হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
জামালউদ্দিন বারী
কোরবানির পশুর চামড়ার অস্বাভাবিক মূল্যপতনে কিছু সংখ্যক ট্যানারি মালিক ও চামড়া ব্যবসায়ীর বড় অঙ্কের লাভের সম্ভাবনা থাকলেও এই মূল্যপতনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের লাখ লাখ এতিম, দুস্থ ও অতি দরিদ্র পরিবার। বাংলাদেশে মুসলমানদের দুই প্রধান ধর্মীয় উৎসবকে ঘিরে আবর্তিত হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থনীতির এক বড় অংশ যায় এসব অতি দরিদ্রের পকেটে। ঈদুল ফিতরের সময় যাকাত-ফিতরা এবং ঈদুল আজহায় চামড়ার মূল্য সমেত হাজার হাজার কোটি টাকা দরিদ্র মানুষের কল্যাণে ব্যয়িত হয়। সেই সাথে কোরবানিকৃত পশুর গোস্তের বড় অংশই যায় কোরবানি না দেয়া দরিদ্র মানুষের ঘরে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে হিন্দুত্ববাদী সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে সেখানকার বিভিন্ন প্রদেশে গরু জবাই ও গরুর গোশত খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কোথাও কোথাও গরুর গোশত খাওয়ার অপরাধে(!) নিরীহ সাধারণ মুসলমানদের পিটিয়ে মারার ঘটনাও ঘটেছে। তবে এখনো ভারত বিশ্বের এক নম্বর গো-মাংস রফতানিকারক দেশ। ভারতীয়রা গোমাতার মাংস বিক্রি করে দেশের রেমিটেন্স বাড়াতে আগ্রহী, গোমাতার চামড়া দিয়ে জুতা বানিয়ে পরতেও তাদের দ্বিধা নেই। শুধুমাত্র দেশের মুসলমানরা গোমাংস খেলেই সেক্যুলার ভারতের মান মর্যাদা ও ধর্ম নষ্ট হয়। এমনকি বাংলাদেশের মুসলমানদেরও তারা গোমাংস খাওয়া বন্ধ করতে চায়। বহু যুগ ধরেই বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ভারতীয় কৃষক ও গরু খামারিরা বাংলাদেশে গরু বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে। ক্ষমতাসীন ভারত সরকার বাংলাদেশে গরু পাঠানো বন্ধ করে আমাদের গরুর গোশত খাওয়ার স্বাদ ও সাধ মিটিয়ে দিতে চাইছে। এটা আমাদের কৃষক ও খামারিদের জন্য শাপেবর হয়েছে। কোরবানিতে অতিরিক্ত অন্তত ৫০ লাখ পশুর জোগান নিশ্চিত করতে আমাদের খামারিদের কোনো সমস্যাই হয়নি। তবে এবার শেষ মুহূর্তে এসে সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় গরু-মহিষ ছাড়ার কারণে দেশীয় গরু খামারিদের অনেকেই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ভারতীয় নিষেধাজ্ঞার পরও বাংলাদেশে গরুর গোশতের আকাল পড়েনি। এ থেকে বোঝা যায়, আমাদের কৃষকরা দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণসহ যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে একশ্রেণির আমদানিকারক অপ্রয়োজনীয়ভাবে ভারতীয় নানাবিধ পণ্য আমদানি করে দেশীয় কৃষক এবং উৎপাদকদের ক্ষতিগ্রস্ত ও নিরুৎসাহিত না করলে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতি আরো শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারত। আমাদের ধান, পাট, লবণ, আলু-পিয়াজ, চামড়াসহ প্রতিটি ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না হওয়ার পেছনে ভারতীয় কারসাজি ও দেশীয় মধ্যস্বত্বভোগীদের অপতৎপরতার দায় রয়েছে। কোরবানির আগে অস্বাভাবিক হারে লবণের মূল্যবৃদ্ধি এবং কাঁচা চামড়ার অস্বাভাবিক মূল্য কমিয়ে দেয়ার পেছনে মহলবিশেষের দুরভিসন্ধি আছে বলে মনে করছে দেশের সাধারণ মানুষও। কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করা শত শত কোটি টাকা যায় দেশের কওমি মাদরাসা, এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে সরকারি সমর্থনপুষ্ট একটি মহলের অপপ্রচার এবং কোরবানির চামড়ার মূল্য কারসাজির পেছনে যোগসূত্র থাকতে পারে এবারের ঈদের সময় জনমনে এমন একটি ধারণা তৈরি হয়েছে। গত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য তিনভাগের একভাগে নেমে এলেও আমাদের দেশে এর মধ্যে তেলের মূল্য বাড়ানো হয়েছে। গত দুই অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের মূল্য কমেছে এমন কোনো দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে নেই। কাঁচা চামড়ার মূল্য কমানোর অজুহাত হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য হ্রাসের কথা বলা হলে এই দুই অর্থবছরে চামড়াজাত পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশের রফতানিকারকরা বিলিয়ন ডলারের কোটা অতিক্রম করেছে এবং আগামী তিন বছরের মধ্যে তা ৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর আশাবাদ ব্যক্ত করছেন এক্সপোর্টার্সরা। আধাফুট চামড়ার একজোড়া বাটা বা এপেক্সের জুতা কিনতে আমাদেরকে অন্তত দুই হাজার টাকা খরচ করতে হবে। অথচ এক লাখ টাকায় একটি গরু কোরবানি দিয়ে পাঁচশ টাকায় চামড়া বেচতে হচ্ছে। গত বছর যে চামড়া আড়াই হাজার টাকা ছিল, আগের বছর তিন হাজার টাকা ছিল এ বছর তা ৫০০ টাকায় নেমে আসার দৃশ্যমান বা যৌক্তিক কোনো কারণ ছিল না।
জাতীয় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক লক্ষ্য অর্জনে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কার্যত ব্যর্থ হচ্ছে। তবে সামাজিক ব্যবস্থা, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুশাসন আমাদের সমাজকে এখনো একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে টিকিয়ে রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। তথাকথিত আধুনিক, স্যেকুলার ও কর্মমুখী শিক্ষা কারিকুলামের নামে শিশু-কিশোরদের পাঠ্যসূচি থেকে ধর্মীয় নীতি-নৈতিকতার শিক্ষাকে বিসর্জন দেয়া হয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থার পেছনে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে কোটি কোটি পরিবার তাদের পারিবারিক উপার্জনের এক বড় অংশ সন্তানদের শিক্ষার পেছনে খরচ করে প্রতি বছর হাজার হাজার ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল-ব্যারিস্টার, বিসিএস পাস আমলা-শিক্ষক অথবা রাজনীতির প্রভাবশালী পদে বসানো হচ্ছে। এদের বেশির ভাগই নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত, উপরি অর্থ কামাইয়ের উস্তাদ দুর্নীতিবাজ পেশাজীবীতে পরিণত হয়ে পুরো সমাজকেই এক ধরনের অনৈতিক প্রতিযোগিতার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। সমাজ ও রাষ্ট্রকে এ দুর্নীতিবাজ উচ্চশিক্ষিত পেশাজীবীদের হাত থেকে উদ্ধার করার আপাত কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ব্যতিক্রম বাদ দিলে আমাদের গতানুগতিক আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আলোকিত মানুষ গড়ার বদলে উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেটধারী দুর্নীতিবাজ জনশক্তি গড়ে তোলা হচ্ছে। আমাদের সংবিধান দেশের সব শিশুর জন্য বিনামূল্যে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার গ্যারান্টি দিলেও রাষ্ট্র এখনো এ দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করতে পারছে না। প্রথমত, দারিদ্র্যের কারণে স্কুলে এনরোলমেন্ট ও ড্রপ-আউট বন্ধ করা যাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত দেশের সব শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যালয়, অবকাঠামো ও সুপ্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার। সরকারের এ ব্যর্থতার সুযোগে সারা দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রাক-প্রাথমিক, কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি অসুস্থ ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। তথাকথিত নামিদামি স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে উচ্চহারের টিউশন ফি, কোচিং, প্রাইভেট টিউশন, নোট ও গাইডবইয়ের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে শিক্ষা এখন উচ্চমূল্যে উচ্চগ্রেড ও সার্টিফিকেট অর্জনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থায় এই অনৈতিক মুনাফাবাজি আমাদের প্রতিটি শিশুকে শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে মানসিকভাবে কলুষিত করে তুলছে। শিক্ষা ব্যয়বাহুল্য ও