Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই সুন্দরবনের পাশে গড়ে উঠছে ভারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান

প্রকাশের সময় : ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এ.টি.এম. রফিক, খুলনা থেকে : শিল্পায়নে ভয়াবহ হুমকির মুখে বিশ্বের একক বৃহত্তম প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। সরকার ঘোষিত প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকায় (ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়াস-ইসিএ) ১৪৯টি শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে, অতিমাত্রায় দূষণ করে, এমন শিল্পকারখানাই ২৭টি। এমনকি সুন্দরবনের খুব কাছেই খাদ্য গুদাম নির্মাণ করেছে খোদ খাদ্য বিভাগ। আবার, ইসিএ এলাকার বাইরে চার কিলোমিটারের মধ্যে কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যু কেন্দ্র হলে তা অবশ্যই সুন্দরবনকে ক্ষতি করবে বলে মনে করছেন পরিবেশবাদী ও বিশেষজ্ঞরা। অপরদিকে, শিল্পায়ন ও দূষণ থেকে সুন্দরবন রক্ষার দাবিতে বাদাবন সপ্তাহ পালনের ঘোষণা করেছে খুলনার পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। গত সোমবারও রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউনিসেফ।
সরেজমিনে ও পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রামপাল ও এর আশপাশ এলাকায় শিল্পকারখানা করার হিড়িক পড়েছে। এতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবেই এসব স্থানে শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে জমি ভরাটের কাজ চলছে। সুন্দরবনের প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা বা ইসিএ এলাকার মধ্যে থাকা ১৪৯টি শিল্পকারখানার মধ্যে অতিমাত্রায় দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৭, অপেক্ষাকৃত কম দূষণকারী প্রতিষ্ঠান ৬৫টি, দূষণকারী প্রতিষ্ঠান ৬৬টি। অতিমাত্রায় দূষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ইসিএ এলাকাভুক্ত মংলা বন্দর শিল্প এলাকায় রয়েছে ১৮টি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হলোÑ হোলসিম সিমেন্টের তিনটি প্রতিষ্ঠান, এলপিজি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ওমেরা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড, দুবাই বাংলাদেশ সিমেন্ট মিলস লিমিটেড, লুব অয়েল বেলেন্ডিং প্লান্ট বারাকা লিমিটেড, পেট্রেডেক এলপিজি লিমিটেড, ওরিয়েন্টাল বিটুমিন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, এলপিজি প্রস্তুতকারী কোম্পানি টেলিডাটা মেরিন সলিউশন, মংলা সিমেন্ট মিলস লিমিটেড, জ্বালানি তেল পরিশোধন কোম্পানি পেট্রেমেক্স লিমিটেড, সিমেন্ট উৎপাদনকারী বসুন্ধরা গ্রæপের তিনটি প্রতিষ্ঠান, মেঘনা সিমেন্ট মিলস লিমিটেড, গ্যাস সিলিন্ডার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সুন্দরবন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স লিমিটেড এবং এসকেএস এলপিজি, মংলা অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ। ইসিএ এলাকাভুক্ত মংলা ইপিজেড এলাকায় রয়েছে ৪টি। এর মধ্যে রয়েছেÑ সিগারেট প্রস্তুতকারী কোম্পানি পেস টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজ (বিডি) লিমিটেড, টা অ্যান্ড পা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, ইলেট্রিক যন্ত্রাংশ উৎপাদনকারী কোম্পানি মেসার্স কোতোবুকি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং কৃত্রিম চুন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স ওয়াইসিএল ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। ইসিএ এলাকাভুক্ত মংলা (ইপিজেড ও মংলা বন্দর শিল্প এলাকা বাদে) এলাকায় রয়েছে পাঁচটি। এগুলো হলোÑ সানমেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেড, সুন্দরবন শিপইয়ার্ড লিমিটেড, নাভানা সিএনজি লিমিটেড, ইনডেক্স পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি লিমিটেড এবং ওরিয়ন পাওয়ার খুলনা লিমিটেড। এছাড়া সয়াবিন তেল, সুপারি প্রসেসিং প্লান্ট, মাছ প্রসেসিং প্লান্ট, রাবারজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ধরনের দূষণকারী কোম্পানি রয়েছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, ‘সুন্দরবনের পাশে যে সব ইন্ডাস্ট্রিজগুলো তৈরি করা হচ্ছে, তারা নানাভাবে সুন্দরবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এটি কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত না; কারণ বাংলাদেশ দু’টি আন্তর্জাতিক কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাধ্য সুন্দরবনকে রক্ষা করতে বাধ্য।’
সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির খুলনার আহŸায়ক এসএম শাহনেওয়াজ আলী বলেন, ‘সুন্দরবনকে নিরাপদে রেখে তারপর আমাদের শিল্পায়ন হতে পারে। দেশে তো অনেক জায়গা রয়েছে; কিন্তু সুন্দরবনের কাছে যাওয়াটা আমরা সমীচীন মনে করছি না।’
এদিকে, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী ১৯৯৯ সালে সুন্দরবনকে সরকারের পক্ষে প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা বা ইসিএ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ঘোষণা অনুযায়ী সুন্দরবন রিজার্ভ ফরেস্টের বাইরের চারদিকে ১০ কিলোমিটার এলাকাকে ইসিএ এলাকা বলা হয়। চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় থেকে ইসিএ এলাকার স্থলভাগমুখী মৌজাগুলোর তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। গেজেট অনুযায়ী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের পাঁচ জেলার ১১টি উপজেলার ৬৩টি ইউনিয়নের ২৭২টি মৌজায় ইসিএ এলাকা অবস্থিত বলে পরিবেশ অধিদপ্তরের সূত্র জানিয়েছেন। আইন অনুযায়ী, ইসিএ এলাকা ১০ কিলোমিটারের মধ্যে মাটি, পানি, বায়ু এবং শব্দ দূষণকারী শিল্প বা প্রতিষ্ঠান স্থাপন নিষিদ্ধ। এছাড়া প্রাকৃতিক বন ও গাছপালা কর্তন বা আহরণ, সব ধরনের বন্য শিকার ও বন্যপ্রাণী হত্যা, বন্যপ্রাণী ধরা, প্রাণী বা উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংস, ভূমি বা পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট বা পরিবর্তন করতে এমন কাজ এবং মাছ ও জলজ প্রাণীর ক্ষতিকারক সব ধরনের কাজ নিষিদ্ধ।
সম্প্রতি ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশনের (এনটিপিসি) সাথে যৌথ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে শ্রীলঙ্কা সরকার। শুধুমাত্র পরিবেশবিদদের উদ্বেগের কারণে এ উদ্যোগ নিয়েছে শ্রীলঙ্কা। এমনি উদাহরণ টেনে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) খুলনার সমন্বয়ক মোঃ মাহফুজুর রহমান বলেন, আর আমরা; আমাদের একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের জন্য বিপজ্জনক স্থানে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করছি। প্রকৃতিকে আঘাত করছে, নিশ্চয়ই প্রকৃতি একদিন না একদিন পাল্টা আঘাত করবে। সুন্দরবনের ক্ষতিকর কোনো সিদ্ধান্ত নিলে কার্যত আমাদেরই অপূরণীয় ক্ষতি হবে।
বাদাবন সপ্তাহ পালনের ঘোষণা : সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকাগুলোতে একের পর এক গড়ে উঠছে শিল্প-কারখানা। প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার পাশেই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়াও ওরিয়ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, এলপিজি প্ল্যান্ট, খাদ্যগুদামসহ প্রায় দেড়শ’ শিল্প প্রতিষ্ঠান সুন্দরবনের অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। এই দুর্যোগ থেকে সুন্দরবন রক্ষা করার জন্য দরকার জনসচেতনতা ও নীতি-নির্ধারকদের সংবেদনশীলতা। গত সোমবার বেলা সাড়ে ১১টায় খুলনা প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা উপরোক্ত কথা বলেন। উপক‚লীয় জীবনযাত্রা ও পরিবেশ কর্মজোট (ক্লিন), ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ও সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক)-এর যৌথ উদ্যোগে এ সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে ক্লিন’র প্রধান নির্বাহী হাসান মেহেদী বলেন, সুন্দরবনের প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা (ইসিএ)-সহ সংলগ্ন ভ‚মিতে দেড় শতাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্মিত হয়েছে বা হতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে তেলবাহী ট্যাঙ্কার, গম, সার ও কয়লাবাহী জাহাজডুবির কারণে সুন্দরবনের অস্তিত্ব নিয়ে নানারকম আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এরপর যত্রতত্র অপরিণামদর্শী দূষণকারী শিল্প-প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হলে সুন্দরবনের উপর তার অমোচনযোগ্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। এ অবস্থায় দ্রæততর সময়ের মধ্যে পরিবেশ আইন, বন আইন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায় কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বক্তারা বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ শিল্প-কারখানা নিয়ন্ত্রণ ও বন্ধ করার দাবি জানান।
সুন্দরবনের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সকলের সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করার জন্য সংবাদ সম্মেলনে আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬ দিনব্যাপী ‘বাদাবন সপ্তাহ’ ঘোষণা করা হয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই সুন্দরবনের পাশে গড়ে উঠছে ভারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