Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শেয়ারবাজার উন্নয়নে জরুরি কাঠামোগত সংস্কার

সিএমজেএফ ও বিএমবিএমের বাজেট আলোচনায় বক্তারা ভবিষ্যৎ ভালো দেখছি : সালমান এফ রহমান কমিশন ব্যবসাবান্ধব নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কাজ করছে : বিএসইসি চেয়ারম্যান

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২০ জুন, ২০২১, ১২:০০ এএম

দেশের অর্থনীতিতে শেয়ারবাজারের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের অভাবে এ সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। আর সামগ্রিকভাবে বাজার উন্নয়নে কাঠামোগত সংস্কার জরুরি। কিন্তু আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটেও এখাতের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেই। ফলে শেয়ারবাজারে সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বাজেট চূড়ান্ত অনুমোদনের সময় বেশ কিছু পদক্ষেপের সুপারিশ করেছে এখাতের সংশ্লিষ্টরা। এসব পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে- পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর আরও কমানো, অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ, মার্চেন্ট ব্যাংকের কর হার কমানো, মৌলভিত্তি সম্পূর্ণ কোম্পানি তালিকাভুক্তি, বাজার ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এবং নতুন নতুন পণ্য চালু।

বাজেট নিয়ে গতকাল এক ভার্চুয়াল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিষ্টস ফোরাম (সিএমজেএফ) ও বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এসোসিয়েশন (বিএমবিএ) যৌথভাবে এই আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং বিশেষ অতিথি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিএসইসির কমিশনার ড. শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চেয়ারম্যান মো. ইউনুসুর রহমান ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম, ডিএসই ব্রোকার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি শরীফ আনোয়ার হোসেন ও এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিজ এসোসিয়েশনের সভাপতি ড. হাসান ইমাম, বিএমবিএ’র সভাপতি মো. ছায়েদুর রহমান এবং সিএমজেএফ সভাপতি হাসান ইমাম রুবেল। সিএমজেএফের সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেনের সঞ্চালনায় সমাপনী বক্তব্য রাখেন বিএমবিএ’র সিনিয়রসহ-সভাপতি শুক্লা দাস।

সালমান এফ রহমান বলেন, বর্তমান চেয়ারম্যান ও কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর শেয়ারবাজারে আস্থা ফিরেছে। লেনদেন এবং বাজারমূলধন বেড়েছে অনেকগুণ। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক ব্যাংক এইচএসবিসি বলছে, সারা বিশ্বের মধ্যে ‘বেস্ট পারফর্মিং’ শেয়ারবাজার বাংলাদেশে। গত এক বছর ধরে শেয়ারবাজারে নতুন ধরণ দেখছি। নতুন কমিশন অনেকগুলো সুন্দর পদক্ষেপ নিয়েছে। দীর্ঘদিনের সমস্যা ইক্যুইটিভিত্তিক মার্কেট থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। বন্ড আসছে, সুকুক (ইসলামী বন্ড) অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এছাড়াও করপোরেট ও পারপিচুয়াল বন্ড আসছে। সবমিলিয়ে শেয়ারবাজারের ভবিষ্যতে আরও ভালো হবে বলে মনে করছি।

তিনি বলেন, সম্প্রতি বিএসইসি ফ্লোরপ্রাইস (শেয়ার মূল্যে নিম্নসীমা) তুলে দিয়েছে। এটি ইতিবাচক। সালমান এফ রহমান বলেন, পুঁজিবাজার যেভাবে আগাচ্ছে, তাতে বাজারের ভবিষ্যত ভাল। শেয়ারবাজার ভালো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্টেকহোল্ডারদের দায়িত্ব বাড়বে। এক্ষেত্রে দেশের ঊভয় স্টক এক্সচেঞ্জের ম্যানেজমেন্টের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এছাড়া বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর শেয়ারবাজার যেভাবে পরিচালিত হয় এবং সেখানে যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা আছে, সেগুলো আমাদেরকেও চালু করতে হবে। তিনি বলেন, এ আলোচনায় চূড়ান্ত বাজেটে তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার ব্যবধান বাড়ানো, লভ্যাংশে দ্বৈত করহার প্রত্যাহার, মার্চেন্ট ব্যাংকের করহার কমানো, অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগসহ যেসব প্রস্তাব করা হয়েছে-সেগুলোর পেছনে যুক্তি আছে। বাজেট চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে কিছু পরিবর্তন আসবে।

সালমান এফ রহমান বলেন, আমাদের অর্থনীতিতে একটি বেসিক স্ট্রাকচারাল কন্ট্রাডিকশন রয়ে গেছে। যেটা হচ্ছে আমাদের ট্যাক্স টু জিডিপি রেশিও অনেক কম। সাউথ এশিয়ার মধ্যে সব থেকে কম। আমাদের ট্যাক্স টু জিডিপি পাকিস্তানের থেকেও কম। এবার এটা ১০ শতাংশের নিচে চলে এসেছে।

তিনি আরও বলেন, প্রত্যেক বাজেটেই একটা ব্যালেন্স করা হয়। একদিকে রেভিনিউ কনসিডারেশন, আর একটা দিকে অর্থনীতি ভালো করার জন্য আরও কী কী করা দরকার। এই ব্যালেন্সিংয়ের জন্যই হয়তো আপনাদের দাবি এবার এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) পূরণ করতে পারেনি। তারপরও আপনারা যে দাবি দিয়েছেন, তা যদি বাজাটে ইনকর্পোরেট করা যায় তাহলে পুঁজিবাজার আরও ভালো হবে।

