Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভারতকেই প্রমাণ করতে হবে বাংলাদেশ তার বন্ধু

প্রকাশের সময় : ২৯ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আবদুল আউয়াল ঠাকুর

একটি নতুন চ্যানেল উদ্বোধনকালে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশকে অপরিহার্য বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, শুধু দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র নয়, জনগোষ্ঠীগত দিক থেকেও এই দুটি দেশ একসূত্রে গঠিত। ভারত সব সময় বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এসেছে, তার কারণ অভিন্ন ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা, ভৌগোলিক নৈকট্য। ভারতের রাষ্ট্রপতি যেসব মন্তব্য করেছেন তা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করতে গেলে অনেক কথাই বলতে হবে, বিশেষ করে বর্তমান প্রেক্ষাপটে। তিনি যে অভিন্ন ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির যে কথা বলেছেন তা পূর্ণ নয় বরং খ-িত বর্ণনা। এ কথা ঐতিহাসিকভাবে সত্যি, কোনো কোনো বিষয়ে এ দুটি দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক ছিল। যেমন বলা যায়, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের এলাকা ছিল বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা। সেদিক থেকে আমার একই বন্ধনে ছিলাম। আবার যদি ফকির ও সন্যাসী বিদ্রোহের কথা ভাবা যায়, তাহলে সেখানেও আমরা ঐক্যবদ্ধ ছিলাম। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের এক পর্যায় পর্যন্তও আমরা একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পরে সেটা অনেক দূর এগোয়নি। যখন বঙ্গভঙ্গ হলো তখন সব ইতিহাস-ঐতিহ্য পুনর্মূল্যায়িত হলো। বলা যায়, নতুনরূপে যেন উঠে এলো সবকিছু। স্পষ্টতই প্রতীয়মান হলো, এটি মুসলিম বাংলা ওটি হিন্দুবাংলা। সে রেখাই বর্তমান ভূগোলের গোড়ার কথা। সে যাইহোক, এরপর আরো অনেক পানি গড়িয়েছে। তবে ভাষা এবং ভৌগোলিক নৈকট্যের যে প্রসঙ্গ ভারতের রাষ্ট্রপতি তুলেছেন তার সত্যতা অস্বীকারের নয়। বাংলা আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা। আর ভারতে এটি বলতে গেলে একটি বিলীয়মান ভাষা। সবকিছুর পরেও ভৌগোলিক নৈকট্যের বিষয়টি যে কোনো বিবেচনাতেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি আলোচনার অবকাশ রাখে। যাকে কূটনৈতিক ভাষায় বলা যায়, নিকটতম প্রতিবেশী। এই নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের রাষ্ট্রপতির অপরিহার্য তত্ত্বকে যদি বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে অবশ্যই দেখার ও বিবেচনার বিষয় রয়েছে এ থেকে আমরা এবং ভারতীয়রা কারা কতটুকু উপকৃত হচ্ছি বা হতে পারছি।
যে কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি ক্ষমতায় রয়েছেন তিনি বাংলাদেশ এবং এ দেশের সরকার সম্পর্কে বোধকরি বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিকের চেয়ে অনেক বেশি ওয়াকিবহাল। কথাটা এ জন্য বলা যে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক বিতর্কের সূত্র-উৎস তার অজানা থাকার কথা নয়। কূটনীতির ভাষায় যাকে দ্বিপক্ষীয় বলা হয়, এটা ঠিক সে পর্যায়ে পড়ে কিনা তা বিবেচনার ভার তার ওপরই থাকল। তবে তিনি দুই দেশের সম্পর্কের অপরিহার্যতা নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তাকে কোনো বিবেচনাতেই এড়িয়ে যাওয়ার ন্যূনতম সুযোগও নেই। এর প্রধান কারণ, দুটি দেশের অভিন্ন সমস্যা। ভারত বাংলাদেশের নিকটতম বড় প্রতিবেশী দেশ। যদি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কথা বলা হয়, তার অর্থ হলো পারস্পরিক সমতাভিত্তিক সম্পর্ক। গত কিছু দিনে বা গত কয়েক বছরে ভারত-বাংলাদেশ নানা ধরনের অর্থনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। এ নিয়ে নানামত থাকলেও এটাই সত্যি যে, দুই দেশের মধ্যে নানাবিধ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এ থেকে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হবে বা হতে পারবে ইতোমধ্যে সে যথেষ্টই হয়েছে। এ আলোচনায় অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। কেন্দ্রীয় শহীদমিনারে গণঅবস্থানের কর্মসূচি পালনকালে বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা বলেছেন, রামপাল চুক্তি ছুড়ে ফেল, সুন্দরবন রক্ষা কর। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতিবাদকারীরা ঘোষণা দিয়েছেন, সুন্দরবন ধ্বংসকারী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র মানি না। তারা বলছেন, প্রয়োজনে রাজনৈতিক গতিধারা পরিবর্তন করে হলেও রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। বক্তাদের এই প্রতিবাদের মধ্যদিয়ে মূলত বিদ্যুৎকেন্দ্র নয় বরং তারা একটি ভারসাম্যমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব করেছেন। তারা বলছেন, আমরা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সুন্দরবন দুটোই চাই। এই প্রকল্প নিয়ে কথা বলেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্তকে দেশবিরোধী ও গণবিরোধী আখ্যা দিয়ে এটি বাতিলের দাবি করেছেন তিনি। তিনি এই প্রকল্পকে অলাভজনক বলেও উল্লেখ করেছেন। বেগম জিয়ার বক্তব্যের পরপরই দ্রুত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সরকারি দলের কোনো কোনো নেতা। তারা বলছেন, বেগম জিয়া নাকি রাজনীতি রক্ষা করতেই কোনো তথ্য-উপাত্ত ছাড়া রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরেধিতা করছেন। তবে তারা প্রকারান্তরে স্বীকার করেছেন, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতা একটি জনপ্রিয় ইস্যু। অর্থাৎ জনগণ এই বিদ্যুৎকেন্দ্র্র বাতিলের পক্ষে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই জাতীয় তেল-গ্যাস-রক্ষা কমিটির ব্যানারে এর বিরোধিতা করা হচ্ছিল। সর্বশেষ রিপোর্টে বলা হয়েছে, আলোচ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বছরে ৪৭ লাখ টন কয়লা ও চুনাপাথর আনা হবে। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত পশুর নদ ও শিবসা নদী এবং বিভিন্ন খাল দিয়ে এসব রামপালে পৌঁছাবে। কয়লা ও চুনাপাথর বহনকারী জাহাজগুলোকে সমুদ্র থেকে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে ৫২৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। এই পথে ডলফিনের দুটি অভয়ারণ্য, সুন্দরবনের বেঙ্গল টাইগারসহ মহাবিপন্ন প্রজাতির বেশ কিছু প্রাণীর বিচরণ এলাকা রয়েছে। ফলে প্রাণীকূল নতুন ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। প্রকল্পের অর্থে করা সমীক্ষা সম্পর্কে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, তারা ক্ষতি কমিয়ে আনার চেষ্টা করবেন। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরূল ইমাম মনে করেন, কয়লা পরিবহন পথের পাশাপাশি রামপালে কয়লা এনে তা জাহাজ থেকে প্রকল্প এলাকায় স্থানান্তরের সময় ব্যাপক ধুলা ও বিষাক্ত পদার্থ ছড়িয়ে পড়তে পারে। সমীক্ষার প্রতিবেদনে এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু পাওয়া যায়নি। তিনি সুনির্দিষ্টভাবেই মনে করেন, রামপাল প্রকল্প কর্তৃপক্ষ যেভাবে প্রযুক্তি দিয়ে দূষণ শতভাগ রোধ করবে মনে করে তা অবৈজ্ঞানিক। কারণ, পৃথিবীর কোথাও এমন কোনো প্রযুক্তি নেই যেখানে কেউ বলতে পারে, শতভাগ দূষণ রোধ করা যাবে। বলা যায়, দূষণ কমিয়ে আনা যাবে। এই অল্প দূষণও সাধারণ এলাকার যতটা ক্ষতি করবে, সুন্দরবনের ক্ষতি করবে তার কয়েকগুণ বেশি। বিশেষজ্ঞরা এও আশঙ্কা করছেন, রামপাল প্রকল্পের দূষণে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে থাকা নিবিড় সুন্দরবন পরবর্তী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যেই হারিয়ে যেতে পারে।