বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
মহাকবি কায়কোবাদ তার বিখ্যাত আজান কবিতায় বলেছেন:
কে ঐ শোনাল মোরে আজানের ধ্বনি।
মর্মে মর্মে সেই সুর বাজিল কি সুমধুর
আকুল হইলো প্রাণ, নাচিল ধমনি।
আমি তো পাগল হয়ে সে মধুর তানে,
কি যে এক আকর্ষণে, ছুটে যাই মুগ্ধমনে
কি নিশিতে, কি দিবসে মসজিদের পানে।
হৃদয়ের তারে তারে, প্রাণের শোনিতধারে,
কি যে এক ঢেউ ওঠে ভক্তির তুফানে
কত সুধা আছে সেই মধুর আজানে।
কবিতাটি দীর্ঘ। আমরা এটুকুই উদ্ধৃত করলাম। আজানের মাহাত্ম্য, ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে তার প্রতিক্রিয়া, আল্লাহ-প্রেমের আবেগ এবং প্রেরণা এই ক’টি লাইনে স্পষ্টরুপে প্রতিভাত হয়েছে। আজানের বৈশিষ্ট্য, মানবমনে তার আবশ্যম্ভাবী প্রভাব শত শত বছর ধরে একইভাবে বিদ্যমান রয়েছে।
আজানের শাব্দিক অর্থ আহ্বান করা বাডাকা। ব্যবহারিক অর্থ হলো, আল্লাহপাকের সত্তাসূচক ঘোষণা উচ্চকিত করা এবং রাসুল (সা.) এর রিসালাতের স্বীকৃতি সোচ্চার করা। এই সঙ্গে নামাজের প্রস্তুতি গ্রহণ করা ও নামাজের স্থলে যাওয়া। তরিকতের ভাষায় আজান হলো, জাতে ইলাহী ও নূরে ইলাহীর মর্যাদার ঘোষণাসম্বলিত আহ্বানে সাড়া দিয়ে নামাজ আদায় নিষ্পন্ন করা। পবিত্র কোরআনে আজানের পরিবর্তে ‘নিদা’ শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়, যার অর্থ ডাকা। আল্লাহপাক বলেছেন: হে বিশ্বাসীগণ, জুমার দিকে যখন নামাজের জন্য ডাকা হয়, তখন তোমরা আল্লাহকে মনে রেখে তাড়াতাড়ি করবে ও বেচাকেনা বন্ধ করবে। এই তোমাদের জন্য ভালো, যদি তোমরা বুঝতে। সুরা জুমআ : ৯।
যেভাবে আজানের সূচনা:
রাসুল (সা.) মদীনায় হিজরত করে আসার পর মুসলমানেরা নামাজের সময় হলে তাঁর কাছে এসে জমায়েত হতো, ডাকতে হতো না। সে কালে প্রার্থনার সময় ইহুদিরা শিঙ্গা বাজিয়ে এবং খ্রিস্টানরা ঘণ্টাধ্বনি করে লোক জমায়েত করতো। রাসুল (সা.) নামাজে মুসলমানদের ডাকার জন্য এ দু’টি উপায় অবলম্বনের কথা ভাবলেন; কিন্তু কোনোটাই তাঁর মনঃপূত হলো না। এমতাবস্থায়, আবদুল্লাহ ইবনে যায়িদ এক রাতে কীভাবে মানুষকে ডেকে জমায়েত করা যায়, তা স্বপ্নে দেখলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে উপস্থিত হয়ে তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমি রাতে স্বপ্ন দেখলাম, অচেনা একজন লোক সবুজ কাপড় পরে একটা ঘণ্টা হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। লোকটা আমার কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় আমি তাকে বললাম, হে আল্লাহর বান্দা, তুমি কি এই ঘণ্টাটা বিক্রি করবে? সে বললো, ঘণ্টা দিয়ে তুমি কী করবে? আমি বললাম, নামাজের জন্য লোকদের ডাকব, সে বলল, তোমাকে এর চেয়ে ভালো জিনিস শিখিয়ে দেব? আমি বললাম, কী জিনিস, বল তো। সে বলল, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আশহাদুআল লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আশহাদুআল লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ, আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ, হাইয়া আলাস সালাহ, হাইয়া আলাস সালাহ, হাইয়া আলাল ফালাহ, হাইয়া আলাল ফালাহ। আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ।
রাসূল (সা.) আবদুল্লাহ ইবনে যায়িদের স্বপ্নবৃত্তান্ত ও আজানের বাণী শোনার সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ইনশাল্লাহ এই স্বপ্ন সত্য। তুমি বেলালকে নিয়ে এক জায়গায় দাঁড়াও। তাকে কথাগুলো শিখিয়ে দাও। সে আজান দিক। কেননা ওর আওয়াজ তোমার আওয়াজের চেয়ে বড়। বেলাল আজান দিলেন। উমর (রা.) ঘরে বসে তা শুনলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ। আল্লাহর কসম, আবদুল্লাহ ইবনে যায়িদ যে স্বপ্ন দেখেছে, আমিও সেই রকম দেখেছি। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) আলহামদুলিল্লাহ বলে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম।)
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ জুমার নামাজের পূর্বে আজান দেয়ার বিধান রয়েছে। এটাই নামাজের জন্য ডাকার স্থায়ী পদ্ধতি। প্রকৃতপক্ষে আজান হলো, আল্লাহ ও রাসূল (সা.)-এর পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া বা শুনিয়ে দেয়া। সূরা তাওবা : ৩। হজের আজান (আহ্বান) দেয়ার জন্য আল্লাহর নির্দেশ আছে। তিনি হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে বলেছিলেন, হজের জন্য ডাক দাও। তারা যে ডাকে সাড়া দিয়ে দূর-দুরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে, উটে চড়ে আসবে, যাতে তারা ওইসব ফায়দা দেখতে পায়, যা তাদের জন্য এখানে রাখা হয়েছে। সূরা হজ : ২৭।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।