হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মুনশী আবদুল মাননান
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির বাংলাদেশ সফর নিয়ে নানামুখী আলোচনা-বিশ্লেষণ হচ্ছে। রাজনীতিক, কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক বিশ্লেষক সবাই এই সফরকে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ বলে অভিমত দিয়েছেন। পর্যালোচনা-মূল্যায়নে প্রত্যেকের স্ব স্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন থাকলেও সফরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে দ্বিমত নেই। ১০ ঘণ্টারও কম সময়ের এই সফরকালে জন কেরি অত্যন্ত ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেন। ঢাকায় নামার পরপরই তিনি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। বঙ্গবন্ধু জাদুঘর ঘুরে দেখেন। পরিদর্শন বইয়ে মন্তব্য লেখেন। এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে পদ্মায় মিলিত হন আনুষ্ঠানিক আলোচনায়। পরে ইএমকে সেন্টারে নাগরিক সমাজ, তরুণ ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের উদ্দেশে ভাষণ দেন ও মতবিনিময় করেন। ঢাকা ত্যাগের আগে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের চেন্সরি কমপ্লেক্সে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন।
জন কেরি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গনে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং একই সঙ্গে সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। প্রভাব ও ক্ষমতার দিক দিয়ে তিনি মার্কিন প্রশাসনের দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে অভিহিত হয়ে থাকেন। বাংলাদেশে তার আসা নিঃসন্দেহে একটি বড় ঘটনা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আসন্ন। এই সঙ্গে বিশ্ব পরিস্থিতিও এ মুহূর্তে অত্যন্ত জটিল ও উত্তেজনাপূর্ণ। এ সময় জন কেরির ব্যস্ততা সহজেই অনুমেয়। এরপরও যে তিনি সংক্ষিপ্ত হলেও বাংলাদেশ সফরে আসেন, সেটা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের বিশেষ গুরুত্বের প্রমাণ বহন করে। এটা বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্যেরও একটা বড় নজির বলে মনে করেন অনেকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মার্কিন প্রশাসনের অনেক বড় কর্মকর্তাই বাংলাদেশে এসেছেন। কিন্তু জন কেরির মতো বড় কর্মকর্তা তারা কেউ নন। সঙ্গত কারণেই সরকারি মহল তার এই সফরে খুশি ও অনুপ্রাণিত। এই মহলের কেউ কেউ এমন একটা অভিমতও প্রচার করার চেষ্টা করছেন যে, জন কেরির সফর তার দেশের তরফে ২০১৪ সালের নির্বাচন মেনে নেয়ার বা তাকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের প্রমাণ। এটা কষ্ট কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। ২০১৪ সালের নির্বাচন সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের অভিমত সে সময়ই প্রকাশিত হয়। ওই অভিমতের কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে কারো জানা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। বরং এ ধরনের প্রশ্নের জবাবে একাধিকবার জানানো হয়েছে, ওই নির্বাচন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভিমত অপরিবর্তিত রয়েছে। বলাবাহুল্য, এ ধরনের মনগড়া অভিমত এক ধরনের বালখিল্যতার পরিচায়ক ও বিভ্রান্তিকর। একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে আরেকটি রাষ্ট্রের পারস্পরিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট সম্পর্ক সব সময়ই বহাল ও বজায় থাকে। কারা ক্ষমতায় আছেন, কীভাবে তারা ক্ষমতায় এসেছেন সেটা এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব একটা বিবেচনায় নেয়া হয় না। ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রিজারভেশন থাকলেও দ্বিপাক্ষিক ও পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে দুই রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্কের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। বরং অনেক ক্ষেত্রে তা সম্প্রসারিত হয়েছে। উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা কোথায় কোথায় অব্যাহত আছে বা বৃদ্ধি পেয়েছে তার কিছু বিষয় জন কেরিও উল্লেখ করেছেন। তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরো উন্নয়নের প্রচেষ্টার কথাও জানিয়েছেন। বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নির্মাণের চেষ্টায় আমরা সবাই কঠোর পরিশ্রম করছি।
