে সঙ্গে এক যুবক গরুর সামনের ও পেছনের দুই পা ধরে পেটের ওপর বসে সেলফি তুলেছে। গরুর জান তখনও বের হয়ে যায়নি। ফেসবুকে তার এই হাসিমাখা ছবির পাশের ছবিতে দেখা যায়, যুবকটি মরে পড়ে আছে। বিকালে গরুর গোশত আত্মীয়-স্বজনদের বিলি করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছে। আরেকটি ঘটনায় দেখা যায়, একদল মেয়ে গরু জবাই করা তাজা রক্তের মধ্যে পা ডুবিয়ে সেলফি তুলছে। এসব ঘটনার আগে গ্রামের বাড়িতে এক যুবক তার দাদার খোঁড়া কবরের সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে। ঘটনাগুলোকে অনেকে বিচ্ছিন্ন বলতে পারেন। তবে যারা চিন্তাশীল এবং সচেতন তারা বোঝেন, আমাদের অনেক তরুণ-তরুণী সর্বোপরি তাদের পরিবারের সদস্যরা নীতি-নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের চর্চা থেকে দূরে সরে গেছেন। তা না হলে পারিবারিক নৈতিক শিক্ষা এসব তরুণ-তরুণীর মধ্যে প্রতিফলিত হবে না কেন? সম্প্রতি কক্সবাজারে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে নামিয়ে দিয়ে যে হেলিকপ্টারটি সৈকতে বিধ্বস্ত হলো, তার কারণও এই সেলফি। হেলিকপ্টারের পাইলট নিজেই বলেছেন, নিহত হওয়া ব্যক্তি এবং তার এক সঙ্গীকে নিষেধ করা সত্ত্বেও তারা হেলিকপ্টারের দরজা খুলে সেলফি তোলা শুরু করে। এতে বাতাসের তারতম্যে হেলিকপ্টারটি ভারসাম্য হারিয়ে বিধ্বস্ত হয়। এসব ঘটনা-দুর্ঘটনাকে বিবেক-বোধহীন ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে!
দুই.
নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয়ের আরেকটি বড় চিত্র এবারের ঈদে লক্ষ করা গেছে। কোরবানির চামড়া নিয়ে ট্যানারি মালিকরা যে কারসাজি করলেন তা কোনোভাবেই নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না। আমরা প্রত্যেকেই জানি, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য কোরবানি দেয়া হয়। কোরবানির পশুর গোশত এবং এর চামড়ার মূল্যের প্রধান হকদার এতিম, অসহায় ও দরিদ্র শ্রেণি। যারা কোরবানি দেন, তারা কোরবানির চামড়া এ শ্রেণিকে দান করে থাকেন। কোরবানির চামড়া মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সংগ্রহ করে তা ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করেন। এ চামড়া কেনার ক্ষেত্রে ট্যানারি ব্যবসায়ীরা প্রতি বর্গফুট হিসেবে একটি দাম নির্ধারণ করেন। এবার দেখা গেল, তারা গরু ও ছাগলের চামড়ার প্রতি বর্গফুটের দাম এমনভাবে নির্ধারণ করেছেন যে, তাতে এতিম, অসহায় ও দরিদ্র মানুষের হক ও রিজিকে তাদের হাত পড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দরপতনের অজুহাত দেখিয়ে তারা স্মরণকালের সবচেয়ে কম দাম নির্ধারণ করেন। গরুর প্রতি বর্গফুট চামড়া ৫০ টাকা এবং ছাগলের প্রতি বর্গফুট চামড়া ২০ টাকা তারা ধার্য করে দেন। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে গরুর প্রতি বর্গফুট ফিনিশড চামড়ার মূল্য ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা, যা প্রক্রিয়াজাতকরণের ৪০ শতাংশ খরচ বাদ দিয়ে দাঁড়ায় ৯৬ টাকা। এমনকি পার্শ্ববর্তী ভারতেও প্রতি বর্গফুট চামড়ার মূল্য ৯০ টাকা। ট্যানারি মালিকদের এমন অনৈতিক মূল্য নির্ধারণের কারণে এবার এতিম ও দরিদ্র মানুষগুলো চরমভাবে বঞ্চিত হয়েছে। বলা যায়, তাদের হক মেরে দিয়েছেন শত শত কোটি টাকার মালিক ট্যানারিওয়ালারা। সাধারণত কোরবানির চামড়ার বিক্রির অর্থ দিয়ে দেশের প্রায় চল্লিশ হাজার কওমি মাদরাসার অর্ধকোটি এতিম শিক্ষার্থী ৫ থেকে ৬ মাসের খরচ জোগান দেয়া হয়। এবার তা দেড় মাসও চলবে না বলে মাদরাসা সংশ্লিষ্টরা বলেছেন। এর অর্থ হচ্ছে, ট্যানারিওয়ালারা এতিমদের চার-পাঁচ মাসের খরচের টাকা কারসাজি করে মেরে দিয়েছেন। এতিমের হকের টাকা দিয়ে তারা তাদের লালসা চরিতার্থ করেছেন। তারা ষোলআনার ওপর বত্রিশ আনা লাভ করে এতিমদের বঞ্চিত করেছেন। এমন আচরণ কি কোনো মন্যুষত্ববোধসম্পন্ন মানুষ করতে পারে? নীতি-নৈতিকতার ন্যূনতম বালাই থাকলে এ কাজ কেউ করতে পারেন না। ট্যানারি মালিকদের কিসের অভাব? তাদের তো শান-শওকতপূর্ণ জীবন। শত শত কোটি টাকার মালিক। সরকারের কাছ থেকেও ব্যাংক ঋণসহ নানা সুবিধা পেয়ে আসছেন। এতসবের পরেও এতিমের হক মেরে খেতে হবে কেন? তাদের এ ধরনের আচরণে যেমন দুঃখিত না হয়ে পারা যায় না, তেমনি বিক্ষুব্ধ না হয়েও পারা যায় না। সঙ্গত কারণেই মাদরাসা সংশ্লিষ্টরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তারা