Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দিনভর চাল কান্ডের নাটক, খাদ্য গুদাম কর্মকর্তাসহ নৈশ প্রহরী আটক

টাঙ্গাইল জেলা সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ১৪ এপ্রিল, ২০২১, ৯:৪১ পিএম

জেলা খাদ্য কর্মকর্তা, উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা ও গুদাম কর্মকর্তার দিনভর নাটক শেষে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর খাদ্য গুদাম থেকে পাচার হওয়া খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর ৬৪০ বস্তা চালের মধ্যে ২৮০ বস্তা চাল জব্দ করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার (১৩ এপ্রিল) মধ্যরাতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইশরাত জাহানের উপস্থিতিতে এ চাল জব্দ করা হয়। তবে এখনো উদ্ধার হয়নি পাচার হওয়া ৩৬০ বস্তা চাল।

এদিকে, মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটার দিকে চাল পাচারের ঘটনা সংঘটিত হলেও পাচারের ঘটনা ধামাচাপা দিতে ব্যর্থ হয়ে মধ্যরাতে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা মুক্তা রানী সাহা থানায় অভিযোগ দায়ের করে। পরে পুলিশ গুদাম কর্মকর্তা বেলাল হোসেন ও নৈশ প্রহরী আল-আমিনকে আটক করে।

জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, খাদ্য কর্মকর্তা, ডিলার ও গুদাম কর্মকর্তার যোগসাজশে ভূঞাপুর খাদ্য গুদাম থেকে চাল পাচার হয়ে আসছে। বিশেষ করে ডিলারদের নামে বিভিন্ন কর্মসূচীর বরাদ্দকৃত চাল সুবিধাভোগীদের মাঝে বিতরণ না করেই গুদাম থেকে তা ট্রাক যোগে বিক্রি করা হতো।

তেমনি গত মঙ্গলবার দুপুরে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচী ১০ টাকা কেজি দরের দুই ট্রাক চাল পাচারের গোপন সংবাদের ভিত্তিতে একটি ট্রাক আটকে স্থানীয় সংবাদকর্মীরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. ইশরাত জাহানকে খবর দেন।

পরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে নির্বাহী কর্মকর্তা এবিষয়ে গুদাম কর্মকর্তা মো.বেলাল হোসেনের কাছে চালান ও ডিও কপি, গেট পাশ ও ডিলারের নামের তালিকা চাইলে তিনি তা দেখাতে অপারগ হন। তা নিয়ে শুরু করেন নানা টালবাহানা। সিসিটিভির পাসওয়ার্ডওসহ নানা কিছুতেই চরম অসহযোগিতা করেন তিনি।

পরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা মুক্তা রানী সাহা। চলতে থাকে নানা ধরনের নাটক। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইসরাত জাহান বিষয়টি ওসি মোহাম্মদ আবদুল ওহাবকে জানালে সঙ্গীয় ফোর্সসহ ঘটনাস্থলে আসেন এসআই টিটু চৌধুরী। নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে লিখিত নেয়া হয় আল আমিন ও বেলাল হোসেনের। লিখিত বক্তব্য দুই রকমের তথ্য দেন দুই জন। আল আমিন চাল পাচারের বিষয়টি স্বীকার করে দায় চাপান গুদাম কর্মকর্তার উপর। আর গুদাম কর্মকর্তা চালের বস্তার ভুল তথ্যসহ পাচারের বিষয়টিই অস্বীকার করেন।

লিখিত বক্তব্যে আল আমিন বলেন বিকেল ৪.৩০ মিনিটের দিকে ভূঞাপুর উপজেলা খাদ্য গুদাম হতে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর ৩৬০ বস্তা চাউল (৩০ কেজি করে) ভর্তি একটি ট্রাক বের হয়ে যায়। অপর একটি ট্রাকে ২৮০ বস্তা লোড করা হয়। বিভিন্ন ডিলারের রেখে যাওয়া সংকুলান না খাদ্য গুদামে রেখে যায়। উক্ত মালগুলি আমি নিজে গুনে ড্রাইভার বুঝিয়ে দেই। উক্ত কাজটি আমি গুদার কর্মকর্তার নির্দেশে উপস্থিতিতে কাজ করি।

