শ্রমজীবীদের কপালে করোনার ঘা
করোনা মহামারি শ্রমিকের ললাটে প্রচন্ড আঘাত হেনেছে। করোনার প্রকোপ হিমালয়ের চূড়া থেকে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত
বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে পহেলা মে এক অবিস্মরণীয় দিন। এই দিনটির ইতিহাস আধুনিক শিল্প-সভ্যতা বিকাশের সূচনা পর্বের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত। তখন শ্রমিকদের অধিকার বলতে তেমন কিছু ছিল না। তাদের ন্যায়সঙ্গত বেতনের কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বলতেও কিছু ছিল না। অত্যন্ত স্বল্প মজুরিতে তাদের হাড়ভাঙ্গা শ্রম দিতে হতো। কর্ম-সময়ের কোনো ঠিক-ঠিকানা ছিল না। কারখানা মালিকেরা যতক্ষণ ইচ্ছা তাদের খাটিয়ে নিতো। দৈনিক ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত তাদের কাজ করতে হতো। প্রাচীন মিশরের শ্রমদাসদের চেয়েও তাদের অবস্থা ছিল শোচনীয়। আজকের বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকদের এই ছিল হাল। অন্যান্য দেশে শ্রমিকদের অবস্থাও এর চেয়ে ভালো ছিল না।
এই পটভূমিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রমিকরা প্রথমে কর্মঘণ্টা ১০ ঘণ্টা করার দাবিতে সোচ্চার হয়। এই দাবিতে ১৮০০ সালের শুরু থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত সেখানকার শ্রমিকরা তাদের কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় ধর্মঘট চালিয়ে যায়। ১৮২৭ সালের প্রথম দিকে শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে ওঠে। কর্মঘণ্টার আন্দোলনে কিছুটা সাফল্যও আসে। গৃহযুদ্ধের পর শ্রমিক আন্দোলন আরো তীব্র হয়ে ওঠে। প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন শ্রমিকদের প্রতি ছিলেন সহানুভূতিশীল। তিনি চাইতেন শ্রমিকরা ন্যায়সঙ্গত অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা লাভ করুক। এক ভাষণে তার এই মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি বলেন, যা কিছু শ্রমিকদের ক্ষতি করবে তা আমেরিকার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা বলে বিবেচিত হবে। কেউ যদি বলে আমেরিকাকে ভালোবাসে কিন্তু শ্রমিকদের ঘৃণা করে তাহলে সে মিথ্যাবাদী। কেউ যদি বলে সে আমেরিকাকে বিশ্বাস করে কিন্তু শ্রমিকদের ভয় পায় তাহলে সে নির্বোধ। তিনি শ্রমিকদের ধর্মঘট করার অধিকার সমর্থন করেন।
বিভিন্ন দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে এ ধরনের অভিমত ও সমর্থন শ্রমিক আন্দোলনকে উত্তরোত্তর বেগবান করে তোলে। এতে মালিক-শ্রেণি বিচলিত ও শংকিত হয়ে পড়ে। বেতন ঠকিয়ে, অধিক সময় ধরে কাজ করিয়ে উচ্চ মুনাফা অর্জনের যে সিঁড়ি তারা তৈরি করেছিল তা ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে পড়ে। এমতাবস্থায়, তারা কায়েমি স্বার্থ সংরক্ষণে মরিয়া হয়ে ওঠে। শ্রমিকদের উপর জুলুম-পীড়ন বেড়ে যায়। একই সঙ্গে মালিকরা শ্রমিক আন্দোলন ও শ্রমিকদের সংহতি বিনষ্ট করার জন্য গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তারা প্রলোভন দিয়ে, বাড়তি সুবিধা দিয়ে কিছু শ্রমিককে তাদের পক্ষে নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে বিভেদ, বিবাদ সৃষ্টি করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। এতে কোথাও কোথাও সাফল্য অর্জন করে। সে সময়ের একজন কারখানা মালিকের উক্তি এখানে উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেন, শ্রমিক শ্রেণির অর্ধেকটা আমি ভাড়া করতে পারি বাকি অর্ধেককে খুন করার জন্য।
