বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
সত্য, সততা, সত্যবাদিতা এগুলো সমর্থক শব্দ। তার বিপরীতে আছে অসত্য, মিথ্যা, মিথ্যাবাদীতা, মিথ্যাচার ইত্যাদি শব্দ। আরো বিশ্লেষণে না গিয়ে সংক্ষেপে বলা যায়, এর অসংখ্য শ্রেণি বিভাগের মধ্যে মানব সমাজে সর্বত্র বহুল প্রচলিত ও ব্যাপক পরিচিত কয়েকটি হচ্ছে যেমন, জাল-জালিয়াতি, ভেজাল, ধোকাবাজি, প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, বিশ্বাসঘাতকতা, শঠতা (মোনাফিক) অঙ্গীকার ভঙ্গ ইত্যাদি আরো নানা শব্দ। অপরাধ জগতে এগুলো মানুষের চারিত্রিক দোষের সমষ্টি, এক কথায় পাপাচার।
সকল পাপাচারের গুরু ঠাকুর অভিশপ্ত ইবলিশ শয়তান। মনুষ্য জাতি হতে সে তার ভক্ত, অনুসারী ও দোসর নির্বাচিত করে থাকে এবং অপরাধ কর্মসাধন-সম্পাদনের জন্য প্ররোচিত করে (ইউওয়াস ভিসু ফি সুদুরিন্নাস) এবং নিজে নিরাপদ স্থানে সরে থাকে। প্ররোচিত ও প্রতারিত হয়ে তার মনুষ্য দোসররা যখন তখন অপরাধিকে সাধুবাদ জানায়। আর বেচারা মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হয়, ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়। তখন তার করার কিছু থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়ে।
শরাব বা মদকে বলা হয় ‘উম্মুল খাবায়েস’ অর্থাৎ অনাচারের জননী-মূল। তেমনি মিথ্যা-মিথ্যাচার বহু অপরাধ-পাপাচারের জন্ম দিয়ে থাকে নানা ভাবে। ইবলিশ যেহেতু মিথ্যাবাদী তাই সে চাইবে তার দোসর শ্রেণির মানুষকে তারই চরিত্রে চরিত্রবান করতে। মানুষ না বুঝে চিন্তা-ভাবনা না করে শয়তানি খপ্পরে পতিত হয় এবং ধ্বংসও হয়। যারা সত্যসন্ধানী তারা শয়তানি প্ররোচনা হতে দূরে অবস্থান করে এবং তার কুমন্ত্রণা হতে রক্ষা পায়।
এ কারণেই মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘আস সিদকু ইউনজি, ওয়াল কিজবু ইউহলিকু’। অর্থাৎ সত্য রক্ষা করে এবং মিথ্যা ধ্বংস করে। সত্যবাদিতা ও মিথ্যাচারিতা সম্পর্কে ইসলাম ঘোষিত এ নীতি অনুসৃত হলে সমাজ ও জাতীয় জীবন হতে পাপাচার একেবারে বিলীন না হলেও অনেক হ্রাস পেতে পারে। কেননা মিথ্যাচার অনেক অপরাধ-পাপাচারের জন্ম দিয়ে থাকে। মিথ্যাচার নির্মূল করা গেলে বহু পাপ কর্ম এমনিই বন্ধ হয়ে যাবে। এর একটি জলন্ত উদাহরণ মহানবী (সা.) এর জীবনে একটি ঘটনা হতে উপলব্ধি করা যায়। একটি মিথ্যা ত্যাগ করার ফলে বহু প্রকারের অপরাধ কিভাবে পরিত্যক্ত হয়েছিল, সে বিখ্যাত ঘটনাটি সীরাত গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত হয়েছে। ঘটনাটি নিম্নরূপ :
একবার রসূলুল্লাহ (সা.) এর খেদমতে এক হাবশী (আবেসিনীয়) এসে নিঃসংকোচে আবেদন জানায়, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার মধ্যে বহু মন্দ কাজ বিদ্যমান, সেগুলো আমি এক সাথে ত্যাগ করতে পারব না। আপনি যদি আমাকে যে কোনো একটি মন্দ কাজ পরিহার করার উপদেশ প্রদান করেন, তাহলে আমি তা দ্রুত ত্যাগ করব।’ হুজুর (সা.) বললেন : ‘তুমি সর্বদা সত্য কথা বলবে।’ হাবশী সর্বাবস্থায় সত্য কথা বলার ওয়াদা করে চলে যায়।
রাতে যখন অভ্যাস মতো সে চুরি করার উদ্দেশ্যে বের হয়, তখন তার মনে হলো যে, হুজুর (সা.) যদি জিজ্ঞাসা করেন, রাতে তুমি কোথায় ছিলে? তখন আমি কি জবাব দেব, সত্য কথা বলার ওয়াদা করে এসেছি। এ জন্য বাধ্য হয়ে আমাকে ভরা মজলিসে চুরি করার ঘটনা বর্ণনা করতে হবে, যাতে লোকদের মধ্যে আমার অপমান হবে। এ জন্য সে এই ভয়ে যে, ভরা মজলিসে চুরি করার কথা স্বীকার করতে হবে, তাই সে রাতে চুরি করতে যায়নি।
দ্বিতীয় দিন শরাবখানার দিকে যাওয়ার জন্য তার লোভ হয়। কিন্তু দ্রুতই তার খেয়াল হলো যে, হুজুর (সা.) যদি প্রশ্ন করেন, আজ তুমি কোথায় ছিলে? তখন স্বীকার করতে হবে যে, আমি শরাবখানায় গিয়েছিলাম, যার ফলে সমগ্র মজলিসে আমার বেইজ্জতি হবে। তাই সে স্থির করে যে, এরূপ অপমান হতে শরাবখানা না যাওয়াটাই হবে উত্তম। এ কথা ভেবে সে দ্রæত সেখান থেকে প্রস্থান করে।
এ দুটি ঘটনায় হাবশী মিথ্যার আশ্রয় না নিয়ে সত্য বলার ওয়াদা করার কথা স্মরণ করে দু’টি মহা পাপে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকে। অতঃপর সে আরো যে সব মন্দ কাজে অভ্যস্ত ছিল সেগুলো আস্তে আস্তে ত্যাগ করতে থাকে। সে রসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রথম সাক্ষাতে সত্য কথা বলার যে অঙ্গীকার করেছিল, যথাযথভাবে সে তা পালন করতে থাকে এবং এক সময় সে তার মন্দ অভ্যাসগুলো হতে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে যায়। অতঃপর সে হুজুর (সা.) এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে তাঁর শোকরিয়া আদায় করে এবং খাঁটি মনে সকল মন্দ কাজ-পাপাচার হতে তওবা করে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।