বাংলাদেশে যেমন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ আছে তেমনি যুক্তরাষ্ট্রেও বাংলাদেশে স্বার্থ রয়েছে। এই স্বার্থই দুই রাষ্ট্রকে সম্পর্কের অটুট বন্ধনে আটকে রেখেছে। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ আছে। আরো বিনিয়োগের সম্ভাবনা আছে। অর্থনৈতিক লেদেনের সম্পর্ক আছে। আছে বাণিজ্যিক স্বার্থও। আর একটি বিশেষ দিকও আছে। বাংলাদেশ ছোট দেশ হলেও বিশ্ব-ভূগোলে তার অবস্থান এমন জায়গায় যার ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে তার প্রভাববলয়ের মধ্যে রাখতে চায়। বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের এটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিক বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। পক্ষান্তরে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি, এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তি এবং বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী রাষ্ট্র। সেখানে বাংলাদেশের ব্যাপক অর্থ-বাণিজ্যিক স্বার্থ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের স্বার্থ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রধান উন্নয়ন সহযোগীদের অন্যতম। বিনিয়োগ ও উন্নয়নে তার আরো সহযোগিতার প্রয়োজন বাংলাদেশের রয়েছে। বাংলাদেশও চায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের বিস্তার।
এই কিছু দিন আগেও বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে একটা টানাপোড়েন লক্ষ্যযোগ্য ছিল। সেটা কিছুটা রাজনৈতিক, কিছুটা অন্যান্য কারণে। সেই টানাপোড়েন একেবারে কেটে গেছে, সম্ভবত সে কথা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে সম্পর্ক উন্নয়নের একটা লক্ষণ স্পষ্টতই প্রতিভাত হচ্ছে। জন কেরির সফরকে এর একটি প্রমাণ হিসেবে হাজির করা যায়। দুই পক্ষই সম্পর্ক উন্নয়নের তাগিদ ভালোভাবে অনুভব করেছে বা করছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি, বলার অপেক্ষা রাখে না, একমুখী বৈশিষ্ট্য নিয়ে চলমান থাকার কারণে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে। এর মন্দ দিকগুলো সরকারের নীতিনির্ধারকরা অনুধাবন করে শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক বহুমুখীকরণের দিকে নজর দিয়েছেন। এটা একটা ইতিবাচক দিক। যুক্তরাষ্ট্র যেমন চেয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে, তেমনি বাংলাদেশও চেয়েছে। ফলে কিছুটা শ্লথ হয়ে আসা সম্পর্কে নতুন গতিবেগ সঞ্চারিত হয়েছে।
জন কেরি তার বাংলাদেশ সফরের ব্যাপারে যথেষ্ট সন্তোষের সঙ্গে উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করেছেন। তিনি প্রধামন্ত্রীর উচ্চ প্রশংসা করেছেন। বাংলাদেশের চমকপ্রদ উন্নয়নে তার মুগ্ধতার কথা জানিয়েছেন এবং বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের পথে তারই কন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়ন, নিরাপত্তা এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার ক্ষেত্রে একসঙ্গে কাজ করার গভীর আগ্রহও তিনি ব্যক্ত করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা সম্পর্কে এক টুইট বার্তায় তিনি বলেছেন, নিরাপত্তা ইস্যু ও সহিংস চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের দৃঢ় সহযোগিতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। জন কেরির সফর সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের উপ-মুখপাত্র মার্ক ট্রেনার সাংবাদিকদের যে ব্রিফিং করেন সেখানে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জন কেরির সাক্ষাৎকালে গণতন্ত্র, উন্নয়ন, নিরাপত্তাসহ দুই দেশের পারস্পরিক সহযোগিতার বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। জন কেরি বিশেষ গুরুত্ব দেন বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের হুমকি মোকাবিলার বিষয়ে। সেই সঙ্গে মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। তিনি বাংলাদেশের ব্যাপক উন্নয়ন প্রক্রিয়া, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক সংকটের সমাধান এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অঙ্গীকারের প্রশংসা করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া মধ্যাহ্ন ভোজসভায় উভয় পক্ষ আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষা, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা, জলবায়ুর পরিবর্তন, বৈশ্বিক নানা বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী এবং উদার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আলোচনা হয়। জন কেরি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস এবং মা ও শিশুর স্বাস্থ্য উন্নয়নের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির বিষয়গুলো তুলে ধরেন। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতি ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন জন কেরি। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত বহুদলীয় শাসন ব্যবস্থার জন্য শান্তিপূর্ণ বিরোধী দলের অবস্থানের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। এ সময় হুমকিগুলো মোকাবিলায় বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার বিষয়েও গুরুত্ব দেন জন কেরি।
জন কেরির সফরকেন্দ্রিক কোনো যুক্ত ঘোষণা বা যুক্ত ইশতেহার প্রকাশিত হয়নি। দুই দেশের তরফে যে বিবৃতি বা প্রেস ব্রিফিং দেয়া হয়েছে তার মধ্যে আলোচনার বিষয় ও দুই পক্ষের বক্তব্যের যতটুকু এসেছে তাতে বোঝা যায়, আলোচনায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের বিষয়টি। দ্বিতীয়ত, উন্নয়ন-সহযোগিতার বিষয়টি যথোচিত গুরুত্ব লাভ করেছে। তৃতীয়ত, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখার বিষয়টি প্রাধান্যে এসেছে।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় জন কেরি সন্ত্রাসবাদ দমনে সহযোগিতার প্রস্তাব দেন। বলেন, ‘বাংলাদেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা যুক্ত হতে চাই। এ বিষয়ে আমাদের পর্যাপ্ত সংখ্যক বিশেষজ্ঞ আছে এবং আমরা প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে পারি।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু প্রযুক্তিগত উন্নত একটি দেশ, তাই সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের বিষয়ে তারা আমাদের তথ্যগত সহায়তা দিতে পারে। এটা সম্ভব হলে সন্ত্রাসী গ্রেফতারে আমাদের সহযোগিতা হয় এবং এটা দ্বিপক্ষীয়ভাবেই হতে হবে।’ স্মরণ করা যেতে পারে, সন্ত্রাসবাদ দমনে যুক্তরাষ্ট্র বহু আগে থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করে আসছে। সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ের পর যুক্তরাষ্ট্র বিশেষভাবে জোর দিচ্ছে ‘যুক্ত হওয়ার’ ব্যাপারে। কিন্তু বাংলাদেশ এ লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি যুক্ত করতে নারাজ। বাংলাদেশ বরং তথ্য-উপাত্ত ও কারিগরি সহযোগিতা নিতেই আগ্রহী।
বাংলাদেশে আইএস বা ওই ধরনের সন্ত্রাসী সংগঠনের অস্তিত্ব আছে, এমন দাবি যুক্তরাষ্ট্রের অনেক দিনের। বাংলাদেশ এ দাবি স্বীকার করে না। এ পর্যন্ত যে সব সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের দাবির সত্যতা প্রমাণিত হয়নি। দেখা দেছে, সন্ত্রাসীরা হোম গ্রোন। যুক্তরাষ্ট্র এখন একথা স্বীকার করে নিলেও বলছে, এদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সম্পর্ক রয়েছে। জন কেরিও এক প্রশ্নের জবাবে এ সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদের সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে না। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীর সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। ইরাক ও সিরিয়ায় সক্রিয় আইএসের সঙ্গে বিশ্বের আটটি জঙ্গি সংগঠনের যোগাযোগের প্রমাণ রয়েছে। এই আটটি জঙ্গি সংগঠনের একটি রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের জঙ্গিদের যে কোনো পর্যায়ে যোগাযোগ আছে, এ নিয়ে বিতর্ক নেই। আমরা আমাদের আলোচনায় এটা স্পষ্ট করেছি। যখন মন্ত্রীরা বলেন, ‘এ দেশে বেড়ে ওঠা’ তার মানে এটা নয় যে, বিদেশী যোদ্ধা এখানে এসে এটা করছেন। এখানকারই কেউ কাজটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর মানে এই নয় যে, ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা মাধ্যমে অন্য জায়গা থেকে তারা প্রভাবিত হচ্ছেন না। তাই মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী আমাদের আগ্রহের প্রতি নিবিড়ভাবে সহযোগিতার বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন।’ যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের প্রতি মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীর ‘নিবিড়ভাবে সহযোগিতার বিষয়টি স্পষ্ট করা’ সম্পর্কে আমাদের অবশ্য কিছু জানা নেই। এটি জনগণকে জানানো জরুরি বলে আমরা মনে করি।