অবশ্য মালিকদের এই ষড়যন্ত্র ও নাশকতামূলক তৎপরতা এবং রাষ্ট্রযন্ত্র ও সংবাদপত্রের ব্যাপক বৈরিতা সত্ত্বেও শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন চলতেই থাকে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৮৮৬ সালের পহেলা মে যুক্তরাষ্ট্রের সাড়ে ১১ হাজারেরও বেশি কারখানার শ্রমিক ধর্মঘটের ডাক দেয় এবং ওইদিন সফলভাবে ধর্মঘট হয়। ৩ মে পুলিশ গুলি চালায় এবং চারজন শ্রমিক নিহত হয়। আহত হয় আরো অনেকে। ৪ মে পুলিশি হামলার প্রতিবাদে শিকাগো শহরের হে মার্কেটে আয়োজন করা হয় শ্রমিক সমাবেশের। এই সমাবেশেও পুলিশ গুলি চালিয়ে কয়েক জনকে হত্যা করে। কিছুসংখ্যক শ্রমিক আহত হয়। এই সমাবেশে পুলিশ-শ্রমিক সংঘর্ষে কয়েকজন পুলিশও হতাহত হয়। এ নিয়ে মামলা হয় এবং কয়েকজন শ্রমিক নেতাকে প্রহসনের বিচারে ফাঁসির দন্ড দেয়া হয়, যা পরে কার্যকর হয়। ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন-সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও রক্তদান কখনো ব্যর্থ হয় না। এই পর্যায়ের আন্দোলন-সংগ্রামের মূল দাবি ছিল, দৈনিক কর্মকাল ৮ ঘণ্টা করা। এই আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় পরে তা অর্জিত হয়। এই অর্জন এক ঐতিহাসিক অর্জন, যা এখনো বিশ্বের দেশে দেশে বহাল রয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত সোস্যালিস্ট লেবার ইন্টারন্যাশনালের সম্মেলনের এক প্রস্তাবে প্রতি বছর পহেলা মে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। সেই থেকে প্রতি বছর সারা বিশ্বে পহেলা মে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। মে দিবস শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন-সংগ্রামের মাইলফলক। এদিন শ্রমিকদের বিজয়ের দিন, সংহতির দিন, আন্দোলন-সংগ্রামে উদীপ্ত ও অনুপ্রাণিত হওয়ার দিন।
একথা অস্বীকার করা যাবে না, শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে কমিউনিস্টদের কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সংযুক্ত হওয়ায় শ্রমিক আন্দোলন পরবর্তী পর্যায়ে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। শ্রমিকদের নিয়োগপত্র প্রদান, বেতনভাতা বৃদ্ধি, কল্যাণমূলক সুবিধাদি দান, কর্মঘণ্টা নির্ধারণ, কর্মপরিবেশের উন্নয়ন ও নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় আইন-বিধি প্রণয়নসহ নানা ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়। কিন্তু ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’, ‘শ্রমিকরাজ কায়েম করো’ ইত্যাদি শ্লোগান বাস্তবায়ন করতে কমিউনিস্ট দেশগুলো শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়। দেখা যায়, ওই সব দেশে শ্রমিকরা অন্যভাবে শোষিত ও বঞ্চিত হচ্ছে। উৎপাদনযন্ত্রের মতোই তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। সাম্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা কমিউনিজনের পতনের একটি বড় কারণ। শ্রমিক আন্দোলনের প্রতি রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রিক সমর্থন কমে যাওয়ায় এবং শ্রমিক কল্যাণে কমিউনিজমের ব্যর্থতায় শ্রমিক আন্দোলনের বিরাট ক্ষতি হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, শ্রমিক আন্দোলন যদি তার নিজস্ব চরিত্র নিয়ে অব্যাহত থাকতো তাহলে শ্রমিকরা এখনকার চেয়ে হয়তো আরো বেশি সুবিধা, নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা লাভ করতে পারতো। বিশ্বের সর্বত্রই এখন শ্রমিকরা অবনত অবস্থায় রয়েছে। তাদের মধ্যে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংহতি নেই বললেই চলে। সাম্রাজ্যবাদের বহুল আলোচিত বিশ্বায়ন তত্তে¡র বাস্তবায়ন শ্রমিকদের শোষণ-বঞ্চনা ও অধিকারহীনতাকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে। লগ্নি-পুঁজির দাপট এবং সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী বিভিন্ন আর্থিক সংস্থা বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে। এখানে পুুঁজিপতিদের স্বার্থ, সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ নিশ্চিত সংরক্ষণ লাভ করছে। এখানে শ্রমিক স্বার্থ উপেক্ষিত। তারা ভয়ানকভাবে পরিস্থিতির শিকার, বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।