বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
হাদীসের যে কোনো কিতাব হাতে নিন। বিশেষ করে কুতুবে সিত্তা; সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ, জামে তিরমিযী, সুনানে নাসায়ী ও সুনানে ইবনে মাজাহ এই সকল কিতাবের যে কোনোটি হাতে নিন, তাতে একটি অধ্যায় পাবেন কিতাবুল আদব বা আদব অধ্যায়। এই অধ্যায়ের বিষয়বস্তু কী? এই অধ্যায়ে মুহাদ্দিসগণ রাসূলে কারীম (সা.)-এর যেসকল হাদীস সংকলন করেছেন তা মৌলিকভাবে দু’টি বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত। এক. স্বভাব-চরিত্র। দুই. আচার-আচরণ। তাহলে হাদীসের কিতাব থেকে, রাসূলে কারীম (সা.)-এর হাদীস ও সীরাত থেকে জীবনের যেসব অধ্যায়ে আলো গ্রহণের প্রয়োজন তন্মধ্যে সদাচার, সম্পর্ক রক্ষা, আচার-আচরণ, স্বভাব-চরিত্র ইত্যাদিও শামিল। শুরু থেকেই আমাদের মুহাদ্দিসগণ এ সংক্রান্ত হাদীস ও আছার সংকলন করে এসেছেন।
সহীহ মুসলিম শরীফে ‘কিতাবুল বিররি ওয়াসসিলাহ’য় (সদাচার ও সম্পর্ক রক্ষা অধ্যায়ে) একটি অনুচ্ছেদ আছে-যার অর্থ, ‘হাসিমুখে সাক্ষাৎ কাম্য ও পছন্দনীয় হওয়া।’ সহীহ মুসলিমের এই অনুচ্ছেদ-শিরোনামগুলো ইমাম মুসলিম রাহ. দেননি; এসব শিরোনাম দিয়েছেন সহীহ মুসলিমের বিখ্যাত ভাষ্যকার ইমাম নববী রাহ.। এই শিরোনামে হযরত আবু যর গিফারী রা.-এর ঐ হাদীস উল্লিখিত হয়েছে যে, আমাকে আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন: ‘কোনো ভালো কাজকে সামান্য মনে করো না, যদিও তা হয় তোমার ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ।’
এই হাদীসে একজন মুসলিমের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎকেও ‘মারূফ’ ও ভালো কাজ বলা হয়েছে এবং এই ভালো কাজের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। স্বয়ং আল্লাহর রাসূল (সা.) তাঁর প্রিয় সাহাবীকে এই বিষয়ে উৎসাহিত করেছেন। তাহলে ধর্মীয় দিক থেকে একজন মুসলিমের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ কাম্য।
আমরা বিভিন্ন সময় ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত, মুস্তাহাব, মুস্তাহসান এই সকল পরিভাষা শুনে থাকি। শরীয়তের বিভিন্ন বিধানের পর্যায় ও গুরুত্ব বোঝাবার জন্য এই পরিভাষাগুলো ব্যবহৃত হয়। এই কাজটি ফরয, এই কাজটি ওয়াজিব, এই কাজটি সুন্নত, এই কাজটি মুবাহ, ইত্যাদি বিভিন্ন পরিভাষার মাধ্যমে শরীয়তে ঐ বিষয়টির বৈধতা ও কাম্যতার পর্যায় বোঝানো হয়ে থাকে। আমরা এই সকল বিষয়কে ধর্মীয় বিষয় মনে করি।
যেমন আমরা বলি, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ফরয। আমরা মনে করি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ধর্মীয় কাজ। আর ধর্মীয় বিধানের দিক থেকে তা অপরিহার্য। এটা আদায় করতেই হবে, ছাড়া যাবে না। এরকম বিভিন্ন কাজকে আমরা ওয়াজিব বলি, সুন্নত বলি, মুস্তাহাব বলি। এগুলোকে আমরা ধর্মীয় কাজ মনে করি। এই যে ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাব- এগুলোর গন্ডিও অনেক বিস্তৃত। সচরাচর আমরা যেসকল কাজকে ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাব মনে করি এর বাইরেও অনেক ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাব আছে। আমাদের লেনদেন ও সামাজিক জীবনের অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলো ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাবের পর্যায়ভুক্ত। তেমনি স্বভাব-চরিত্র ও আচার-আচরণগত অনেক বিষয় আছে, যা ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত-মুস্তাহাবের অন্তর্ভুক্ত।
ইমাম মুসলিম রহ. হযরত আবু যর গিফারী রা.-এর যে হাদীসটি এনেছেন এই হাদীসের ওপর সহীহ মুসলিমের ভাষ্যকার ইমাম নববী রাহ., যিনি অনেক বড় ফকীহ ও মুহাদ্দিস ছিলেন। শিরোনাম দিয়েছেন : ‘হাসিমুখে সাক্ষাৎ কাম্য ও মুস্তাহাব হওয়া’। তাহলে হাসিমুখে সাক্ষাৎও একটি ধর্মীয় কাজ। দেখুন, এটা ইসলামের এক অনুপম বৈশিষ্ট্য। ইসলামী শরীয়ত মানুষের জীবনের প্রতিটি আচরণের ওপর ধর্মীয় বিধান আরোপ করেছে। মানব-জীবনের কোনো আচরণ এমন নেই, যে সম্পর্কে ফরয, ওয়াজিব, মুস্তাহাব, মুবাহ, মাকরূহ, হারাম ইত্যাদি বিধান আরোপিত হয় না।
তাহলে এটাও জানা গেল যে, ধর্মীয় কাজ আমরা যতটা সীমাবদ্ধ মনে করি ততটা সীমাবদ্ধ নয়। শুধু নফল নামাজ পড়াই ধর্মীয় কাজ নয়। নিঃসন্দেহে নফল নামাজ পড়া অনেক বড় ধর্মীয় কাজ। দান-সদকা করা অনেক বড় ধর্মীয় কাজ। একইভাবে একজন মুসলিমের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করাও একটি ধর্মীয় কাজ। একটি মুস্তাহাব ও পছন্দনীয় আমল। রাসূলে কারীম (সা.)-এর একটি সুন্নাহ। প্রিয় সাহাবী হযরত আবু যর গিফারী রা.-কে তিনি এ বিষয়ে উৎসাহিত করেছেন।
এ হাদীসে মুসলিম ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ হচ্ছে একটি উদাহরণ। আল্লাহর রাসূল একটি মূলনীতি উল্লেখ করে এই বিষয়টি উদাহরণ হিসেবে এনেছেন। মূলনীতিটি হচ্ছে, ‘তুমি কোনো ভালো কাজকেই সামান্য মনে করো না।’ এটা করণীয় সম্পর্কে এক বড় মূলনীতি। কোনো ভালো কাজকে সামান্য মনে করে ত্যাগ করো না। এটা যদি আমরা ভালোভাবে বুঝি তাহলে অনেক রকমের বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হতে পারি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।