Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জবানবন্দি দেননি বাবুল আক্তার

চাঞ্চল্যকর মিতু হত্যা ফের রিমান্ডের আবেদন জানাবে পিবিআই

চট্টগ্রাম ব্যুরো | প্রকাশের সময় : ১৮ মে, ২০২১, ১২:০১ এএম

দেশজুড়ে আলোচিত মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলায় ‘মুখ খুলতে’ শুরু করেন বাবুল আক্তার। জবানবন্দি দিতেও রাজি হন। মহানগর হাকিমের খাস কামরায়ও নেয়া হয়। সেখানে তাকে কিছুক্ষণ চিন্তা করার সুযোগ দেয়া হয়। সোয়া চার ঘণ্টা পর তিনি মত পাল্টান। সাফ জানিয়ে দেন দায় স্বীকার করবেন না। পরে তাকে আদালতের নির্দেশে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
গতকাল সোমবার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের খাস কামরায় দীর্ঘ অপেক্ষার পরও জবানবন্দি দেননি তিনি। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) পিবিআই পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, দীর্ঘ চেষ্টার পরও তাকে জবানবন্দি দিতে রাজি করানো যায়নি। তাকে আরও নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আজ মঙ্গলবার আদালতে ফের রিমান্ডের আবেদন করা হবে। গত বুধবার আলোচিত এ মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানোর সাথে সাথে ১০ দিনের রিমান্ড প্রার্থনা করেন আইও। শুনানি শেষে আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। গতকাল তার রিমান্ড শেষ হয়। টানা পাঁচ দিনের রিমান্ডে তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই কর্মকর্তাদের জেরার মুখে কিছু কিছু বিষয় স্বীকার করেন তিনি। প্রকারান্তরে মামলায় তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মেনেও নেন। তবে আদালতে গিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে রাজি হননি সাবেক এ চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, রিমান্ডের শুরুতে মুখ খুলতে চাননি সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার। বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তর কৌশলে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেন তিনি। কিছু কিছু প্রশ্নের জবাবে নীরবও থাকেন। টানা জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তিনি মুখ খুলতে শুরু করেন। ঘটনার শুরু থেকেই কিলিং মিশনে থাকা কামরুল ইসলাম সিকদার ওরফে মুসার ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করে আসছিলেন বাবুল আক্তার। মিতু খুনের সময় নগরীর ও আর নিজাম রোডের সিসিটিভি ফুটেজে মুসাকে সেখানে দেখা যায়। হত্যাকাণ্ডের পর মুসার সাথে কথা বলেন বাবুল আক্তার।
দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলা পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। সবাই জানে মুসা ছিল তার প্রধান সোর্স। অথচ স্ত্রী খুনের পর মুসাকে চিনেন না বলে দাবি করেন তিনি। পিবিআই কর্মকর্তারা মুসার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বাবুল আক্তার একপর্যায়ে মুসাকে চিনেন বলে জানান। তবে হত্যাকাণ্ডের আগে-পরে মুসার সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি জিজ্ঞাসাবাদে এড়িয়ে গেছেন।
মিতু হত্যাকাণ্ডের আগে দুই বন্ধুর মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে মুসার কাছে তিন লাখ টাকা পাঠানোর বিষয়েও প্রশ্ন করা হয় বাবুল আক্তারকে। জিজ্ঞাসাবাদে ঘুরে-ফিরে আসে কক্সবাজারের ইউএনএসসিআরে কর্মরত ভারতীয় নারী গায়েত্রীর প্রসঙ্গ। তার সাথে পরকীয়া এবং এর জের ধরে মিতুকে হত্যার পরিকল্পনা বিষয়ে সরাসরি প্রশ্ন করা হয় বাবুল আক্তারকে।
আইও সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে অনেক প্রশ্নের উত্তরই এড়িয়ে গেছেন বাবুল আক্তার। তবে কয়েকটি প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর দিয়েছেন। মুসা উনার সোর্স ছিলেন বলে স্বীকার করেছেন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, শ^শুর সাবেক পুলিশ পরিদর্শক মোশাররফ হোসেনের মামলায় বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বেশ কয়েকটি তিনি প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়েছেন। তবে সরাসরি দায় স্বীকার করেননি। এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট জবাব পেতে তাকে ফের রিমান্ডে আনা হবে।