আল আমিন মৌখিকভাবে চাল পাচার হবার কথা স্বীকার করলেও ট্রাকের গন্তব্য ও তথ্য জানেন না বলে জানান। এদিকে গুদাম কর্মকর্তা গুদাম লিখেন, ভূঞাপুর উপজেলার খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর বিভিন্ন ডিলারের রেখে যাওয়া চাল বিলির উদ্দেশ্য দেয়া হয়েছে।
২৮০ বস্তার ১৪ মে.টন চাল ট্রাকটিতে রহিয়াছে। ট্রাক বাহির হইয়া যাবার সময় সাংবাদিকগণ ট্রাকটি আটক করেছেন।

পরের লিখিত বক্তব্যে জানান, ভূঞাপুর উপজেলার খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর বিভিন্ন ডিলার কিছু কিছু চাল রেখে যায়। ডিলারের নাম হচ্ছে গাবসারার ফরহাদ হোসেনের ৪ মে.টন, নজরুল ইসলামের ৪ মে.টন, দিলিপের ৪ মে.টন এবং অর্জুনা ডিলার শাখাওয়াত হোসেন লেবু ২ মে.টন চাল। যা ৩০ কেজি ওজনের সর্বমোট ২৪০ বস্তা চাল রহিয়াছে। অপর ট্রাকটির বিষয়ে লিখিত বক্তব্যে লেখেন ওই ট্রাকের সময় উপ খাদ্য পরিদর্শকের সহিত অলোয়া ইউপি ডিলারের দোকান পরিদর্শনে যাই। এ বিষয়ে আমার জানা নেই।

এর ফাঁকেই ধূর্ত চাল পাচারের বিষয়টি ধামাচাপা দিতে গাবসারা ইউনিয়নের দুই ডিলারসহ আরো কয়েকজনকে ডেকে এনে গোপনে স্বাক্ষর করিয়ে নেন গুদাম কর্মকর্তা বেলাল হোসেন।

এদিকে আল আমিন ও গুদাম কর্মকর্তার বেলালের লিখিত বক্তব্যে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য এবং গুদাম কর্মকর্তা দুই রকমের লিখিত বক্তব্যে গড়মিল থাকার পরেও চলে বিষয়টি ধামাচাপা ও ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে চেষ্টা জেলা খাদ্য কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা।

তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি। রাত দশটার দিকে খোলা হয়ে ট্রাকের ছাউনি। সরকারি পাটের বস্তার পরিবর্তে একে একে বের হয়ে আসে ৫০ কেজি প্লাস্টিকের বস্তায় ২৮০ টি বস্তা চাল। যা গত ১১ তারিখ খুলনা থেকে এসেছে বলে নিশ্চিত উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা মুক্তা রানী সাহা।

পরে সে চাল জব্দ করে ট্রাকসহ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। গোপন করেন ৩৬০ বস্তা চাল পাচারের বিষয়টি। কিন্তু তা আর বেশি সময় গোপন থাকেনা। মামলার অভিযোগেও সেটি লিপিবদ্ধ করা হয়।

উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা মুক্তা রানী সাহা জানান, চালগুলো সোমবার খুলনা থেকে এসেছে। ওসি এলএসডিই চালগুলো রিসিভ করেছেন। এসব চাল গোডাউনে থাকার কথা। কিভাবে ট্রাকে করে পাচার হচ্ছে তা তিনি জানেন না।

এ বিষয়ে ভূঞাপুর থানা অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব বলেন, উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা মুক্তা রানী সাহার অভিযোগের ভিত্তিতে গুদাম কর্মকর্তা বেলাল হোসেন ও নৈশ প্রহরী আল-আমিনকে আটক করা হয়েছে। পরে আজ বুধবার (১৪ এপ্রিল) দুপুরে তাদের আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। তবে অভিযুক্তরা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হওয়ায় মামলাটি দুদকে রেকর্ড হবে। এ বিষয়ে দুদক টাঙ্গাইল আঞ্চলিক কার্যালয়ের সাথে কথা হয়েছে। দুদকই এর তদন্ত করবে।

উপ‌জেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা: ইশরাত জাহান ব‌লেন, ট্রাকসহ ২৮০ বস্তা সরকা‌রি চাল জব্দ করা হ‌য়ে‌ছে। এ বিষয়ে মামলা দায়ের করা হয়েছে। জেলা খাদ্য কর্মকর্তা কামাল হোসেন বলেন, এ বিষয়ে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা তিন কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করিবে। এর আলোকে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া এবং হওয়া ৩৬০ বস্তা চাল উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগীতা নেয়া হচ্ছে। উল্লেখ্য, টাঙ্গাইলের সকল উপজেলায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর একই অবস্থা। যেখানে রক্ষকই ভক্ষক। যা সুষ্ঠু নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে বেরিয়ে আসবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: টাঙ্গাইল


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