Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

হাদিসের আলোকে মিরাজুন্নবী-১

মাওলানা মুহাম্মাদ ত্বহা হুসাইন | প্রকাশের সময় : ১১ মার্চ, ২০২১, ১২:০০ এএম

হিজরতে মদীনার আগের কথা। বাধা আর সফলতার মাঝে এগিয়ে চলছিল ইসলামের অগ্রযাত্রা। কাফির-মুশরিকদের ঠাট্টা-বিদ্রুপ আর অকথ্য নির্যাতনে শাণিত হচ্ছিল মু‘মিনের ঈমান, জ্বলে উঠছিল মুসলমানের দ্বীনী জযবা। এমনি সময়ে কোনো এক রাতে নবীজী (সা.) সাহাবীদের নিয়ে এশার নামাজ আদায় করলেন। অতঃপর খানায়ে কাবা সংলগ্ন ‘হাতীমে’ শুয়ে বিশ্রাম নিতে লাগলেন। এই সেই ‘হাতীম’, যা এক সময়ে খানায়ে কাবারই অংশ ছিল। মক্কার কাফেররা গুরুত্বপূর্ণ কাজে এখানে সমবেত হতো, পরস্পর শপথ ও মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হতো। সঙ্কটাপন্ন মুহূর্তে দুআর জন্য প্রসারিত করত দু’হাত। মক্কার সর্দারেরা এখানে প্রায়ই বিন্রাম নিত। নবীজীও মাঝে মাঝে আরাম করতেন।

ওই রাতেও নবীজী সেখানে তন্দ্রাবিষ্ট ছিলেন; নিদ্রা তখনও আসেনি। আর নবী-রাসূলগণের নিদ্রা তো এমনই হয়; চোখ দুটো তাঁদের মুদে এলেও ক্বলব থাকে সতত জাগ্রত। জিবরীল আমীন আ. নেমে এলেন। নবীজীকে জাগ্রত করলেন। অতঃপর তাঁকে নিয়ে গেলেন আবে যমযমের নিকটে। তাঁর বক্ষের অগ্রভাগ হতে চুল পর্যন্ত বিদীর্ণ করা হলো। বের করা হলো তাঁর হৃৎপিন্ড। তা আবে যমযম দ্বারা শোধন করা হলো। ঈমান ও প্রজ্ঞায় ভরপুর স্বর্ণের একটি পেয়ালা এনে তা দিয়ে ভরে দেয়া হলো নবীজীর বক্ষ মুবারক। অতঃপর হৃৎপিন্ড যথাস্থানে রেখে দিয়ে উপরিভাগ সেলাই করে দেয়া হলো। হযরত আনাস রা. বলেন, আমি এর চিহ্ন নবীজীর বুকে প্রত্যক্ষ করেছি।

‘বুরাক’ নামক ক্ষিপ্রগতির একটি সওয়ারী আনা হলো, যা ছিল গাধার চেয়ে বড় ও খচ্চরের চেয়ে ছোট এবং দীর্ঘদেহী। রঙ ছিল শুভ্র। এমনই ক্ষিপ্র ছিল তার চলার গতি যে, দৃষ্টিসীমার শেষ প্রান্তে গিয়ে পড়ত তার পায়ের খুর। তার পিঠের ওপর জিন আঁটা ছিল, মুখে ছিল লাগাম। নবীজী রেকাবে পা রাখবেন এমন সময় ‘বুরাক’ ঔদ্ধত্য দেখাল। জিবরীল তাকে থামিয়ে বললেন, হে বুরাক! তুমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করছ? তুমি কি জান, আল্লাহর কাছে তার চেয়ে মহান ও প্রিয়তম কোনো ব্যক্তি কখনও তোমার ওপর সওয়ার হয়নি। একথা শুনতেই বুরাক ঘর্মাক্ত হয়ে গেল। (তিরমিযী : ৩১৩১)।

অতঃপর নবীজী বুরাকে আরোহণ করলেন। মুহূর্তেই এসে উপস্থিত হলেন জেরুজালেম নগরীর বায়তুল মাকদিসে। জিবরীল একটি পাথর ছিদ্র করে বুরাককে বেঁধে রাখলেন। (প্রাগুক্ত : ৩১৩২)। এটা সেই বৃত্ত, যেখানে নবীগণও নিজেদের বাহন বেঁধে রাখতেন। (মুসনাদে আহমাদ : ২/৫২৮)।

বায়তুল মাকদিসে ঢুকে তিনি দেখেন, হযরত মূসা আ. নামাজরত আছেন। তিনি ছিলেন ছিপছিপে ও দীর্ঘ দেহের অধিকারী। তাঁর চুল ছিল কোঁকড়ানো, যা ছিল কান পর্যন্ত ঝুলন্ত। দেখে মনে হবে যেন ‘শানওয়া’ গোত্রেরই একজন লোক। হযরত ঈসা আ.-কেও দন্ডায়মান হয়ে নামাজ পড়তে দেখা গেল। তিনি ছিলেন মাঝারি গড়নের, সাদা ও লাল রঙবিশিষ্ট। তাঁর চুল ছিল সোজা ও চাকচিক্যময়। তাঁর আকার-আকৃতি সাহাবী উরওয়া ইবনে মাসউদ সাকাফী রা.-এর সাথে অধিক মেলে। হযরত ইব্রাহীম আ.-কেও নামাজরত অবস্থায় দৃষ্টিগোচর হলো। নবীজী বলেন, তাঁর দেহাবয়ব আমার সাথে অধিক সামঞ্জস্যশীল। (মুসলিম : ১৬৭)।

