বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
পিতৃহীন নাবালেগ শিশু-কিশোরদের বলা হয় ইয়াতিম। প্রচলিত বাংলায় এতিম। পিতা থেকেও নেই এমন শিশুকেও ব্যবহারিক অর্থে এতিম বলা হয়। জন্ম দেয়ার পর মাসহ শিশু সন্তানকে ফেলে চলে যায়, অসুস্থ বেকার ও অসহায় অনেক পিতা এমনিতেও শিশুকে এতিম বলে ছেড়ে দেয়। প্রকৃত এতিম বা ব্যবহারিক অর্থে এতিম অসহায় শিশু সমাজে কম নয়। দরিদ্র অসহায় দুঃস্থ ও এতিমদের জন্য ইসলাম সমাজের ওপর অনেক দায়িত্ব দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, যাকাত সদকা এতিম মিসকিন গরিবদের অধিকার। যাকাতের আটটি খাতের মধ্যেও অসহায় দরিদ্র এতিম শামিল রয়েছে।
নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আনা ওয়াকাফিলুল ইয়াতিমি ফিল জান্নাতি হা কাযা’। নবী (সা.) হাতের শাহাদাত ও মধ্যমা আঙ্গুল দেখিয়ে বলেছেন, আমি এবং এতিমের লালনকারী জান্নাতে এ দু’টি আঙ্গুলের মতোই পাশাপাশি থাকব। (বুখারী : ৫৩০৪)। এ রহমত ও বরকত লাভের জন্য মুসলিম সমাজ দেড় হাজার বছর যাবত এতিমের লালন, তার প্রতি আদর স্নেহ ও মমতা প্রদর্শন করে এসেছে। মানুষ নিজের আত্মীয় এতিমকে বরকত, সওয়াব ও পরকালে নাজাতের আশায় নিজ পরিবারের সদস্যরূপে লালন করে। পবিত্র রমজানে এতিমদের সাহায্য সহযোগিতা করার সওয়াব শত শত গুণ বৃদ্ধি পায়।
এতিমদের মধ্যে যারা দীনি ইলম শিখে তাদের সহায়তা দেয়ার মধ্যে দু’টি প্রতিদান পাওয়া যায়। এক. এতিমের খেদমত। দুই. দীনি ইলমের প্রসার। এতিমের দায়িত্ব গ্রহণের মর্যাদা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
‘তারা তোমাকে ইয়াতীমদের সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করছে; বল, ‘তাদের উপকার করা উত্তম’ এবং যদি তাদের সঙ্গে তোমরা একত্রে থাক, তবে তারা তো তোমাদেরই ভাই’। (সুরা : বাকারা : ২২০)।
এতিমের মর্যাদা সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেন, বিধবা, এতিম ও গরিবের সাহায্যকারী ব্যক্তি আল্লাহর পথে মুজাহিদের সমতুল্য। অথবা তার মর্যাদা সেই (নামাজের জন্য) রাত জাগরণকারীর মতো, যে কখনো ক্লান্ত হয় না। অথবা তার মর্যাদা সেই রোজাদারের মতো, যে কখনো ইফতার (রোজা ভঙ্গ) করে না। (মুসলিম : ৫২৯৫)।
ইসলামের দৃষ্টিতে এতিমের প্রতিপালন জান্নাতে যাওয়ার পথ। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো এতিমকে আপন মাতা-পিতার সঙ্গে নিজেদের (পারিবারিক) খাবারের আয়োজনে বসায় এবং (তাকে এই পরিমাণ আহার্য দান করে যে) সে পরিতৃপ্ত হয়ে আহার করে, তাহলে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে।’ (মুসনাদে আহমাদ : ১৮২৫২)।
দেশে দেশে হাজার হাজার এতিম আশ্রয় পেয়ে থাকে মকতব, মাদরাসা ও হিফজখানায়। কওমী মাদরাসার প্রায় সবগুলোতেই এতিমখানা থাকে। হিফজখানার ছাত্ররা ২৪ ঘণ্টাই একটি বিশেষ রুটিন মাফিক চলে। তারা শেষ রাতে কোরআন শরীফ মুখস্থ করে। চলতি রমজানে লকডাউনের জন্য দেশের হিফজখানাগুলো বাধার সম্মুখীন হয়েছে। ছাত্রদের পড়ার ব্যাঘাত ঘটছে। লকডাউনে থেকেও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের শর্তে হিফজখানাগুলো চালু করা বিশেষ জরুরি। এতে ২৪ ঘণ্টা কোরআন তেলাওয়াতের ফলে দেশ ও জাতির জন্য আল্লাহর বিশেষ রহমত পাওয়া যাবে।
অধিকাংশ হিফজখানা ও এতিমখানা রমজানে অধিক দান সাহায্য পেয়ে থাকে। এসব আয় দিয়েই মূলত হিফজখানা ও এতিমখানা চলে। চলতি বছর রমজানে এতিমদের এসব আশ্রয় চালু নেই বললেই চলে। মানুষের যাকাত সদকা ও দানের প্রবাহও বন্ধ প্রায়। এমন সময়ে দান সদকা ও যাকাত প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি।
রমজান দানের শ্রেষ্ঠ মওসুম। সওয়াবের পরিমাণ এসময় আল্লাহ বৃদ্ধি করে দিয়েছেন। বহু মাদরাসা লকডাউনে বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও প্রশাসনের কর্মচারীরা এতে এতিমদের থাকতে দিতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ বহু মাদরাসায় এমন এতিম ছাত্রও পাওয়া যায়, যাদের যাওয়ার জায়গা নেই। ঈদেও তারা বাড়ি না গিয়ে মাদরাসায় ঈদ করে। তাদের মা বাবা কেউ বেঁচে নেই। যাওয়ার মতো কোনো আশ্রয়ও নেই। এমন হাজার হাজার এতিম দেশের এতিমখানা, মাদরাসা ও হিফজখানায় রয়েছে। লকডাউন ও করোনা সঙ্কটে তাদের ব্যয় নির্বাহ করতে কষ্ট হচ্ছে। ধার কর্জ করে মাদরাসাগুলো চলছে। এমতাবস্থায় কোরআন-সুন্নাহর আহ্বান মনে রেখে ধর্মপ্রাণ প্রতিটি মানুষের কর্তব্য এতিমদের মুক্তহস্তে সাহায্য করা।
সমাজের বিত্তবান, ধনী ব্যবসায়ী, সমাজসেবক ও শিল্পপতিদের উচিত আল্লাহর রহমত ও নাজাত লাভের উদ্দেশ্যে এতিমদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া। অশান্তি, দুর্ঘটনা, মহামারি, রোগব্যাধি থেকে নিরাপদ থাকার জন্য দান সদকার বিকল্প নেই। ঈমানের সাথে মৃত্যু এবং দোজখ থেকে মুক্তির জন্যও দান সদাকার পথ অবলম্বন অবশ্য কর্তব্য।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।