Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সড়কে বিশ্রামহীন চালক!

দূরপাল্লার গাড়িতে উপেক্ষিত প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা দুর্ঘটনার প্রধান কারণ চালকদের বিশ্রামহীন গাড়ি চালানো : অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক চালক সঙ্কটে দুইজন নেয়া সম্ভব হচ্ছে না : খন্দকার

খলিলুর রহমান | প্রকাশের সময় : ৩ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০০ এএম

বিশ্রামহীন ড্রাইভিংয়েই সড়ক-মহাসড়কে অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে। স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে গাড়ি চালানোর জন্য অধিকাংশ সময় স্নায়ুবিক সমস্যায় ভোগেন দূরপাল্লার বাস-কোচের চালকরা। ফলে চালকের আসনে বসে তারা অমনোযোগী হয়ে পড়েন। এতে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা। এমনটিই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এসব দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনতে দূরপাল্লার বাসগুলোতে দুইজন করে চালক রাখার নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওই নির্দেশনা কার্যকর হয়নি।
চিকিৎসকদের মতে, স্বাভাবিকের তুলনায় অতিরিক্ত সময় গাড়ি চালানোর ফলে চালকের শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তির সৃষ্টি হয়। এতে করে তারা প্রায়ই চলন্ত অবস্থায় মনোযোগ হারিয়ে ফেলেন। তাই একজন চালককে কম পক্ষে সাত ঘণ্টা ঘুমানোর প্রয়োজন বলে মনে করেন স›দ্বীপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ডা. মো. সাহেদ হোসেন।
এছাড়াও পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, সড়কে দুর্ঘটনা বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে চালকের বিরতিহীন ড্রাইভিংয়ের পাশাপাশি মহাসড়কে মিশ্র-পরিবহন চলাচল, সড়কের গতি ব্যবস্থাপনা না থাকা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, মহাসড়কের পাশে হাটবাজার ও সড়ক নির্মাণ সংক্রান্ত ত্রæটিও দায়ী। তবে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বেশি হওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে চালকের বিশ্রাম না থাকা এবং অমনোযোগী হওয়াকেই দায়ী করছেন সবাই।
সম্প্রতি রাজধানীর সায়েদাবাদ, গাবতলী, মহাখালী বাস টার্মিনালগুলো ঘুরে এবং চালক-হেলপারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দূরপাল্লার অধিকাংশ বাসের চালকই দৈনিক ২০ ঘণ্টারও বেশি সময় কাজে নিয়োজিত থাকেন। ঢাকা থেকে দেশের জেলা শহরগুলোতে যাত্রী পৌঁছানোর পর পরবর্তী ট্রিপের জন্য আবারও তাদের ফিরতে হয় ঢাকায়। এ ক্ষেত্রে তারা মাত্র দুই থেকে তিন ঘণ্টার বিশ্রামের সুযোগ পাচ্ছেন। অনেকের ক্ষেত্রে সে সুযোগও হয় না। ঢাকায় এসে আবার তারা বিভিন্ন গন্তব্যে যাত্রা করছেন।
মহাখালীতে করিম মিয়া নামের এক চালক ইনকিলাবকে জানান, ওই টার্মিনাল থেকে যেসব বাস দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যায় তাতে একজনই চালক রয়েছেন। অতিরিক্ত কোনো চালক নেই। মালিকপক্ষ দুইজন চালক রাখতে চান না। এ কারণেই দুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে বলে তিনি মনে করছেন।
গত ২৬ ফেব্রæয়ারি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সিলেটের দক্ষিণ সুরমার রশিদপুর এলাকায় যাত্রীবাহী দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে আটজন নিহত হন। ওই দিন সকাল পৌনে সাতটার দিকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দক্ষিণ সুরমার রশিদপুরে একটি পেট্রলপাম্পের কাছে বিপরীতমুখী বাস দুটির মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে। এতে ঘটনাস্থলে ছয়জন ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুজনের মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনায় আহত হন অন্তত ২০ জন।
গত ১৬ মার্চ রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কের কাপাশিয়া এলাকায় যাত্রীবাহী বাস ও মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে ১৭ জন নিহত হন। ওই দিন দুপুরে রংপুর থেকে একটি মাইক্রোবাস রাজশাহী আসছিল। পথে রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কে কাটাখালী থানার সামনে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে মাইক্রোবাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটি হিউম্যান হলারকে (লেগুনা) ধাক্কা দেয়। এ সময় মাইক্রোবাসের গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ধরে ভেতরে থাকা ১৭ জনের সবাই মারা যান।