হত্যাকাণ্ডের পর কিলিং মিশনের অন্যতম সদস্য ওয়াসিম ও আনোয়ারকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তখন তারা আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে মুসার নির্দেশে মিতুকে হত্যা করার কথা স্বীকার করে। তখন প্রশ্ন দেখা দেয়, মিতুকে হত্যা করতে মুসাকে নির্দেশ দিয়েছিল কে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পিবিআই কর্মকর্তারা বলছেন, বাবুল আক্তারের নির্দেশেই মুসা মিতুকে খুনের পরিকল্পনা করে। পিবিআইয়ের কাছে এ ব্যাপারে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণও রয়েছে। এসব বিষয়ে বাবুল আক্তার দায় স্বীকার করলে অভিযোগপত্র তৈরি সহজ হয়ে যাবে। তবে ইন্টারোগশেন বা জিজ্ঞাসাবাদে পারদর্শী সাবেক এ পুলিশ কর্মকর্তা এত সহজে সবকিছু স্বীকার করবেন কিনা তা নিয়ে খোদ পিবিআই কর্মকর্তাদের মধ্যেই সংশয় রয়েছে।
এদিকে পিবিআইয়ের তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে তথ্য ছিল, হত্যাকাণ্ডের পর মুসাই প্রথম বাবুল আক্তারকে ফোন করে বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদে বাবুল আক্তার মুসার কাছ থেকে কোনো ধরনের ফোন পাওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন। বরং তিনি জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ডের পর তাকে প্রথম বাসার গৃহকর্মী ফোন করেছিলেন। তিনি ঘুমে থাকায় কল রিসিভ করতে পারেননি। এরপর ফোন করে বাড়িওয়ালা বিষয়টি তাকে জানান। বাবুল আক্তারের এই বক্তব্য পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে। তারা বলেছেন, এ বিষয়ে আরও জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন আছে। পাঁচ বছর আগে হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই পলাতক আছেন কামরুল ইসলাম সিকদার মুসা। তবে তার স্ত্রী পান্না আক্তারের দাবি, মুসাকে ওই বছরের ২২ জুন পুলিশের লোকজন তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ মিলছে না।
২০১৬ সালের ৫ জুন নগরীর পাঁচলাইশ থানার ও আর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয় মাহমুদা খানম মিতুকে। স্ত্রীকে খুনের ঘটনায় পুলিশ সদর দফতরের তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তার বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদসহ নানা নাটকীয়তার পর ওই বছরের আগস্টে বাবুল আক্তারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। হত্যাকাণ্ডের পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে মিতুর বাবার মোশাররফ হোসেন প্রথম এই খুনে বাবুলের জড়িত থাকার সন্দেহ প্রকাশ করেন।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাত ঘুরে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বাবুল আক্তারের দায়ের করা মামলার তদন্তভার পড়ে পিবিআইয়ের ওপর। এরপর আস্তে আস্তে জট খুলতে থাকে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টিকারী চাঞ্চল্যকর এই মামলার। গত ১১ মে বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। তদন্তে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের লক্ষ্যে ১২ মে ওই মামলার ৫৭৫ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয় পিবিআই।
একই দিন মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় বাবুল আক্তারসহ আট জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার বাকি সাত আসামি হলেন- মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা, এহতেশামুল হক ওরফে হানিফুল হক ওরফে ভোলাইয়া, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম কালু, মো. সাইদুল ইসলাম সিকদার সাক্কু এবং শাহজাহান মিয়া। বাবুল আক্তারের দায়ের করা মামলায় কারাগারে আছেন ওয়াসিম, আনোয়ার ও শাহজাহান। এরমধ্যে পিবিআইয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওয়াসিম ও আনোয়ারকে নতুন মামলায় গ্রেফতার দেখানোর অনুমতি দিয়েছেন আদালত। সাক্কুকে র‌্যাব গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চার দিনের রিমান্ডে আনে পিবিআই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হত্যা

৪ নভেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