নৈতিকমানহীনতা আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজকে এক অন্ধকার অবক্ষয়ের মধ্যে নিক্ষেপ করছে। চলমান সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষাকে যতটা সম্ভব কমিয়ে রাখার জোরালো প্রয়াস রয়েছে। সেই সাথে অধিকাংশ শিক্ষার্থী মাতৃভাষা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে প্রয়োজনীয় মান ও দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। অর্থাৎ সামাজিক-পারিবারিক পর্যায়ে শিক্ষার ব্যয় যতই বাড়ছে শিক্ষায় বৈষম্যও বাড়ছে এবং শিক্ষার মান যেন ততই কমছে। এমন শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কোনোভাবেই জাতি তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না। ইসলাম বিবর্জিত ও ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে দেশের লাখ লাখ পরিবারে এমনিতেই প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি এক ধরনের অনাস্থা তৈরি হয়েছে। চলমান বাস্তবতায় সরকারের পক্ষেও একসাথে সব শিশুর জন্য একমুখী মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা সম্ভব নয়। অতএব এর দুটি বিকল্প পথ হচ্ছে ব্যবসায়িক লক্ষ্যে গড়ে ওঠা বেসরকারি স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয় অথবা দ্বীনি শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে স্থানীয় উদ্যোগে গড়ে ওঠা মাদরাসায় সন্তানদের ভর্তি করিয়ে দেয়া।
চলতি অর্থবছরে সরকার শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়িয়েছে। গত অর্থবছরে (২০১৫-১৬) যেখানে শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ ছিল ১৭,১০৩ কোটি টাকা সেখানে চলতি অর্থবছরে তা বেড়ে ২৬, ৮৪৭ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। যদিও শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে এ বাজেটও অপ্রতুল। শিক্ষার প্রতিটি স্তরের অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষক- জনবল নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও বেতন-ভাতায় বাজেটের এ অর্থ ব্যয় করা হয়। এখানে স্মর্তব্য যে, আমাদের বহুধাবিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিবছর অন্তত অর্ধকোটি শিক্ষার্থী কওমি মাদরাসায় পড়ছে। কওমি মাদরাসায় পড়ুয়া এ শিক্ষার্থীর সংখ্যা দেশের সামগ্রিক শিক্ষায়তনগুলোতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর প্রায় ৪০ ভাগ। মূলত পিতৃমাতৃহীন ও অতি দরিদ্র পরিবারগুলোর সুবিধাবঞ্চিত ছেলে-মেয়েরা কওমি মাদারাসার লিল্লাহ বোর্ডিয়ে থেকে ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করে। আর কওমি মাদরাসাগুলো চলছে মূলত সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের দান-খয়রাত, জাকাত-ফিতরা, মৌসুমি ফসল ও অনুদানে। লক্ষাধিক মাদরাসা শিক্ষকের কর্মসংস্থান এবং প্রায় অর্ধকোটি দ্বীনি শিক্ষার্থীর ব্যয় নির্বাহে শিক্ষা খাতের জাতীয় বাজেট থেকে ন্যূনতম বরাদ্দও রাখা হয় না। এভাবেই দশকের পর দশক ধরে কওমি মাদরাসাগুলো টিকে আছে। দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় কওমি মাদরাসা থেকে পাস করা আলেম-উলামার কর্মসংস্থানের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। এমনকি সাধারণ শিক্ষা কারিকুলাম সম্পৃক্ত আলিয়া মাদরাসা থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের সাথেও নানা প্রকার বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। এত কিছুর পরও পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হারের ক্ষেত্রে প্রায় প্রতিবছর মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড শীর্ষ স্থান অধিকার করছে। অঘোষিত প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করেই মাদরাসা থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জায়গা করে নিচ্ছে এবং পাস করে নানা পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে। পাশাপাশি