ব্যর্থতার ভিতে গড়ে তুলতে হবে সাফল্যের সুউচ্চ মিনার
আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে স্বাধীনতা দিবসের ক্রোড়পত্রে প্রকাশের জন্যে দৈনিক ইনকিলাবের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে
বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিপন্ন হতে পারে তিনভাবে। এক. সাম্রাজ্যবাদী কোনো শক্তি স¤প্রসারণলালসায় আক্রমণ করে বসলে। দুই. দেশের অভ্যন্তরে সৃষ্ট অরাজকতা ও অত্যাচারে কোনো বহিঃশক্তি নিপীড়িত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসে দেশ দখল করে নিলে। তিন. দেশে এমন মতবাদের লোক থাকতে পারে, যারা ওই মতবাদ প্রতিষ্ঠার অভিলাষে বাইরের কোনো শক্তিকে আমন্ত্রণ জানালে।
বাংলাদেশ নিকট প্রতিবেশীসহ পৃথিবীর সকল দেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার নীতিতে বিশ্বাসী। অন্য দেশের প্রতি তার লোলুপদৃষ্টি নেই, অপর কোনো শক্তি এ দেশ করায়ত্ত করুক, এও তার কাম্য নয়।
দেশের অভ্যন্তরে অরাজকতা ও নিপীড়ন চললে সাহায্যে এগিয়ে আসা ও বিপদমুক্ত করে ফিরে যাওয়ার ইতিহাসে একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের উদারতা প্রশংসনীয়। সেদিন এই শক্তি ফিরে না গেলে নিশ্চয়ই বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতো। বিশেষ কোনো মতবাদে দেশ গড়ার লক্ষ্যে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় বিপ্লব ঘটানোর দম্ভোক্তি শোনা গিয়েছিল। এমন পরিস্থিতি পরিণামে কী শোচনীয় বিপর্যয় আনতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ আফগানিস্তান।
স্বাধীনতা রক্ষায় অংশগ্রহণ ইসলামী বিধানে শিশু, অসুস্থ নারী ছাড়া সবার জন্য বাধ্যতামূলক। কাজেই সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব সমধিক হলেও বেসামরিক নাগরিককে দেশরক্ষায় সদাসর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে। অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র বা বহিঃশত্রুর আক্রমণ যে পথেই দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন হোক, তার মোকাবেলা করতে হবে।
আল্লাহ পাকের ঘোষণা: ‘তোমাদের সাথে যারা যুদ্ধ করতে আসে তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করো। এই যুদ্ধ হবে আল্লাহর পথে, আর এ ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করো না (অর্থাৎ ইসলামী বিধান অমান্য করো না)’। (সূরা বাকারা) ইসলামের হিফাজত ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় এই হুকুম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফিকাহ শাস্ত্রের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বাদায়ায়েছ ছানায়ে’ বিশিষ্ট ইমাম আলাউদ্দীন আবু বকর ইবনে মাসউদ আলফেসানী বলেন: ‘দেশ শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে এই ঘোষণার সাথে সাথে সবার উপর যুদ্ধে অংশগ্রহণ ফরজে আইন তথা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে।’ এই দৃষ্টিতে মুসলিম সমাজের সকল নাগরিককে যুদ্ধের প্রয়োজনীয় ট্রেনিং প্রদান করা অপরিহার্য। বাংলাদেশে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিএনসিসির কার্যক্রম আরো ব্যাপক হওয়া প্রয়োজন। আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর কার্যক্রম আরো বিস্তীর্ণ হওয়া উচিৎ।
দেশের প্রতিরক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়ায় কুরআনের আহবান: ‘হে ঈমানদার লোকেরা। জিহাদের জন্য তোমরা অস্ত্রধারণ করো। অতঃপর ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে অথবা সবাই সম্মিলিতভাবে রওয়ানা হও এবং (শত্রুর উপর) ঝাঁপিয়ে পড়ো।’ (সূরা নিসা) ‘হে বিশ্বাসীগণ! জিহাদের কঠিন মুহূর্তে তোমরা ধৈর্য ধারণ করো। দুশমনের মোকাবেলায় তোমরা দৃঢ়, অটল ও অবিচল থাকো। তোমরা সীমান্ত প্রহরার ব্যবস্থা করো। আল্লাহকে ভয় করো। তোমরাই সফলকাম হবে।’ মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন: ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়ার কামনায় একদিনের সীমান্ত পাহারা পৃথিবীর ও এর সমুদয় সম্পদের চাইতে অধিক মূল্যবান।’
