Inqilab Logo

সোমবার, ০১ জুলাই ২০২৪, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১, ২৪ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

দিল্লির প্রশাসকের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ মুসলিম-প্রধান লাক্ষাদ্বীপ

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৯ মে, ২০২১, ১২:০২ এএম

ভারতের রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলোর মধ্যে কাশ্মীর ছাড়া একমাত্র মুসলিম-প্রধান এলাকা হল লাক্ষাদ্বীপ - আর অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্যে মোড়া এই শান্ত দ্বীপপুঞ্জ হঠাৎ করেই কিছুদিন ধরে ভারতে খবরের শিরোনামে। আরব সাগরের বুকে গোলাকৃতি ৩৬টি কোরাল দ্বীপ (অ্যাটল) নিয়ে গঠিত এই লাক্ষাদ্বীপ, আর কেন্দ্রীয় সরকারের নিযুক্ত একজন প্রশাসকই এখানে সরকারের দৈনন্দিন কাজকর্মের তদারকি করে থাকেন। সাধারণত খুব সিনিয়র আমলা বা আইপিএস অফিসাররাই এই দায়িত্ব পেয়ে থাকেন, তবে সেই ধারায় ব্যতিক্রম ঘটিয়ে গুজরাটের একজন সাবেক বিজেপি নেতাকে এই পদটি দেয়া হয়েছে।
গত ছ’মাস ধরে লাক্ষাদ্বীপে সেই প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করছেন প্রফুল খোডা প্যাটেল, যিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-র ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। ২০১২ সালে সোহরাবউদ্দিন শেখ এনকাউন্টার কেসে যখন অমিত শাহ-কে জেলে যেতে হয়েছিল, তখন গুজরাটের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বও পেয়েছিলেন এই প্রফুল খোডা প্যাটেল। আরব সাগরের বুকে লাক্ষাদ্বীপের দায়িত্ব হাতে নিয়েই তিনি এমন কয়েকটি বিতর্কিত পদক্ষেপ নিয়েছেন, যার বিরুদ্ধে ওই দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দারা এখন ক্ষোভে ফুঁসছেন। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়াতে তারা ‘সেইভ লাক্ষাদ্বীপ’ ক্যাম্পেনও শুরু করেছেন, যাতে পার্শ্ববর্তী কেরালার বহু তারকা ও রাজনীতিবিদরাও সমর্থন জানাচ্ছেন। ভারতের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ শারদ পাওয়ার প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে লাক্ষাদ্বীপের প্রশাসককে সরিয়ে দেয়ার আর্জি জানিয়েছেন। দেশের রাষ্ট্রপতির কাছেও একই দাবি জানিয়েছেন কেরালার বিভিন্ন দলের এমপি-রা। কিন্তু প্রফুল খোডা প্যাটেল মাত্র ছ’মাসের মধ্যে কী এমন করেছেন যাতে লাক্ষাদ্বীপ তার বিরুদ্ধে এভাবে বিদ্রোহ করে বসেছে? তার নানা বিতর্কিত পদক্ষেপের এই তালিকা আসলেই বেশ দীর্ঘ। নতুন প্রশাসক প্রস্তাব করেছেন, লাক্ষাদ্বীপে গরুর মাংস বা বিফ খাওয়া নিষিদ্ধ করতে হবে।
জনসংখ্যার ৯৮ শতাংশ যেখানে মুসলিম, সেই লাক্ষাদ্বীপে এখন মদ্যপান নিষিদ্ধ। কিন্তু নতুন প্রশাসক চান লাক্ষাদ্বীপের বিলাসবহুল হোটেল ও রিসর্টগুলো অ্যালকোহল পানীয় পরিবেশনের অনুমতি পাক। যাদের দুটির বেশি সন্তান আছে, তাদের পঞ্চায়েত নির্বাচনে লড়ার অধিকার থাকবে না। স্কুলে মিড-ডে মিলে এখন ডিম-মাছ-মাংসর মতো আমিষ খাবার দেওয়া হলেও তার জায়গায় শুধু নিরামিষ খাবার দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। গত বছর লাক্ষাদ্বীপে যারা ভারতের নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসি-র বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের বেশ কয়েকজনকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