বিএসইসি চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ রাখা উচিত। তিনি বলেন, এবারের বাজেট ‘মেড ইন বাংলাদেশ বাজেট’। এটি পুঁজিবাজারের জন্যেও ইতিবাচক। কমিশন ব্যবসাবান্ধব নিয়ন্ত্রকসংস্থা হিসেবে কাজ করছে। সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পুঁজিবাজারের অবদান বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে কমিশন।

ড. শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, গত ২০ বছর ধরে একই রকম শেয়ারবাজার দেখে আসছি। সেখানে বিবর্তন দরকার। এজন্য নতুন প্রোডাক্ট আনা ও কৌশল নিতে হবে। তিনি বলেন, আমাদেরকে ইক্যুইটি মার্কেটের বাহিরে গিয়ে বিবর্তন আনতে হবে। এলক্ষ্যে কমিশন কাজ করছে। আমরা এখন মিউনিসিপাল বন্ড নিয়ে কাজ করছি। এছাড়া সরকারি সিকিউরিটিজ আনার জন্য গভীরভাবে চেষ্টা করছি। আশা করছি দ্রুত এটা সম্ভব হবে। কমিশন শেয়ারবাজারে ডিজিটালাইজেশনে গুরুত্ব দিচ্ছে। এলক্ষ্যে এরমধ্যে অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তনও এসেছে। সামনে আরও পরিবর্তন আসবে। আগামী ২০ বছরের মধ্যে দেশকে উন্নত দেশে পরিণত করতে শেয়ারবাজারকে কাজে লাগাতে হবে। বিএমবিএ সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, তালিকাভুক্ত কোম্পানির পাশাপাশি অতালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার ২ দশমিক ৫০ শতাংশ কমানো হয়েছে। এর মাধ্যমে উভয় ক্ষেত্রের মধ্যে করহারের ব্যবধান ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। কিন্তু একটি তালিকাভুক্ত কোম্পানির বিভিন্ন নিয়ম কানুন মেনে চলার কারণে ব্যয় অনেক বেশি হয়। যে কারনে ভালো মুনাফা করা বৃহৎ কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্ত হতে চাইবে না। এই সমস্যা কাটিয়ে তুলতে তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার ব্যবধান ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেন তিনি। এছাড়াও চূড়ান্ত বাজেটে লভ্যাংশে দ্বৈত করহার প্রত্যাহার, অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ ও মার্চেন্ট ব্যাংককে বিশেষ করহারের বাহিরে রাখার দাবি করেন বিএমবিএ সভাপতি। মার্চেন্ট ব্যাংক বলে ডাকা হলেও এগুলো কোন ব্যাংক না। এমনকি মার্চেন্ট ব্যাংক শব্দ ব্যবহার করাও নিষেধ। এছাড়া মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর ব্যবসাও ভালো না। তারপরে ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে বিশেষ করহার দিতে হয় (বৃহৎ করদাতা ইউনটের অন্তর্ভ্ক্তু)। এই পরিস্থিতিতে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর করহার স্বাভাবিকবা ৩০ শতাংশ করার দাবি করেন তিনি।

ডিএসইর চেয়ারম্যান ইউনুসূর রহমান লিখিত বক্তব্যে বলেন, প্রতিবছরের বাজেট পুঁজিবাজারের জন্য একটি সুবিধার কথা বলা থাকে। সেটি হলো অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের সুযোগ। কিন্তু এ বছর বাজেট পাশের আগে বলা যাবে না এ সুযোগ থাকবে কি-না। তাই আগামী বছরেও চলতি বছরের ন্যয় এ সুযোগ অব্যাহত রাখার দাবি জানাই। সিএমজেএফ সভাপতি হাসান ইমাম রুবেল বলেন, সারা পৃথিবীতে অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি ভুমিকা রেখেছে পুঁজিবাজার। তাই আমাদের অর্থনীতিকে উন্নত করতে হলে শক্তিশালী পুঁজিবাজারের বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে তালিকাভুক্ত এবং অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করহারের ব্যবধান বাড়াতে হবে। পাশাপাশি সরকারি ঋণের বোঝা কমাতে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পকে বাজারে আনতে হবে। যেমন পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল এসব প্রকল্পের অর্থায়ন পুঁজিবাজার থেকে করতে হবে। এতে আগামী বাজেটে যে দুইলাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি রাখা হয়েছে। সে ঘাটতি কিছুটা হলেও পূরণ হবে। অন্যথায় ঘাটতি বাজেট মেটাতে ঋণের বোঝা আরও বাড়বে। সিএসইর চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণের দাবি জানান। এতে তালিকাভুক্ত ও তালিকার বাইরে থাকা কোম্পানির মধ্যে করের ব্যবধান বাড়বে। ভাল কোম্পানিগুলো কর সুবিধা পাওয়ার জন্য পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবে।

শরীফ আনোয়ার হোসেন বলেন, ব্রোকার হাউজের লেনদেনে বিদ্যমান অগ্রিম আয় কর নেয়া যৌক্তিক নয়। উৎসে করের হার দশমিক ০৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ০১৫ শতাংশ নির্ধারণ করার দাবি জানান তিনি। এছাড়া অগ্রিম কর বাবদ যে অতিরিক্ত উৎসে কর নেয়া হয়েছে, তা বছর শেষে সমন্বয় করা জরুরি। এএমসি অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট হাসান ইমাম বলেন, ক্যাপিটাল মার্কেটের দিকে আগে নজর দিতে হবে। মিউচুয়াল ফান্ড এবং অন্যান্য বিনিয়োগকে কাজে লাগানোর জন্য সমগোত্রীয় নতুন ফান্ড বাজারে আনতে হবে। আর এসব ফান্ডে প্রথম ৫ বছর করমুক্ত রাখতে হবে।##



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শেয়ারবাজার


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