ইতোমধ্যে জামাত প্রস্তুত হলো। তিনি দু’রাকাত নামাজ আদায় করলেন। সকল নবী-রাসূল নবীজীর পেছনে ইক্তেদা করলেন। ওখান থেকে বের হয়েই দেখলেন, জিবরীল আ.-এর হাতে দু’টি সুদৃশ্য পাত্র। একটি শরাবের, অপরটি দুধের। পাত্র দু’টি পেশ করা হলে নবীজী দুধেরটিকেই বেছে নিলেন। এতদ্দর্শনে জিবরীল আ. তাঁকে বললেন, আপনি ও আপনার উম্মত স্বভাবজাত ফিত্রাতকেই বেছে নিয়েছেন। আপনি যদি শরাব পছন্দ করতেন, তাহলে আপনার উম্মত পথভ্রষ্ট হয়ে যেত। (প্রাগুক্ত : ১৬৮)।

এরপর শুরু হলো ঊর্ধ্বজগতের সফর। নবী কারীম (সা.) বুরাকের ওপরই ছিলেন। একে একে প্রতি আকাশের দ্বার তাঁর জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হলো। প্রথমে দুনিয়ার দৃশ্যমান আসমানে এসে জিবরীল আ. দ্বার উন্মুক্ত করতে অনুরোধ করেন। অপর প্রান্ত হতে প্রশ্ন হয়, কে আপনি? তিনি বললেন, আমি জিবরীল। প্রশ্ন করা হয়, কে আছেন আপনার সাথে? বললেন, মুহাম্মাদ। প্রশ্ন হয়, আপনি কি তাঁর কাছে প্রেরিত হয়েছেন? বললেন, হ্যাঁ।

অতঃপর প্রথম আসমানের দ্বার খুলে দেয়া হয়। তাঁরা এর উপরে উঠে আসেন। নবীজী বলেন, ওখানে এক ব্যক্তিকে দেখতে পেলাম, যার ডান দিকে রূহের একটি ঝাঁক দেখা গেল, বাম দিকেও তেমনি একটি ঝাঁক। ওই ব্যক্তি ডান দিকে তাকালে হাসেন আর বাম দিকে তাকালে ক্রন্দন করেন। তিনি আমাকে দেখে অভ্যর্থনা জানালেন এবং বললেন, মারহাবা হে মহান পুত্র! মারহাবা হে মহান নবী!!

নবীজী জিবরীলকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইনি কে? তিনি বললেন, তিনি আদম (আ.)। তাঁর ডান ও বাম দিকে যাদের দেখলেন তারা তাঁর আওলাদ। ডান দিকে যারা তারা জান্নাতী; আর বাম দিকে যারা তারা দোজখী। আর তাই তিনি ডান দিকে তাকিয়ে হাসেন এবং বাম দিকে তাকিয়ে কাঁদেন। (বুখারী : ৩৪৯)।



 

Show all comments
  • পারভেজ ১১ মার্চ, ২০২১, ২:৪৮ এএম says : 0
    বিশ্ব মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ ও সর্বজনীন জীবন ব্যবস্থা হিসেবে রূপ দেওয়ার জন্য তিনি বিশ্ব পালনকর্তা আল্লাহ্ পাক রাব্বুল আলামীনের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা পেয়েছিলেন মি’রাজ রজনীতে। এ জন্য এ রাতটি মুসলমানের জন্য অতীব গুর”ত্বপূর্ণ।
    Total Reply(0) Reply
  • হুমায়ূন কবির ১১ মার্চ, ২০২১, ২:৫০ এএম says : 0
    মেরাজ বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতের অনেক বড় একটি মুজিজা আর উম্মতে মুহাম্মাদির জন্য অনেক বড় একটি নেয়ামত।
    Total Reply(0) Reply
  • সোলায়মান ১১ মার্চ, ২০২১, ২:৫১ এএম says : 0
    মেরাজের আশ্চর্যজনক ও তৎপর্যপূর্ণ ঘটনায় বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মান ও উচ্চ মর্যাদাই প্রকাশ পেয়েছে। মেরাজের এ ঘটনায় বিশ্বাস স্থাপন করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য তার আক্বিদা-বিশ্বাসের অংশও বটে। মেজারে ঘটনায় মুসলিম উম্মাহর জন্য রয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
    Total Reply(0) Reply
  • নুরজাহান ১১ মার্চ, ২০২১, ৩:০১ এএম says : 0
    পৃথিবীর ইতিহাসে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টিকারী যুগান্তময়ী ঘটনা ‘মিরাজ’।
    Total Reply(0) Reply
  • সাইফুল ইসলাম ১১ মার্চ, ২০২১, ৩:০৩ এএম says : 0
    মহানবী (সা.)-এর আসরা ও মিরাজ কোনও অবস্থাতেই আত্মিক বা স্বপ্নযোগে ছিল না। ছিল সজাগ, সজ্ঞানে ও সশরীরে, যা কোরআন-হাদিস ও ঐতিহাসিকদের বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসলাম

৩ মার্চ, ২০২৩
২ মার্চ, ২০২৩
১ মার্চ, ২০২৩
২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন