বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
শরীয়তের বিধান হলো, বাইরে কোনো বস্তু হারালে মসজিদে এসে তার এলান বা ঘোষণা করা যাবে না। (জামেউল ফাতাওয়া)। কেবল মসজিদের নামাজিদের কিছু হারানো গেলে বা ওজুখানা, মসজিদ ইত্যাদিতে কিছু পাওয়া গেলে উপস্থিত নামাজিদের সামনে এর এলান করা যায়। খুব নগণ্য কোনো বস্তুর বিষয়ে মসজিদে এলান করা এবং এতে নামাজি ও ইবাদতকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, তাদের মনোনিবেশ বিনষ্ট করা ইসলামী আচরণবিধির লঙ্ঘন এবং নিন্দনীয় কাজ।
একবার আমিরুল মুমিনীন হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর আমলে জনৈক ব্যক্তি নামাজের পর এলান করল যে, মুসল্লী সাহেবান, ৩/৪টি খেজুর পাওয়া গেছে, যার হয় আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবেন। হযরত ওমর (রা.) তখন এ লোকটিকে আদব ও আচরণবিধি শেখানোর জন্য ডেকে নিলেন, রাগতস্বরে বললেন, এটা কী এলান করলে তুমি? এখন কি মদীনায় দুর্ভিক্ষ চলছে যে, ৩/৪টি খেজুরের জন্য মানুষ মরবে। তুচ্ছ কারণে এতগুলো নামাজির মনোযোগ আকর্ষণ ও সামান্য একটি ঘোষণার কোনো মানে হয়? মুসলিম জাতিকে অর্থহীন বালখিল্যতা থেকে বিরত রাখতে এবং প্রজন্মকে সামাজিক আচরণবিধি শিক্ষা দিতে রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে তিনি লোকটিকে দৃষ্টান্তমূলক বেত দিয়ে বাড়িও দিলেন। (আল-আশবাহু ওয়ান নাজায়ের)।
এ লোকের কাজটি ছিল বর্তমানে দেশের জাতীয় বা কেন্দ্রীয় মসজিদে একটি ব্যবহৃত মাস্ক কিংবা ২টি টাকা পাওয়া গেছের এলান করার মতো অবিবেচনাপ্রসুত ফালতু কাজ। যে জন্য লোকটিকে তিনি বেত মেরে মুসলিম জাতিকে কার্যক্রম ও আচরণের সিরিয়াসনেস নিয়ে চিন্তার শিক্ষা দিয়েছেন। মসজিদে ঘোষণা দেয়ার প্রয়োজনীয় স্থান, কাল ও গুরুত্ব বোঝালেন।
আমাদের দেশে দেখা যায়, মসজিদের পাশের বাড়ি, সংলগ্ন ফ্ল্যাট, লাগোয়া জানালা কোনো কিছু চিন্তা না করে ফুল ভলিউমে আজান দেয়া হয়। এখানে হার্টের রোগী, মুমূর্ষু বর্ষীয়ান নারী পুরুষ, নবজাত ও অল্পবয়সী শিশু থাকে। সংলগ্ন হাসপাতাল, শিক্ষালয়, গবেষণাগার, সংবেদনশীল ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীর অবস্থান। তাদের কাজে বিপত্তি, ভয় পাওয়া, চমকে ওঠা, ব্লাড প্রেসার, হাইপার টেনশন বৃদ্ধি ইত্যাদি নিয়ে ভাবা হয় না। যে মাইকটি ২/৩শ’ গজ দূরে শব্দ পৌঁছানোর উপযোগী এটি কি ৫/১০/২০/৩০ গজের জন্য অনেক বেশি অসহনীয় বিকট শব্দ নয়। এ মসজিদের আওতাধীন বাসাবাড়ি, অফিস, দোকান ও বসতির জন্য তো তিনভাগের দুইভাগ ভলিউম যথেষ্ট। মসজিদের ভেতরের জন্যও তিনভাগের একভাগ ভলিউম যথেষ্ট।
বর্তমান সময়ে মানুষের নামাজের সময় বোঝার জন্য অসংখ্য মাধ্যম রয়েছে। একটি বড় স্থাপনায় সাউন্ড সিস্টেম থাকে। রেল, স্টিমার, বিমানে বসেও নামাজের ওয়াক্ত জানার সুযোগ থাকে। ব্যাংক, বীমা, শপিংমল, এসেম্বলিতে বসেও ইন্টেরিয়র সাউন্ড বক্সে আজান শোনা সম্ভব। যতকিছুই হোক, আজান মসজিদের জামাত ও নামাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, শরীয়তের অপরিহার্য বিধান। তবে জায়গাভেদে আজানের ভলিউম কমবেশি হবে এটাই আদব।
গ্রামে দেখা যায়, কোনো কোনো মসজিদে ফজরের একঘণ্টা আগে থেকে বিকট শব্দে কিরাত, গজল, হামদ, না’ত পড়া শুরু হয়। এটি তো কোনোক্রমেই জায়েজ হতে পারে না। শরীয়তে কেবল নির্দিষ্ট ও উদ্দিষ্ট এলাকায় নামাজের জন্য আহ্বানের উদ্দেশে আজান দেয়ার হুকুম রয়েছে। তাহাজ্জুদের জন্য উচ্চশব্দ করে এলাকার সব মানুষকে ডাকাডাকি করার কোনো বিধান ইসলামে নেই।
এমনকি ব্যক্তিগতভাবে ঘরে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার সময়ও ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘুমে ব্যাঘাত করা নিষেধ। যদি সে ব্যক্তিও জাগ্রত হওয়া ও নামাজ পড়ার বিষয়ে আগ্রহী ও সুযোগ্য হয়ে থাকে তাহলে সামান্য আওয়াজ করে নামাজ পড়ার বৈধতা রয়েছে। সারা এলাকাবাসীকে ফজরের নামাজের বহু আগে জাগিয়ে তোলার কোনো বৈধতা শরীয়তে নেই। রমজানে সাহরির সময়ও এসব জাগরণী আওয়াজ বা আহ্বানে পরিমিতিবোধ ও জনস্বার্থের চিন্তা মাথায় রাখা ইসলামের দৃষ্টিতেই জরুরি।
সারারাত ওয়াজ, উচ্চস্বরে কোরআন তিলাওয়াত, মাইকে কোরআন খতম, শবিনা ইত্যাদি নিষিদ্ধ হওয়ার অন্যতম কারণও এটি। মানুষ এসব মনোযোগ দিয়ে না শুনলে, শ্রদ্ধার সাথে নীরবতা পালন না করলে গোনাহগার হয়। অসময়ে অপাত্রে অস্থানে যারা এ আওয়াজ পৌঁছাতে থাকে, তাদের দ্বিগুণ গোনাহগার হতে হবে। (মাজমুউল ফাতাওয়া।)
কারণ মানুষ পড়াশোনা, বিনোদন, পানাহার, বাথরুম, টয়লেট, ব্যক্তিগত একান্ত জীবন ইত্যাদিতে ব্যস্ত থাকার অধিকার রাখে। চিন্তা ভাবনা, গবেষণা, কর্মব্যস্ত মানুষ, ক্লান্ত, অবসন্ন, রোগী, শিশুর নীরবতা নিঃশব্দতা দরকার। ঘুমন্ত ব্যক্তির জন্য নীরব পরিবেশ প্রয়োজন। শরীয়ত এসবের প্রতি সর্বোচ্চ খেয়াল রেখেই তার প্রতিটি বিধান দিয়েছে। সারারাত উচ্চশব্দে মাইকে কোরআন পাঠ, গজল, ওয়াজ, জিকির সবই নিষিদ্ধ। নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সহনীয় মাত্রার ডেসিবল অনুমোদিত। শুধু আজানের বেলায় কাক্সিক্ষত মুসল্লিদের জন্য অপেক্ষাকৃত উঁচুমাত্রার মাইকে আহ্বানের অনুমোদন রয়েছে।
অতএব, মসজিদের মাইক ও শব্দযন্ত্রের অতিব্যবহার, অপব্যবহার এবং অবুঝ ব্যবহার থেকেও মসজিদের খেদমতে নিয়োজত দায়িত্বশীলগণ, ইমাম, খতিব, মুয়াজ্জিন সাহেবদের সচেতন থাকতে হবে। ব্যক্তিগত সতর্কতা, জনকল্যাণ চিন্তার শক্তি, আত্মবিশ্লেষণ ও শরীয়তের অনুপম নির্দেশনা অনুসরণ করলে কোনো কর্তৃপক্ষীয় নির্দেশনারই প্রয়োজন হয় না। মাইকের ব্যবহার নিয়ে অবুঝ লোকেদের বাড়াবাড়ির ফলেই দীনি কাজে ইসলামবিদ্বেষীরা নাক গলানোর সুযোগ পায়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।