কওমি মাদরাসা থেকে পাস করা আলেমরা দেশের লাখ লাখ মসজিদে ইমাম, খতিব, মুয়াজ্জিন এবং হাফিজিয়া মাদরাসার শিক্ষক, মুফতি, ক্বারী, মুহাদ্দিস হিসেবে চাকরি করছেন। দেশের সব শহর-বন্দর ও ৬৮ হাজার গ্রামে বিস্তৃত লাখ লাখ মসজিদ-মাদরাসায় কর্মরত লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের বিষয়টি কোনো অর্থেই জাতীয় জীবনে গুরুত্বহীন বিষয় নয়। তবে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত এই বিশাল শ্রেণির পেছনে সরকারের তেমন কোনো অবদান না থাকলেও তাদের শিক্ষা ও সামাজিক অবস্থানকে নানাভাবে খাটো বা খর্ব করার প্রয়াস সর্বদাই বিদ্যমান। একশ্রেণির সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতা দীর্ঘদিন ধরে দেশের মাদরাসাগুলোকে জঙ্গিবাদের আখড়া হিসেবে অভিহিত করে আসছেন। যদিও তাদের এসব প্রচারণার কোন প্রামাণ্য ভিত্তি নেই। দেশের সাম্প্রতিক জঙ্গি তৎপরতায় শহরের নামি-দামি স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ এতদাঞ্চলে পশ্চিমা সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার কারণে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে তালেবানদের জঙ্গিবাদী তৎপরতার বিরুদ্ধে পশ্চিমা গণমাধ্যমের প্রোপাগান্ডার ঢেউ আমাদের দেশেও লেগেছে। এই প্রোপাগান্ডা এখন মাদরাসা শিক্ষাবিরোধী অপপ্রচারণায় রূপ নিয়েছে। ওয়ার অন টেরোরিজমের নামে দেড় দশক ধরে চলমান ইসলামবিরোধী যুদ্ধের সময় বিচ্ছিন্নভাবে আমাদের দেশেও বিভিন্ন সময়ে সন্ত্রাসী-জঙ্গিবাদী ঘটনা ঘটেছে। কোনো প্রকার তথ্য প্রমাণ ছাড়াই এসব ঘটনার সাথে মাদরাসাগুলোকে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং এই অজুহাত খাড়া করে দেশের অনেক মাদরাসার ওপর অনভিপ্রেত নজরদারি চালু করা হয়েছে। কেউ কেউ এমনকি কওমি মাদরাসা বন্ধ করে দেয়ারও সুপারিশ জারি করছেন। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের লাখ লাখ মসজিদে খুতবা নিয়ন্ত্রণসহ মসজিদের ওপর সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি জোরদার করারও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
যেখানে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেও সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে, বছরের প্রথম দিন বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের হাতে কোটি কোটি বই তুলে দিয়ে, শিক্ষকদের শতভাগ বেতনসহ নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা, ছাত্রীদের উপবৃত্তি এবং কোথাও কোথাও বিদেশি অর্থ সাহায্যে স্কুল ফিডিং ব্যবস্থা চালু করেও শিক্ষার্থী ড্রপ-আউট ঠেকানো যাচ্ছে না, সেখানে কোনো রকম সরকারি সাহায্য-সহায়তা ছাড়াই হাজার হাজার কওমি মাদরাসা ও লিল্লাহ বোর্ডি চলছে কী করে? প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই দিয়ে এবং সকল শিক্ষকের বেতন-ভাতা, প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার বছরে ২৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ভর্তি, টিউশন ফি, কোচিং ফি, পরীক্ষা ফি’সহ তাদের পরিবারের ব্যয় নিঃসন্দেহে অনেক বেশি। আর কওমি মাদরাসাগুলো লাখ লাখ শিক্ষার্থীর বইপত্রসহ শিক্ষা ব্যয়ের পাশাপাশি লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে তাদের থাকা, খাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদসহ সামগ্রিক ব্যয় নির্বাহ ও পরিচালনা করে থাকে। আমাদের সমাজব্যবস্থা শত শত বছর ধরে আলেমে দ্বীনের শিক্ষা, কর্মসংস্থান তথা পারিবারিক ব্যয় নির্বাহ করে আসছে। পশ্চিমা প্রোপাগান্ডা ও সরকারি অসহযোগিতা এই শিক্ষাব্যবস্থার স্বাভাবিক গতিকে কখনো রুদ্ধ করতে পারেনি, এখনো পারছে না। আগেও উল্লেখ করেছি, অতি দরিদ্র ও পিতৃ-মাতৃহীন শিশুরা কওমি মাদরাসা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে ভর্তি হয়ে থাকে। যেসব হতভাগ্য শিশুর ভরণ-পোষণ ও শিক্ষার ব্যয় সরকারের বহন করার কথা, সে কাজটি দেশের ধর্মপরায়ণ দানশীল ব্যক্তিদের অকৃপণ দানে সম্ভব হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একটি অন্যতম বড় সুবিধা হচ্ছে কওমি মাদরাসার শিক্ষকদের নির্লোভ, বিলাসহীন ও সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ততা। পারলৌকিক মুক্তি ও কল্যাণের জন্য অতি সামান্য বেতন এবং সাধারণ মানুষের যৎসামান্য দানে তারা কোনো রকমে পারিবারিক জীবন পরিচালনা করেই যেন সুখী। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সব সরকারি চাকরীজীবী, শিক্ষক ও পেশাজীবীদের বেতন-ভাতা প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এই বেতন বৃদ্ধির ফলে সরকারি অফিস-আদালত বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনিয়ম, ঘুষ-দুর্নীতি, লুটপাট কমেছে এবং সেবার মান বেড়েছে বলে কোনো তথ্য আমাদের জানা নেই। দেশের মোট জনসংখ্যার তিন-চার ভাগ বেতন বৃদ্ধির সুফল পেলেও অবশিষ্ট সব সাধারণ মানুষ কৃষক-মজুররা এই বেতন বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতির বাড়তি চাপ সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছে। দেশের কওমি মাদরাসা শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও এই মূল্যস্ফীতির চাপের শিকার।
অসাম্প্রদায়িক ও সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা চালুর নামে গত কয়েক বছরে আমাদের শিক্ষা কারিকুলামে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। নাগরিকদের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমান হওয়ার কারণে বাংলাদেশের মানুষ দেশ ভাগের সময় পাকিস্তানের সাথে একাত্ম হয়েছিল। পাকিস্তানি শাসক-রাজনীতিকদের একপেশে ধর্মান্ধতাকে যেমন এ দেশের মানুষ মেনে নিতে পারেনি, তেমনি দেশীয় বা আন্তর্জাতিক শক্তির চাপে ধর্মহীন সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা এবং চাপিয়ে দেয়া বিজাতীয় অপসংস্কৃতিকেও মেনে নিতে পারছে না। মাদরাসার বিরুদ্ধে যতই অপপ্রচার চালানো হোক, দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ সর্বদাই এসব দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দরাজহস্তে দান-খয়রাত করে এসেছে বলেই এ শিক্ষাব্যবস্থা সঙ্কুচিত না হয়ে আরো বিস্তৃত হয়েছে। সরকারি সহায়তা ও অনুদান ছাড়াই জনগণের অকুণ্ঠ দানে গড়ে ওঠা মাদরাসাগুলোর ওপর সরকারি হস্তক্ষেপ মেনে নিতে রাজি নয় কওমি মাদরাসার নীতিনির্ধারক আলেম-ওলামা। এ কারণেই যে কোনো সরকারের জন্য এটি একটি স্পর্শকাতর ইস্যু। কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্যে অস্বাভাবিক পতন ঘটিয়ে কোনো মহল কি পরোক্ষভাবে কওমি মাদরাসাগুলোকে এক ধরনের আর্থিক সংকটের মুখে ঠেলে দিতে চাচ্ছে? এতে শুধু মাদরাসা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের হতভাগ্য শিশু-কিশোররাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, দেশের অতি দরিদ্র্য, অসহায় লাখ লাখ পরিবারও হতাশ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গ্রামীণ দরিদ্রদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক খাতের নিরাপত্তা নিয়ে সরকারের আরো বেশি কিছু করণীয় আছে। কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য থেকে বঞ্চিত হলেও দেশের কোনো কওমি মাদরাসা বা লিল্লাহ বোর্ডিং বন্ধ হয়ে যাবে, এমনটি মনে করা সঙ্গত হবে না। আমাদের নামিদামি স্কুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষ যখন নানা অজুহাতে শিক্ষার্থীদের পরিবারের ওপর বাড়তি খরচের দুর্বহ বোঝা চাপায়, তখন কওমি মাদরাসার শিক্ষকরা নিজেদের সন্তানের মতো লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের পিতৃহীন শিশুদের মুখে আহার তুলে দেয়ার জন্য রাস্তায়, ঘরে ঘরে, দ্বারে দ্বারে হাত পাতছেন। এ এক বিশাল শিক্ষা ও চ্যারিটি পরিবার। এই চ্যারিটিতে সহযোগিতা দেয়া সবার নৈতিক দায়িত্ব।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।