গত ১৫ মার্চ দিবাগত রাতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে গোয়ালাবাজার এলাকায় বাসের সঙ্গে ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আরও চারজন আহত হন। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা একটি বাস গোয়ালাবাজার এলাকায় পৌঁছালে বিপরীত দিক থেকে আসা ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে বাস চালকের সহকারী গুরুতর আহত হন।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির জরিপ বলছে, গত বছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ৬ হাজার ৬৮৬ জন। আহতের সংখ্যা হচ্ছে ৮ হাজার ৬০০ জন। অপরদিকে, রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ৫ হাজার ৪৩১ জন। সারাদেশে ৪ হাজার ৭৩৫টি দুর্ঘটনায় এই প্রাণহানি ঘটে। এছাড়া আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৩৭৯ জন।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের জুন মাসে দূরপাল্লায় চালকদের যাতে একটানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাতে না হয় সেজন্য বিকল্প চালক রাখার নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া সড়কের পাশে বিশ্রামাগার তৈরি, সিগন্যাল মেনে চলা, অনিয়মতান্ত্রিক রাস্তা পারাপার বন্ধ, সিট বেল্ট বাঁধা এবং চালক ও তার সহকারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার নির্দেশনা দেন। সড়কে দুর্ঘটনা কমানোর জন্য এমন নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এখন পর্যন্ত নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি রাত ১১টার দিকে রাজধানীর শ্যামলী ও কল্যাণপুর এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, দূরপাল্লার বাসগুলো রাস্তার মধ্যে সারিবদ্ধ করে রাখা। আবার কোনো কোনো বাস যাত্রী নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা করছে। এ সময় একটি পরিবহনের বাসের একজন কন্ট্রাক্টর নাম প্রকাশ না করা শর্তে ইনকিলাবকে বলেন, তার বাসটি ঢাকা থেকে নীলফামারী যাবে। রাত ১১টায় বাসটি ঢাকা থেকে ছেড়ে পরদিন সকালে নীলফামারী পৌঁছাবে। পরে সেখান থেকে আবার যাত্রী নিয়ে ওই দিন বিকালে ঢাকায় ফিরবে। পরে সন্ধ্যায় ফের ঢাকা থেকে যাত্রী নিয়ে নীলফামারী যাবে। এভাবেই বাসগুলো বিরামহীনভাবে চলতে থাকে। এক্ষেত্রে বাসের কন্ট্রাক্টর পরিবর্তন হলেও বাসের চালক অপরিবর্তিত রাখা হয়। তিনি বলেন, একজন চালক যতক্ষণ পর্যন্ত ক্লান্ত না হবেন; ততক্ষণ পর্যন্ত বাস চালাতে থাকেন। এখানে কোনো নিয়ম বা আইনের তোয়াক্কা করা হয় না।
তিনি জানান, একজন কন্ট্রাক্টর ছয় ঘণ্টা করে ১২ ঘণ্টা ডিউটি পালন করেন। কিন্তু চালকরা টানা ২৪ ঘণ্টাও ডিউটি পালন করে থাকেন। পরে কয়েক ঘণ্টা ঘুমের পর আবার গাড়ি চালানো শুরু করেন। শুধু নীলফামারী নয়, রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, নওগাঁ, জয়পুরহাট, বগুড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় দূরপাল্লার বাস চলাচল করে। ওইসব বাসের যাত্রীদের অভিযোগ, চালকরা বেপরোয়াভাবে বাস চালান। এছাড়াও রাতের সময় বাস চালকদের চোখে অনেক সময় ঘুম আসতে দেখা যায়। এ সময় চোখে বার বার পানি দিয়ে চালকরা জেগে থাকার চেষ্টা করেন। ঘুমের কারণে অনেক সময় চালকরা দুর্ঘটনায় শিকার হন।
গ্রীন লাইন পরিবহনের একজন চালক ইনকিলাবকে জানান, তিনি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে দীর্ঘ দিন থেকে বাস চালান। তাই প্রতিদিন দুইবার ওই সড়কে আসা-যাওয়া করেন। এক বার গেলে ২৩০০ টাকা দিতে হয় তাকে। এছাড়াও মালিক পক্ষ থেকে চালকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হয়। সেই জন্য মালিক পক্ষ চালকদের সুবিধা মতো বাস চলানোর সুযোগ দিয়ে দেন। এতে একজন চালক নিয়মের তোয়াক্কা না করেই ক্লান্তি না আসা পর্যন্ত বাস চালাতে থাকেন।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, এটার জন্য প্রধানমন্ত্রীর একটি নির্দেশনাও রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা কার্যকর না হওয়ায় কমছে না দুর্ঘটনা। দূরপাল্লার বাসগুলোতে বিকল্প চালকরা রাখার প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা দ্রæত কার্যকর করা উচিত। যারা এই আদেশ উপেক্ষা করবেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ ইনকিলাবকে বলেন, যে সংখ্যক পরিবহণ রয়েছে; সেই তুলনায় একজন করেও চালক নেই। চালকের অভাবে থাকায় দুইজন করে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, পরিবহন সেক্টরে চালক সঙ্কট দীর্ঘদিনের। এছাড়াও অনেক সময় চালকরা বেশি আয় করার জন্য ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত গাড়ি চালায়। তবে চালক স্বল্পতা কাটানো হলে দুইজন করে চালক দেয়া সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং) বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক ইনকিলাবকে বলেন, মহাসড়কে দুর্ঘটনার অনেক কারণের প্রধানটি হচ্ছে চালকদের বিশ্রামহীন গাড়ি চালানো। আন্তর্জাতিকভাবে সকল প্রকার চালকদের জন্য একটি স্ট্যান্ডার্ড আছে। যেখানে একজন চালক যে কোনো রুটে ড্রাইভিংয়ের সময় প্রতি চার ঘণ্টা পর পর চার ঘণ্টার জন্য বিশ্রাম নেবেন। এ ক্ষেত্রে একজন চালকের জন্য বিশ্রাম প্রয়োজন হয় ১২ ঘণ্টার। কিন্তু আমাদের দেশে এই স্ট্যান্ডার্ডও প্রযোজ্য নয়।



 

Show all comments
  • fastboy ৩ এপ্রিল, ২০২১, ৯:৩১ এএম says : 0
    বিশ্রামহীন ড্রাইভিংয়েই সড়ক-মহাসড়কে অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে
    Total Reply(0) Reply
  • Anwar+Hossain ৩ এপ্রিল, ২০২১, ১১:৪১ এএম says : 0
    বিশ্রামহীন ড্রাইভিং , গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত , বিপরীত দিক থেকে মুখোমুখি সংঘর্ষ , নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে থাকা
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সড়ক


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