Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পরকালে আফসোস করবে যারা

মুফতি আমিরুল ইসলাম লুকমান | প্রকাশের সময় : ৪ মার্চ, ২০২১, ১২:০১ এএম

ঈমান এই পৃথিবীর সবচে দামী সম্পদ। ঈমানবিহীন জীবন অন্ধকার জীবন, ঘৃণিত জীবন। আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদেরকে ঈমান দ্বারা মর্যাদাবান করেছেন। হাদিসের ভাষ্যানুযায়ী দুনিয়া হলো আখেরাতের শস্যক্ষেত্র। পরকালের সঞ্চয় ও পাথেয়রূপে যা কিছু অর্জনের প্রয়োজন এখান থেকেই সংগ্রহ করতে হবে। জীবনপ্রদীপ স্তিমিত হয়ে যাওয়ার পর অর্জনের কোনো উপায় অবশিষ্ট থাকবে না। বুদ্ধিমান তিনি, যিনি দুনিয়ার জীবন পুরোটাই পাথেয় অর্জনের পেছনে ব্যয় করেছেন। ভীষণরকম গোনাহগার ব্যক্তিও যদি ঈমানসমৃদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন, তাহলে জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তি থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত তিনি একদিন হবেনই। কিন্তু যদি ঈমানহারা অবস্থায় শেষনিশ^াস ত্যাগ করতে হয়, তাহলে কোনোকালেই মুক্তির সনদ লাভের সামান্য সম্বলও তিনি নিয়ে যেতে পারলেন না। পরকালের জীবনে আফসোস-বিলাপ ব্যতীত আর কিছুই তার থাকলো না।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বস্তুত আমি এক আসন্ন শাস্তি সম্পর্কে তোমাদেরকে সতর্ক করে দিলাম, সে দিন প্রত্যেক ব্যক্তি তার স্বহস্তে সামনে পাঠানো কর্মসমূহ প্রত্যক্ষ করবে আর কাফের ব্যক্তি বলবে, হায় আফসোস! আমি যদি মাটি হয়ে যেতাম!’ (সুরা নাবা: ৪০)

হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, কেয়ামতের দিন সমগ্র ভূপৃষ্ঠ এক সমতল ভূমি হয়ে যাবে। এতে মানব, জিন, গৃহপালিত জন্তু ও বন্য জন্তু সবাইকে একত্রিত করা হবে। জন্তুদের মধ্যে কেউ দুনিয়াতে অন্য জন্তুর উপর জুলুম করে থাকলে তার কাছ থেকে প্রতিশোধ নেয়া হবে। এমনকি কোন শিংবিশিষ্ট ছাগল কোন শিংবিহীন ছাগলকে মেরে থাকলে সে দিন তারও প্রতিশোধ নেয়া হবে। এই কর্ম সমাপ্ত হলে সব জন্তুকে আদেশ করা হবে, মাটি হয়ে যাও। তখন সব মাটি হয়ে যাবে। এই দৃশ্য দেখে কাফেররা আক্ষেপ করবে- হায়! আমরাও যদি মাটি হয়ে যেতাম! এরূপ হলে আমরা হিসাব-নিকাশ ও জাহান্নামের আজাব থেকে বেঁচে যেতাম। (মাআরিফুল কুরআন: ১৪৩৩)

অপর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘সে দিন জাহান্নামকে সামনে আনা হবে, সে দিন মানুষ বুঝতে পারবে, কিন্তু সেই সময় বুঝে আসার কী ফায়েদা? সে বলবে, হায় আফসোস! আমি যদি আমার এ জীবনের জন্য কিছু অগ্রীম পাঠাতাম! সে দিন আল্লাহর সমান শাস্তিদাতা কেউ হবে না।’ (সুরা ফজর: ২৩-২৫)

কাফের মানুষ সেদিন বুঝতে পাারবে যে, দুনিয়াতে তার কী করা উচিত ছিলো আর সে কী করেছে। কিন্তু তখন এই বুঝে আসা নিষ্ফল হয়ে যাবে। কেননা, পরকাল কর্মজগত নয়- প্রতিদান জগত। অত:পর কাফেররা এই অভিলাষ ব্যক্ত করবে যে, হায়! আমি যদি দুনিয়াতে কিছু সৎকর্ম করতাম! কিন্তু কুফর ও শিরকের শাস্তি সামনে এসে যাওয়ার পর এ আকাক্সক্ষায় কোন লাভ নেই। এখন আযাব ও পাকড়াওয়ের সময়। আল্লাহ তায়ালার পাকড়াওয়ের মত কঠিন পাকড়াও কারও হতে পারে না। (মাআরিফুল কুরআন: ১৪৫৬)

আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র বলেন, ‘সে দিন জালেম ব্যক্তি (মনস্তাপে) নিজের হাত কামড়াবে আর বলবে, হায় আফসোস! আমি যদি রাসুলের সাথে একই পথ অবলম্বন করতাম! হায় আমার দুর্ভোগ! আমি যদি অমুক ব্যক্তিকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম! আমার কাছে তো উপদেশ এসে গিয়েছিল, কিন্তু সে (ওই বন্ধু) আমাকে তা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল।’ (সুরা ফুরকান: ২৭-২৯)

আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার বিশেষ প্রেক্ষাপট হলো, ওতবা ইবনে আবি মুয়িত নবি করীম (সা.)কে পরিত্যাগ করে বিখ্যাত কাফের নেতা উবাই ইবনে খালফকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছিল। এবং নবি করীম (সা.)কে অপমান করেছিল। উক্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে নাজিল হলেও আয়াতটির ভাষা ও বিধান ব্যাপক। যে দুই বন্ধু পাপ কাজে সম্মিলিত হয় এবং শরীয়তবিরোধী কার্যাবলীতে একে অপরের সাহায্য করে, তাদের সবারই বিধান এই যে, কেয়ামতের দিন তারা এই বন্ধুত্বের কারণে শাস্তি ভোগ করবে, কান্নাকাটি করবে। হাদিস শরিফে কোন অমুসলিমকে সঙ্গী না করার এবং ধন সম্পদ যেন অমুসলিম ও গোনাহগার বন্ধু না খেয়ে পরহেযগার ব্যক্তিই খায় সে ব্যাপারে নির্দেশ আছে। নবি করীম (সা.) এক উত্তরে যাকে দেখে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়, যার কথাবার্তায় জ্ঞান বাড়ে এবং যার কাজ দেখে পরকালের স্মৃতি তাজা হয়, এমন ব্যক্তিকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতে আদেশ করেছেন। (মাআরিফুল কুরআন: ৯৫৯)

অন্য আয়াতে এসেছে, ‘যেদিন অগ্নিতে তাদের মুখমন্ডল ওলট পালট করা হবে, সেদিন তারা বলবে, হায় আফসোস! আমরা যদি আল্লাহর আনুগত্য করতাম ও রাসুলের আনুগত্য করতাম।’ (সুরা আহজাব: ৬৬)

অপর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘আর আপনি যদি দেখেন, যখন তাদেরকে দোজখের উপর দাঁড় করানো হবে! তারা বলবে, কতই না ভালো হত, যদি আমরা পুন: প্রেরিত হতাম! তা হলে আমরা স্বীয় পালনকর্তার নিদর্শনসমূহে মিথ্যারোপ করতাম না। এবং আমরা বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম।’ (সুরা আনআম: ২৭)

এই আয়াতে অবিশ^াসী, অপরাধীদের অবস্থা বর্ণনা করে বলা হয়েছে, পরকালে যখন তাদেরকে দোজখের কিনারায় দাঁড় করানো হবে এবং তারা কল্পনাতীত ভয়াবহ শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে, তখন তারা আফসোস প্রকাশ করে বলবে, আমাদেরকে পুনরায় দুনিয়াতে প্রেরণ করা হলে আমরা পালনকর্তা প্রেরিত নিদর্শনাবলী ও নির্দেশনাবলীকে মিথ্যারোপ করতাম না, বরং এগুলো বিশ্বাস করে ইমানদারদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যেতাম। পরবর্তী আয়াতে তাদের আফসোসের রহস্য উন্মোচন করে বলা হয়েছে, এরা চিরকালই মিথ্যায় অভ্যস্ত। আসল ব্যাপার হলো, পয়গম্বরের মাধ্যমে যেসব বাস্তব সত্য তাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছিল এবং তারা তা জানা ও চেনা সত্ত্বেও শুধু হঠকারিতা বা লোভ লালসার বশবর্তী হয়ে এসব সত্যকে পর্দায় আবৃত রাখার চেষ্টা করত। (মাআরিফুল কুরআন: ৩৭৪)

উপরোক্ত আয়াত ও তাফসির থেকে প্রমাণিত হলো, ঈমানবিহীন জিন্দেগীর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। ফলে ঈমানের শক্তি ও মাত্রা কীভাবে আমাদের জীবনে পূর্ণতা পায়, সে বিষয়ে যত্নবান বান হওয়া অত্যাবশ্যক। সাহাবায়ে কেরাম ও তাঁদের পরবর্তী সোনালি প্রজন্ম যেমনভাবে ঈমান হেফাজত ও রক্ষার জন্য সদা সচেষ্ট থেকেছেন, আমাদেরকেও তেমন সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে, এমন কোনো কাজ, কথা কখনোই আমাদের থেকে যেন প্রকাশ না পায় সে ব্যাপারে সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে। ঈমানের ভেতর কোনো প্রকার ত্রুটি ও দূর্বলতা সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ কোনোক্রমেই দেয়া যাবে না। আল্লাহ তায়ালা তৌফিক দান করুন।
লেখক: খতিব, আল মক্কা জামে মসজিদ হরপাড়া, শ্রীনগর, মুন্সিগঞ্জ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