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের যারা স্থান নির্বাচন করেছেন তারা যেসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েছেন তার পরিপূর্ণ বিশ্লেষণে না গিয়েও এ কথা বলা যায়, বুঝে বা না বুঝে হোক সুন্দরবন যারা দখল করতে চায় সেই ভূমিদস্যুদের অনুকূলেই এটা করা হয়েছে। অনেক দিন ধরেই একটি বিশেষ মহল সুন্দরবন গ্রাসের পাঁয়তারা করছে। প্রাকৃতিক সুরক্ষা ও সৌন্দর্য এই বনকে তারা হীনস্বার্থে সহ্য করতে পারছে না। আজকের প্রেক্ষাপটে এটা বলা হয়তো অমূলক নয় যে, বিদুৎকেন্দ্রকে কেন্দ্র করে এই প্রাকৃতিক সুরক্ষাটি যদি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় তাহলে তখন আর কারো কিছু বলার থাকবে না। এক সময়ে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিত্যক্ত হলেও তখন আর বনকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। যদিও এখানে বলে রাখা দরকার, প্রতিবেশীর বৈরী পানিনীতির কারণে এমনিতেই সুন্দরবন হুমকির মুখে রয়েছে। সে যাই হোক, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতাকে সরকারি কোনো কোনো মহল ভারতবিরাধী কর্মকা- হিসেবে বিবেচনা করার যে দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করছেন তাকে প্রতিবেশীর সম্পর্ক বিবেচনায় খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এ প্রকল্প নিয়ে অন্য যেসব প্রসঙ্গ উঠেছে সেসব দিকে না গিয়েও বলা যায়, প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্কের অর্থ যদি হয় জনগণের সাথে সম্পর্ক তাহলে অবশ্যই ভারতকেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভেবে দেখতে হবে এখানে বিদ্যুৎকেন্দ্র করা কতটা যৌক্তিক। লাভ-ক্ষতির হিসাব হচ্ছে ব্যবসায়িক। সম্পর্কের হিসাব হচ্ছে অন্তরের। এখন অবশ্যই দেখার রয়েছে, ভারত বিষয়টিকে কেবল ব্যবসার দৃষ্টিতে দেখতে পছন্দ করছে নাকি জনগণের মনের ভাব বোঝার চেষ্টা করছে। অবশ্যই এটা বলা দরকার, ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতির দল যে ভূমিকা রেখেছিল সেক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশের জনগণের কোনো তোয়াক্কা করেনি। এক্ষেত্রেও যদি সেটিই তাদের মনাভাব হয়, তাহলে তাকে কোনো বিবেচনাতেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সূত্রে আবদ্ধ বলা যাবে না। বরং এটা হবে চাপিয়ে দেয়া একতরফা দৃষ্টিভঙ্গি। এ কথা এ জন্য যে বর্তমান সরকারের সাথে ভারতের সম্পর্ককে যে কোনো সময়ের চেয়ে সর্বোত্তম বলে অভিহিত করা হয়। এ সম্পর্ক থেকে বাংলাদেশ বা দেশের জনগণ কী পেয়েছে সে আলোচনাই এখন পর্যন্ত মুখ্য। এ কথা এ জন্য যে, বাংলাদেশের মানুষ যতগুলো প্রধান সমস্যায় রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পানি। ভারতীয় বৈরী নীতির কারণে বাংলাদেশ পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত। সেই সাথে এটাও সত্যি যে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। এই প্রবণতায় একটি বড় ধাক্কা লেগেছে বিহার মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বানে। বাংলাদেশের মরণ ফাঁদ বলে পরিচিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতিশ কুমার। তিনি গঙ্গা নদীর ওপর নির্মিত বিতর্কিত ফারাক্কা বাঁধ পুরোপুরি সরিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। বিবিসির উদ্ধৃতি দিয়ে খবরে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে বিহার সরকারের পক্ষ থেকে একটি তালিকা তুলে দেয়া হয়েছে। এতে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ হওয়ার আগে ও পরে বিহারে গঙ্গার গভীরতা বা নাব্যতা কতটা কমেছে তার হিসাব তুলে ধরা হয়েছে। সাংবাদিকদের বিহারের মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, ফারাক্কা বাঁধের কারণে গঙ্গায় বিপুল পরিমাণ পলি জমছে। আর এ কারণে প্রতিবছর বন্যা হচ্ছে। তিনি মনে করেন ফারাক্কা বাঁধ তুলে দেয়াই এর স্থায়ী সমাধান। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় তিনি আরো বলেছেন, আগে যেসব পলি নদীর প্রবাহে ভেসে বঙ্গোপসাগরে পড়ত, এখন ফারাক্কার কারণে সেটাই নদীর বুকে জমা হয়ে বন্যা ডেকে আনছে। যৌথ নদী কমিশনের বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন এমন একজন সাবেক সদস্য মনে করছেন, নদীর ওপর বড় বাঁধ দিলে তা শেষ পর্যন্ত হিতে বিপরীত হয়, তার প্রমাণই ফারাক্কা বাঁধ। তিনি আরো জানিয়েছেন, এই বাঁধ দেওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল গঙ্গার নাব্যতা বজায় রেখে কলকাতা বন্দর চালু রাখা। এই বাঁধের কারণে গঙ্গার ভাটি এলাকা বাংলাদেশে পানি কমে গেছে। এই সময়ে বাঁধের বিভিন্ন ফটকে পলি জমে এখন বিহারেও বন্যা হচ্ছে। এসব প্রতিক্রিয়ার কথা অনেক আগেই বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন। বাস্তবত এখন সমস্যা হতে দেখে ভারতীয় রাজনীতিবিদরা টের পেয়েছেন এবং বাঁধের বিরুদ্ধে ইতিবাচক অবস্থান নিয়েছেন।
বাংলাদেশে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাব লিখে বা বলে বুঝানোর কোনো প্রয়োজন নেই। এই বাঁধসহ অন্যান্য বাঁধের কারণে বাংলাদেশে কার্যত মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশ নেমে যাচ্ছে। নদ-নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ার কারণে নোনা পানি উপরে উঠে আসতে শুরু করেছে। ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন হুমকির মুখে পড়েছে। কৃষিতে পানির সংকট ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। সুপেয় খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। পানির অভাবে নাব্য হারিয়ে এ পর্যন্ত ১৮ হাজার কিলোমিটার নৌপথ হারিয়ে গেছে। বাকি নৌপথগুলো প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। চরম বিরূপ আবহাওয়া বিরাজ করছে বাংলাদেশে। মনে করা হচ্ছে, বিদ্যমান পরিস্থিতি বহাল থাকলে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের নদীগুলো বিলুপ্ত হয়ে বাংলাদেশ ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারে। ভাটির দেশ হওয়ার কারণেই বাংলাদেশ আজ প্রতিবেশীর বৈরী পানি নীতির শিকার। এর শুরুটা বলা যায় ১৯৬১ সাল থেকে, যখন ভারত ফারাক্কা বাঁধের প্রতিষ্ঠা প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। ১৯৭৫ সালে ভারত গঙ্গা থেকে প্রতি সেকেন্ডে ১ হাজার ১০০ কিউবিক মিটার পানি হুগলিতে সরিয়ে নিতে ফারাক্কা বাঁধ চালু করেছিল। যদিও ১৯৫১ সালেই ভারত গঙ্গায় বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কার্যত ফারাক্কা হচ্ছে ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের একটি বড় অংশ। বাস্তবতা হচ্ছে, ৪০ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার কথা বলে বা ধোঁকা দিয়ে আলোচ্য ফারাক্কা বাঁধ চালু করার পর থেকে ভারত একতরফাভাবেই পানি প্রত্যাহার করে চলছে। দুই দেশের সম্পর্কের অপরিহার্যতার যে কথা ভারতীয় রাষ্ট্রপতি বলেছেন, বোধকরি তার নজির স্থাপন করতে হলে ফারাক্কার দিকটি বিবেচনায় আনা জরুরি। সম্পর্ক কখনো ধোঁকাবাজিকে বোঝায় না। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অর্থ হচ্ছে দুই দেশের স্বার্থকে সমান এবং সমমর্যাদায় বিবেচনা করা। ফারাক্কা বা পানি ইস্যুতে এটা করা হয়নি। এখানে আরো উল্লেখ করা দরকার। কেবল পানি আটকে দিয়েই ভারত ক্ষান্ত ব্যাপারটি এখানেই শেষ নয়, বরং বাংলাদেশ তার প্রয়োজনীয় পানি যে গঙ্গা বাঁধের মাধ্যমে ধরে রাখতে চায় সেখানেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশটি। বর্তমান অবস্থাটা বিবেচনা করা দরকার। বিহারে বন্যা ঠেকাতে বাংলাদেশকে ভাসিয়ে দেয়া হচ্ছে। অথচ গঙ্গা বাঁধ থাকলে এ অবস্থা হওয়ার কোনো সুযোগই থাকত না। এটা অবশ্যই বোঝা দরকার। ভারতের রাষ্ট্রপতি এ ব্যাপারটিকে কীভাবে দেখছেন? এর বাইরেও কথা রয়েছে। দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যও কার্যত একতরফা। ভারতে বাংলদেশি পণ্যের প্রবেশ অনেকটাই নিষিদ্ধ। অন্যদিকে যেসব পলিসি গ্রহণ করা হচ্ছে তাতে হয়তো দেখা যাবে, এক সময়ে বাংলাদেশে শিল্পোৎপাদনই সম্ভব হবে না। সে ক্ষেত্রে কিন্তু সম্পর্কের অপরিহার্যতার ভিন্ন অর্থ দাঁড়াবে বা দাঁড়াতে পারে।
সরকারের সাথে ভারতের সম্পর্ক যে মাত্রাতেই থাকুক না কেন ভারতীয়রা এটা পরিষ্কার মনে করছে, এভাবে বেশি দিন এগোনো সম্ভব নয়। যারা রাজনীতির খোঁজখবর নানাভাবে রাখেন তারা মনে করছেন ভারত বাংলাদেশে এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি করতে চায় যা তার জন্য স্বস্তিদায়ক এবং সহনীয়। এর জন্য তাদের জনগণের আস্থাশীল রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন। জনগণের আস্থা না থাকলে সরকার থেকে সরকারি পর্যায়ে যত ধরনের সম্পর্কই থাকুক না কেন আখেরে তা কোনো সুফল দেয় না। প্রকৃত সম্পর্ক হচ্ছে জনগণের সাথে। সে কারণেই ভারতকে বুঝতে হবে বাংলাদেশের মানুষের সমস্যার কথা। ২০১৪ সালের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় রেখেই ভাবতে হবে বাংলাদেশের জনগণের প্রকৃত চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টিও। বিশ্ব রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তনের আভাস স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাংকের বিকল্প ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দুনিয়াজোড়া প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সম্পর্ক জনগণের সম্পর্কের ভিত্তিতে মূল্যায়িত হচ্ছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কও তার বাইরে নয়। সে কারণেই প্রথমত ফারাক্কা বাঁধ তুলে দেয়া নিয়ে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী যে আহ্বান জানিয়েছেন তাকে সক্রিয় বিবেচনায় নিতে হবে। ভারতের পরিবেশ বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরাও অনেক দিন থেকেই এ ধরনের বাঁধ নির্মাণের বিরোধিতা করে আসছেন পরিবেশের কথা বিবেচনা করেই। এখন তাদের কথা প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ এই বাঁধের বিরোধিতা করে আসছে জীবন-মরণ সমস্যার বিবেচনা থেকেই। সে কারণে দুই দেশের সুসম্পর্কের প্রয়োজনেই একদিকে যেমনি ফারাক্কা বাঁধ তুলে দেয়া প্রয়োজন তেমনি বাংলাদেশের স্বার্থহানিকর সব বাঁধ তুলে দেয়া এবং নির্মাণ থেকে বিরত থাকাও জরুরি। শুধু রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নয়, বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের বিপরীতে যায় এমন যে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন থেকে ভারতের বিরত থাকা অপরিহার্য। সময় এসেছে ভারতেরই প্রমাণ করার যে, বাংলাদেশ সত্যিই তার বন্ধু।
[email protected]

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

Show all comments
  • মুসা ২৯ আগস্ট, ২০১৬, ৩:৩৮ এএম says : 0
    এক দোস্ত আরেক দোস্তকে কি পানিতে চুবাইয়া মারতে পারে ???
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারতকেই প্রমাণ করতে হবে বাংলাদেশ তার বন্ধু
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