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিষয়ে ইসলামী বিধান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সূরা আনফালে আল্লাহ বলেন: ‘সামর্থ্যে ও উপকরণে যতদূর সম্ভব অধিক দক্ষতা, শক্তি ও ঘোড়া দুশমনের সাথে যুদ্ধ করার জন্য সদা প্রস্তুত রাখবে। যেন ঐগুলোর কারণে আল্লাহর শত্রু, তোমাদের শত্রু যাদেরকে তোমরা জানো না, আল্লাহ জানেন, তারা ভীত ও সন্ত্রস্ত থাকতে পারে। আল্লাহর পথে তোমরা যা কিছু ব্যয় করবে তার পূর্ণ প্রতিদান প্রদান করা হবে; তোমাদের প্রতি কোনো জুলুম করা হবে না।’
সেনাবাহিনীকে আল্লাহভীরু মর্দে মুজাহিদ হতে হবে। রোমান সেনাবাহিনীর সাথে মুসলিম বাহিনীর যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধে রোমক সৈন্যের অবস্থা শোচনীয়। এমন সময় রোমান সেনাপতি গোয়েন্দা পাঠালেন ছদ্মবেশে মুসলিম বাহিনীর বীরত্বের মূল রহস্য জানতে। গোয়েন্দারা ফিরে গিয়ে জানাল: ‘হুন বিল লাইলে রুহবানুন ওয়া বিন নাহারে ফুরসানুন- অর্থাৎ মুসলিম সৈন্যরা রাত্র বেলায় তাদের উপাস্য আল্লাহভক্ত বান্দা হিসেবে ইবাদতে কাটায়। আর দিনে অশ্বারোহী হয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে।’ এই চরিত্রে বাংলাদেশের সকল সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের উজ্জীবিত হতে হবে। সেনাবাহিনীসহ দেশের সবাইকে আল্লাহর উপর গভীর আস্থা রেখে দেশে শান্তিশৃৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে।
আল্লাহ ইরশাদ করেন: ‘সাহায্য শুধু আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে’। অর্থাৎ আল্লাহপাক যদি তোমাদের সাহায্য করেন, তবে তোমাদের উপর দুনিয়ার কোনো শক্তিই বিজয়ী হতে পারবে না। আর যদি আল্লাহ তোমাদের তাঁর সাহায্য থেকে বঞ্চিত রাখেন, তবে কে আর তোমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে? ‘তোমরা পরস্পর কলহ-দ্ব›দ্ব বিভেদ সৃষ্টি করো না, মনে রেখো, যদি তোমাদের মধ্যে ঐক্য না থাকে তবে তোমাদের সম্পর্কে দুশমনের মনে যে ভীতি ছিল, তা থাকবে না।’ ‘ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর বিধানকে সুদৃঢ়ভাবে অনুসরণ করো; দলাদলি করো না।’ কুরআন শরিফে আল্লাহ আরো ঘোষণা করেন: ‘বলিষ্ঠ ঈমানে উজ্জীবিত হলে তোমরা ১০০ লোক এক হাজার কাফেরের উপর জয়ী হতে পারবে।’ ‘উচ্চস্তরের ঈমান ও ধৈর্য থাকলে দশগুণ বেশি দুশমনের ওপর মুসলমানরা বিজয়ী হতে পারবে।’
শুধু সেনাবাহিনী নয়, দেশের সকল মানুষের মধ্যে একটি উজ্জ্বল আদর্শের আলো থাকতে হবে। এই মৌল আকিদা নিশ্চিত করার মাধ্যমেই শক্তিশালী দেশ তথা বলিষ্ঠ প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তোলা সম্ভব। এ ব্যাপারে একদিকে যেমন সামরিক, আধা সামরিক, সকল পর্যায়ের অফিসার, কর্মচারী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও জাগ্রত ছাত্র সমাজকে কুরআনি আদর্শ ও মহানবী (সা.) এর কর্মবহুল বাস্তব জীবন ইতিহাসের সাথে পরিচিত করে তুলতে হবে, তেমনি মনে রাখতে হবে, যুদ্ধজয়ের জন্য সমর উপকরণই শেষ কথা নয়, সামরিক উপায়-উপকরণ নিশ্চয়ই প্রয়োজন। কিন্তু সবচেয়ে বেশি দরকার আত্মবিশ্বাস, দৃঢ় মনোবল, কঠোর সংকল্প, আল্লাহর প্রতি সুগভীর বিশ্বাস, জীবন-মৃত্যু সম্পর্কে সুষ্পষ্ট ধারণা। এই বিশ্বাসে সবাইকে সুদৃঢ় হতে হবে। আদর্শিক মজবুতি থাকলে এবং সেই সাথে উপযুক্ত রণসম্ভার, নির্ভুল ও যোগ্য নেতৃত্ব, ট্রেনিং এবং দেশের অভ্যন্তরে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকলে দেশের স্বাধীনতাকে কেউ ধ্বংস করতে পারবে না। বস্তুত দেশপ্রেম, দেশের স্বাধীনতার মূল্য এবং এ বিষয়ে নাগরিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে কুরআন-হাদিস এবং ইসলামের ইতিাহসের উল্লেখ্য ঘটনা জানা থাকলে বাংলাদেশের মানুষ স্বধীনতা রক্ষায় সত্যিকার পথ নির্দেশ পাবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।