বলেছেন, অসহায়ের রিজিকে সবলের হাত পড়েছে। এটা কিছুতেই মানা যায় না। তারা চিন্তাভাবনা করছেন, আগামী মৌসুম থেকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেরাই চামড়া সংগ্রহ করবেন এবং রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেবেন। এমনকি ভবিষ্যতে একটি ট্যানারি স্থাপনের পরিকল্পনাও করছেন তারা এবং সরাসরি রপ্তানি বাজারে যাবেন। বলাবাহুল্য, ট্যানারিওয়ালাদের স্বেচ্ছাচারী ও অনৈতিক অতি মুনাফার লোভই মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে এ চিন্তাভাবনার দিকে ঠেলে দিয়েছে। ট্যানারিওয়ালাদের এই স্বেচ্ছাচারী ও অনৈতিক মুনাফালোভী প্রবণতার বিষয়টি নতুন নয়। বছরের পর বছর ধরে তারা এ কাজটি করে আসছেন। অসত্য তথ্য উপস্থাপন করে তারা ইচ্ছামতো দাম নির্ধারণ করেন, যেখানে আর কারো কিছু বলার থাকে না। এ ব্যাপারে তাদের জবাবদিহিও করতে হয় না।
তিন.
এবারের ঈদে ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তি ও দুর্ভোগ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ না হওয়ায় সড়ক ও সেতুমন্ত্রী সমালোচিত হয়েছেন। ঈদের আগে তিনি বেশ জোর দিয়ে বলেছিলেন, ঈদযাত্রা নির্বিঘœ হবে। কোথাও কোনো সমস্যা হবে না। মন্ত্রীর এ কথার পুরোটাই বিফল হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তিনি যাত্রীদের দুর্ভোগের বিষয় স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এর আগেও তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তার এই দুঃখ প্রকাশ যাত্রীদের মনে কোনো রেখাপাত করেছে কিনা, জানি না। তবে দেখেছি, তাদের দুর্ভোগ যেমন ছিল তেমনি রয়ে গেছে। এর উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে যুক্ত হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। গত সপ্তাহে প্রায় প্রত্যেকটি সংবাদপত্রে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে শিরোনামের ধরন ছিল, মহাসড়ক এখন মৃত্যুফাঁদ, মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল। ঈদের ছুটিতে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় শতাধিক মানুষ নিহত এবং অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছে। দুর্ঘটনায় এমনো ঘটনা রয়েছে যেখানে একই পরিবারের একাধিক সদস্য নিহত হয়ে পরিবারটি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানহারা মানুষের কান্নার আহাজারির চিত্র প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে। সন্তান হারিয়ে বাবা-মায়ের আহাজারি, বাবা-মা হারিয়ে ছোট্ট শিশুর কান্নার দৃশ্য সহ্য করা যায় না। যদি বলা হয়, মানুষকে এই অসহায় পরিণতির দিকে ইচ্ছা করে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, তাহলে কি খুব বেশি বলা হবে? সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণগুলো বছরের পর বছর ধরে চিহ্নিত হয়ে থাকলেও সেগুলো সমাধান না করার কারণকে কি ইচ্ছাকৃত দুর্ঘটনা ঘটানো বলা যায় না? সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বেশ কিছু কারণ অনেক আগেই শনাক্ত করে তা সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তারা যে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছেন সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেÑ ভাঙাচোরা ও ত্রুটিপূর্ণ সড়ক, ভুয়া লাইসেন্সধারী চালক, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, অতিরিক্ত গতি, ওভার টেকিং, ট্র্যাফিক আইন না মানা ও জনসচেতনতা সৃষ্টি না করা। এসব কারণ দূর করা কি খুব কঠিন কাজ? দুর্ঘটনায় মানুষ নিহত হওয়া এবং পরিবার ধ্বংস হয়ে যাওয়ার চেয়েও কি কঠিন? দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের দিকে নীতিনির্ধারকরা তাকান কিনা জানি না। তাকালে বুঝতেন, কী অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে পরিবারগুলো দিনাতিপাত করে। বেঁচে থেকেও মৃত্যু যন্ত্রণা কীভাবে তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। এর দায় তারা কারও ওপর দিতে পারে না। অথচ এর দায় সড়ক ও পরিবহন নিয়ন্ত্রণ সংর্শ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর ওপর শতভাগ পড়ে। তাদের সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ না করা এবং অবহেলার কারণেই যে সড়কগুলো মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। যে দেশে দুর্ঘটনায় কারো হাত নেই বলে কোনো কোনো মন্ত্রীর মুখে শোনা যায় এবং সরকার দায় এড়িয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকে, সে দেশের রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনায় বেঘোরে মানুষের মরা ছাড়া আর কী গতি থাকতে পারে! এখানেই সংশ্লিষ্টদের নীতি-নৈতিকতার মাত্রাটি বোঝা যায়। বছর দুয়েক আগে দক্ষিণ কোরিয়ায় সাগরে ফেরি দুর্ঘটনায় দুইশ মানুষের মৃত্যু হয়। এ দুর্ঘটনায় দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কোনো হাত বা দায় ছিল না। তারপরও তিনি দায় নিয়ে পদত্যাগ করেন। বিবেকের দংশনে দংশিত হয়ে তিনি মনে করেছেন, তিনি তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেননি। পদত্যাগ না করলেও কেউ তাকে কিছু বলত না। তারপরও তিনি তা করেছেন। জনগণের সামনে তিনি তার ন্যায়-নীতি ও মানবিকতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই এ কাজটি করেছেন। নৈতিকতার কাছে তার ক্ষমতাকে তুচ্ছ করে দিয়েছেন। আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে সাধারণ মানুষ এত বড় সেক্রিফাইস কখনো আশা করে না, চায়ও না। তারা শুধু চায়, তাদের যাতে ইচ্ছাকৃত দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রাণ হারাতে না হয়Ñ এ ব্যবস্থাটুকু নীতিনির্ধারকরা করুন। সড়ক দুর্ঘটনাকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে বিবেচনা করে, তা প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হোক। সড়ক দুর্ঘটনাকে জরুরি পরিস্থিতি হিসেবে গণ্য করা হোক। কারণ বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষ আহত-নিহত হয়, যুদ্ধেও এত মানুষ হতাহত হয় না।
চার.
বাংলাদেশের মানুষের মতো নরম মনের মানুষ পৃথিবীর খুব কম দেশে আছে। আচার-আচরণ, মায়া-মমতা, আতিথেয়তা, অপরের দুঃখে দুঃখিত হওয়ার মতো মানবিকতা কেবল বাংলাদেশের মানুষই সবচেয়ে বেশি দেখাতে পারে। নীতি-নৈতিকতার দিক থেকেও তারা অনন্য। তারপরও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এমনসব অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে চলেছে, যা এদেশের মানুষের চিরায়ত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলে না। এসব ঘটনায় এটাই প্রতীয়মান হয়, এ বৈশিষ্ট্যে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে। পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসনে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বলাবাহুল্য, রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা থাকেন, তাদের আচার-আচরণ, নীতি-নৈতিকতা, শাসনের ধরনের প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর পড়ে। সাধারণ মানুষ তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কথাবার্তা খুব সতর্কতার সাথে বলতে হয়। দুঃখের বিষয়, আমরা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে মানুষের মন ও মননে চিরায়ত বৈশিষ্ট্য অটুট রাখার মতো কথাবার্তা খুব কমই শুনতে পাই। রাজনীতি ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন-পীড়ন ও অশালীন কথাবার্তা দিয়ে আক্রমণ করার ক্ষেত্রে যত বেশি তাদের ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়, সমাজনীতি ও পরিবার নীতি, তরুণ সমাজের নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ নিয়ে তাদের খুব একটা কথা বলতে শোনা যায় না। সরকারের তরফ থেকে যদি নীতিকথা উচ্চারিত হয়, তবে তার প্রতিফলন দ্রুত ঘটে। কারণ, সরকারের প্রশাসন যন্ত্র এগুলো মানুষের মধ্যে পৌঁছে দিতে সক্ষম। সরকারের উদ্যোগে সমাজের অভিভাবক শ্রেণিকে নিয়ে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া সম্ভব। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য পরিবার ও সমাজের নীতি-নৈতিকতা সম্পর্কিত আলাদা কাউন্সিলিং ক্লাসের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পরিবারের অভিভাবকদেরও নিজের সন্তান ও অন্যান্য সদস্যের আচার-আচরণ এবং চলাফেরার প্রতি খেয়াল রাখা জরুরি। সন্তানের মানসিক গঠনের প্রথম পাঠই শুরু হয় পরিবার থেকে। সুষ্ঠু পারিবারিক বলয় থাকলে সন্তানও সুষ্ঠুভাবে গড়ে ওঠে। বলার অপেক্ষা রাখে না, অনাকাক্সিক্ষত অনেক ঘটনা ও দুর্ঘটনা কখনো কখনো ঠেকানো হয়তো সম্ভব নয়, তবে এসব ঠেকানোর মতো উদ্বুদ্ধকরণমূলক ব্যবস্থা নেয়া গেলে তা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।