লাক্ষাদ্বীপে ‘ক্রাইম রেট’ বা অপরাধের ইতিহাস প্রায় শূন্যের কাছাকাছি - অথচ সেখানে এমন একটি আইন আনার প্রস্তাব করা হয়েছে যাতে দ্বীপের প্রশাসক যে কাউকে এক বছর পর্যন্ত বিনা বিচারে আটকে রাখার ক্ষমতা পাবেন। সাধারণভাবে এই আইনটি ভারতে ‘গুন্ডা আইন’ নামেই পরিচিত। উন্নয়নের নামে লাক্ষাদ্বীপ প্রশাসন ব্যক্তি মালিকানার যে কোনও জমি অধিগ্রহণ করে নিতে পারবে। এতেই শেষ নয়, গত বছর লাক্ষাদ্বীপ বাইরে থেকে আসা প্রত্যেকের জন্য যে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা চালু করেছিল নতুন প্রশাসক আসার পর সেটাও তুলে দিয়েছেন। ফল হয়েছে এই, গোটা ২০২০ সালে যেখানে পুরো লাক্ষাদ্বীপে একজনওও পজিটিভ কোভিড রোগী ছিল না, এখন সেখানে প্রশাসন প্রায় ৭,০০০ অ্যাক্টিভ কেস নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে।
লাক্ষাদ্বীপের এমপি মহম্মদ ফয়সল বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘আমাদের দ্বীপপুঞ্জের মানুষের যে আচার, সংস্কৃতি বা খাদ্যাভাস - সেখানে কেন প্রশাসন হস্তক্ষেপ করতে চাইছে? ‘আমাদের দ্বীপে গুন্ডা আইন আনার কোনও প্রয়োজনই নেই, অথচ তারপরও স্রেফ মানুষকে ভয় দেখাতে এই সব আইন আনা হচ্ছে’!
তিনি মনে করছেন, প্রশাসক প্রফুল খোডা প্যাটেল লাক্ষাদ্বীপের নিজস্ব সংস্কৃতিকে আঘাত করেছেন বলেই তার বিরুদ্ধ জনমত এভাবে রুখে দাঁড়িয়েছে। গত কয়েকদিনে ফেসবুক, টুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়ায় শত শত দ্বীপবাসী ‘সেইভ লাক্ষাদ্বীপ’ ক্যাম্পেইনে সামিল হয়েছেন। তারা গান বাঁধছেন, কবিতা লিখছেন, দাবি জানাচ্ছেন প্রশাসককে সরানোর।
কেরালার সঙ্গে লাক্ষাদ্বীপের সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য যোগাযোগ খুব নিবিড়, লাক্ষাদ্বীপের বেশির ভাগ মানুষ মালয়লাম ভাষাতেই কথা বলেন। সেই কেরালার মেগা-তারকা ও সিনেমা অভিনেতা পৃথ্বীরাজও এই ‘সেইভ লাক্ষাদ্বীপ’ ক্যাম্পেইনকে সমর্থন করছেন। কেরালার বামপন্থী এমপি ভিনয় বিশ্বমও মনে করছেন, নতুন প্রশাসক আসলে মুসলিম-প্রধান লাক্ষাদ্বীপে একটি সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছেন। বিবিসিকে তিনি বলছিলেন, ‘পরিষ্কার বোঝাই যাচ্ছে মি. প্যাটেল বিজেপি ও আরএসএসের দালাল হিসেবে লাক্ষাদ্বীপে কাজ করতে এসেছেন। তার আনুগত্য বিজেপির প্রতি, দেশের সংবিধানের প্রতি নয়’।
পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে উঠেছে যে লাক্ষাদ্বীপে বিজেপির যুব শাখার আটজন নেতাও এক সঙ্গে প্রতিবাদ জানিয়ে পদত্যাগ করেছেন। তাদের ইস্তফাপত্র আবার টুইট করেছেন কংগ্রেস নেতা ও এমপি শশী থারুর। প্রফুল খোডা প্যাটেলের কার্যালয় বা ক্ষমতাসীন বিজেপির পক্ষ থেকে লাক্ষাদ্বীপ পরিস্থিতি নিয়ে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। কিন্তু ইতিমধ্যে ভারতের এই মুসলিম-অধ্যুষিত দ্বীপপুঞ্জে তাদের নিজস্ব আচার-সংস্কৃতি, জীবনধারা ও রীতি-রেওয়াজ রক্ষার আন্দোলন ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। সূত্র : বিবিসি বাংলা।



 

Show all comments
  • Abdullah Al Maruf ২৯ মে, ২০২১, ৫:০২ এএম says : 0
    ভারতের বিজেপি সরকারের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও মুসলিম বিদ্বেষের মাত্রা চরম পর্যায়ে এসে ঠেকেছে! যদিও এই ধরনের অসহিষ্ণু ও হিংসাত্মক কার্যকলাপের ফল ইতোমধ্যে ভারত ভোগ করছে! এই ধরনের প্রতিহিংসা পরায়ণ শাসকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া খুবই জরুরী!
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ মমিনুর রহমান ফেবুকার ২৯ মে, ২০২১, ৫:০৩ এএম says : 0
    বিজেপি বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ দাঙ্গা হাংগামা করেই আসছে। এই দলের নেতারা যেখানেই যায় সেখানেই অশান্তি শুরু হয়। লক্ষাদ্বীপের শান্তিকামী জনগণ চাইলে স্বাধীন হোক।
    Total Reply(0) Reply
  • Ataur Rahman Akash ২৯ মে, ২০২১, ৫:০৩ এএম says : 0
    মুদি সরকার সবসময় সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে এটা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থাকে ১০০ বছর পিছিয়ে নিয়ে গেছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Soheb Sikder ২৯ মে, ২০২১, ৫:০৪ এএম says : 0
    ওরা যেখানে যায় মানুষের অধিকার হরন করে নেয়। আসামে বাঙালীদের অবৈধ করল, কাশ্মিরে সায়ত্ব শাষন থাকলেও ভারতের আয়ত্বে শান্তিতে চলছিলো সেখানেও গন্ডগোল পাকিয়ে রাজ্যটাকে ভাঙল এবং সবাইকে গৃহবন্দি করে রাখলো, রাজ্যে রাজ্যে দলিত সম্প্রদায়ের প্রতি সহিংস আক্রমন করালো, মুসলিদের প্রতি হিংসাত্মক কথা বলে হিন্দু মুসলিম দাঙা বাজালো, মুম্বাই, গুজরাতে মসজিদ ভেঙে মন্দির বানালো, গো রক্ষক কমিটি করে বহু মুসলিম পিটিয়ে মারলো, হিন্দু ধর্মে জোড় করে ধর্মান্তরিত করার নামে মুসলিম, ঈসায়ী ও শিখদের হয়রানী করল, আইন করে কৃষকদের পথে নামালো এবং আন্দোলন করায় কৃষকদে বেধর পেটালো, শিখদের সাথে গন্ডগোল পাকালো, অক্সিজেন না দিয়ে নির্বাচনে টাকা ঢাললো যার ফলে করোনা দিয়ে বহু মানুষ মারা গেলো.... যে ভারত অসংখ্য ধর্ম ও জাতি গোষ্ঠি নিয়ে গঠিত সে ভারত এখন পাকিস্তানের মত সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে..... মানুষকে বৈজ্ঞানিক ও সভ্যতার দিকে না টেনে অসভ্যের মত গোমূত্র ও গোবর খাওয়ানো শেখাচ্ছে..... এরা ভারতটাকে আগামী ১০০ বছরের জন্য পেছনে ফেলছে
    Total Reply(0) Reply
  • Sajid Mahmud Shawon ২৯ মে, ২০২১, ৫:০৪ এএম says : 0
    বিজেপি যেখানেই যাবে সেখানেই তার বিষবাষ্প ছড়াবে।তাদের এটাই মূল কথা।
    Total Reply(0) Reply
  • Mohosin Hussain ২৯ মে, ২০২১, ৫:০৫ এএম says : 0
    উদ্দেশ্য সোজাসাপ্টা মুসলিম নিধন এই দ্বীপ থেকে মুসলিমদের সংখ্যা কমিয়ে উগ্র হিন্দু ঢুকিয়ে দেয়া এই দ্বীপের মানুষের উচিত দখলদার ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেয়া যেটা কাস্মীরীরা করে যাচ্ছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Engr Rashed Hasan ২৯ মে, ২০২১, ৫:০৬ এএম says : 0
    মানবাধিকার লংঘনের কারণে পশ্চিমাদের উচিত লাক্ষাদ্বীপকে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে সহায়তা করা। নইলে ভবিষ্যতে গনহত্যার মত অপরাধ সংগঠিত হবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