উন্নয়ন সহযোগিতার বিষয়টি দু’দেশের স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যও এর বাইরে নয়। এ ব্যাপারে উদ্যোগ ও সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে, এ প্রতিশ্রুতি জন কেরি দিয়েছেন। ইএমকে সেন্টারে দেয়া ভাষণে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সহযোগিতা প্রদানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে এ বিষয়ে বাংলাদেশকে যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করবে, অতীতের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা যেমনটা বাংলাদেশের পাশে থেকেছি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র শিক্ষক প্রশিক্ষণ, যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, স্বাস্থ্যখাতের উন্নতি, শ্রমিক ও নারী অধিকার এগিয়ে নেয়া ও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে শত শত কোটি ডলার দিয়েছে। দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কও এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য সহযোগী দেশ। আমরা বাংলাদেশের বৃহত্তম রফতানি বাজার এবং সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগেরও প্রধান উৎস।
আমাদের সম্পর্ক বৃদ্ধিতে অনন্য ভূমিকা রেখেছে দুই হাজার আটশ’ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক শিল্প। আপনাদের দেশের প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ রাখার কাজেও এটি ভূমিকা রেখেছে।’ যতদূর জানা গেছে, জন কেরির সঙ্গে আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা নিশ্চিত করার অনুরোধ জানানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পণ্যের জিএসপি সুবিধা অনেক দিন ধরে স্থগিত হয়ে আছে। এ বিষয়ে কতদূর আশ্বাস বা প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে জানা যায়নি।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়েই জন কেরি বক্তব্য দিয়েছেন। তবে এ বিষয়টি যথেষ্ট প্রচার আনুকূল্য পায়নি। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার যে আলোচনা ও মতামত বিনিময় হয়েছে সে বিষয়ে কিছু কথা দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে; আর কিছু কথা এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের প্রেস ব্রিফিংয়ে। ইএমকে সেন্টারে দেয়া ভাষণে জন কেরি সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার প্রসঙ্গে ধরে গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার জোর তাকিদ দেন। সন্ত্রাসবাদের হুমকি মোকাবিলা করতে গিয়ে বিরোধীদলগুলোর কণ্ঠ রোধ এবং জনসমক্ষে বিতর্ক বন্ধ করার প্রলোভনের ফাঁদে পা না দিতে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত সহিংস সন্ত্রাসবাদ দমনে আমাদের কাছে সবচেয়ে কার্যকর ও বিশ্বাসযোগ্য পন্থা হচ্ছে গণতন্ত্র। সন্ত্রাসীদের পরাভূত করতে হলে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে হবে যা সন্ত্রাসীরা ঘৃণাভরে অবজ্ঞা করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটি সমাজের মানুষ নিরাপত্তা বোধ করে কিনা তার সঙ্গে সমৃদ্ধির একটা সম্পর্ক আছে। আর উগ্রবাদীরা এমন স্থানকেই নিজেদের কর্মকা-ের স্থল হিসাবে বেছে নেয় যেখানে মানুষ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে নিজেদের প্রান্তিক ও অবহেলিত বোধ করে। সহিংসতার মধ্যে প্রবৃদ্ধি অর্জন ও ধরে রাখা অনেক কঠিন। বিনিয়োগের সঙ্গেও নিরাপত্তার সম্পর্ক রয়েছে।’
গণতন্ত্রের সঙ্গে ব্যক্তি ও সামাজিক নিরাপত্তা, ব্যক্তি ও সমাজের বিকাশ, জাতীয় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদির সম্পর্ক ওতপ্রোত। আমাদের দেশে এখন সীমিত গণতন্ত্র চালু আছে। বিরোধীদলগুলো নানা পীড়নে কার্যকর অবস্থায় নেই। গণতন্ত্রের বিকাশ ও ভবিষ্যত অনিশ্চিত। এই পটভূমিতে সন্ত্রাসবাদের আপদ মারাত্মক উদ্বেগ ও হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে মোটেই কারো দ্বিমত নেই যে, গণতন্ত্র তার সুনির্দিষ্ট ও স্বীকৃত ধারায় ফিরে এলে এখন জাতি যে সব গুরুতর সমস্যায় নিপতিত, তা কেটে যেতে সময় নেবে না। সরকার কি এ দিকে আশু দৃষ্টি দেবে?
জন কেরির সফরের ফলাফলকে যুক্তরাষ্ট্রের তরফে এবং বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ইতিবাচক হিসাবেই গণ্য করা হচ্ছে। তার এ সফর যদি দু’দেশের মধ্যকার সহযোগিতাকে সম্প্রসারিত করে, সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ ও নিকটতর করে তবে দু’দেশই সমভাবে লাভবান হতে পারবে। নিরাপত্তা, উন্নয়ন, অর্থনীতি, বাণিজ্যসহ সকল ক্ষেত্রেই সহযোগিতার সম্প্রসারণ ঘটতে পারে। আগামীতে দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক ও সহযোগিতা কিভাবে অগ্রসর হয়, অতঃপর সেটাই দেখার বিষয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।