বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
প্রকৃত পক্ষে আন্তরিক বিশ্বাসকেই ঈমান বলে শনাক্ত করা হয়। এই দুনিয়াতে কারো ওপর ইসলামী বিধান কার্যকরী করার জন্য তার মৌখিক স্বীকারোক্তি শর্ত। কারণ মানুষ অন্তরের খবর জানে না। এজন্য মৌখিক স্বীকৃতির মাধ্যমেই তার মুসলমান হওয়ার বিষয়টি জ্ঞাত হওয়া যায়। কোনো ব্যক্তি যদি জরুরিয়াতে দ্বীনের ওপর আন্তরিক বিশ্বাস রাখে কিন্তু মৌখিক স্বীকৃতি দেয় না, সে দুনিয়ার বিচারে মুসলিম হিসেবে বিবেচিত না হলেও আল্লাহপাকের আদালতে মুসলিম বলেই বিবেচিত হবে।
এতদপ্রসঙ্গে আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে : আল্লাহপাক তাদের অন্তরে ঈমানকে বদ্ধমূল করে দিয়েছেন। (সূরা মুজাদালাহ : আয়াত ২২)। রাসূলে পাক (সা.) বলেছেন : হে অন্তরের পরিবর্তন সাধনকারী আল্লাহ! আমার অন্তরকে তোমার দ্বীনের ওপর সুদৃঢ় করে দাও। (মোসনাদে আহমাদ)।
উল্লেখিত দুটি বাক্যে ঈমানকে অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই দৃঢ়তাপূর্ণ জ্ঞান অর্জনের পর বান্দাহর জন্য ‘আমানতু বিল্লাহ’ বলা অবশ্য কর্তব্য। তবে, এক্ষেত্রে শর্ত হলো তার মৌখিক স্বীকৃতি ও উক্তি অন্তরের মূল ভাব বিশ্বাসের অনুরূপ হতে হবে। এতে এই ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, মৌখিক একরার বা স্বীকৃতি কোনো কোনো মুজতাহিদের মতে ঈমানের অংশ বলে বিবেচিত। তবে তা কখনো কখনো লুপ্ত বা প্রচ্ছন্ন হতে পারে। কারো মতে মৌখিক ইকরার পৃথিবীতে ঈমানের হুকুম প্রয়োগ করার জন্য শর্ত। জনসাধারণ্যে এটাই স্বীকৃত। (শরহে ফিকহে আকবার)।
এটা নিশ্চিত যে অন্তরের তাসদীকের নাম ঈমান। তবে দুনিয়াতে কারো ওপর ঈমানের আহকাম প্রয়োগ করার সাথে সাথে তার জানমালের নিরাপত্তা দান করা, তার ওপর যানাজার সালাত আদায় করা, মুসলমানদের কবরস্থানে তাকে দাফন করা ইত্যাদির জন্য মুখে স্বীকার করা শর্ত। কাজেই যে ব্যক্তি অন্তরে বিশ্বাস করে, কিন্তু মুখে স্বীকার করে না, সে আল্লাহর আদালতে মুমিন হিসেবে গণ্য হবে, যদিও দুনিয়ার বিচারে মুমিন বিবেচিত হবে না। (নিবরাস: পৃষ্ঠা ২৫০; ফাতহুল মুলহিম : ১/৪৩৪)। কোরআনুল কারীমে চল্লিশেরও অধিক স্থানে ঈমানের সাথে আমলে সালেহ বা নেক আমলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে, আমলে সালেহ অর্থাৎ সালাত, সাওম ইত্যাদি ঈমানের মৌলিক অংশ নয়। মোটকথা, নেক আমলসমূহ ঈমানের এমন অংশ নয় যে আমল না করলে মুমিন ব্যক্তি কাফিরে পরিণত হবে। বরং আমলে সালেহ তথা সালাত, সাওম ঈমানের পূর্ণতা ও সৌন্দর্য বর্ধক অংশ মাত্র। অর্থাৎ আমলের দ্বারা ঈমান সৌন্দর্য মন্ডিত ও উজ্জলতা প্রাপ্ত হয়। ঈমানের পরিপূর্ণতা সাধিত হয়। এতদপ্রসঙ্গে আল কোরআনের ইরশাদ হয়েছে : যারা ঈমান আনে এবং আমলে সালেহ করে (সূরা হুযুরাত : আয়াত ৯)।
এই আয়াতে কারীমায় ঈমান এবং আমলে সালেহকে পৃথক পৃথক বিষয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে : যদি মুমিনদের দুটি দল দ্ব›েদ্ব। (মারামারিতে) লিপ্ত হয়, তবে তোমরা তাদের মাঝে মিমাংসা করে দাও। (সূরা হুযুরাত : আয়াত ৯)।
দু’দল মুমিনের মারামারিতে লিপ্ত হওয়া কবিরা গোনাহ। এই আয়াতে কবিরা গোনাহ করার পরও তাদেরকে মুমিন আখ্যা দেয়া হয়েছে। মোটকথা, ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত, আদব আখলাক ইত্যাদিতে শরীয়ত প্রণেতার অনুসরণ করাই হলো পূর্ণ ঈমানের পরিচায়ক। (মারামুল কালাম ফী আকাঈদিল ইসলাম : পৃষ্ঠা ৫২)।
তাই, একথা স্পষ্টতঃই বলা যায় যে, নেক আমল হাকীকতে ঈমানের অন্তর্ভূক্ত নয়। কেননা, অন্তরের তাসদিককেই ঈমান বলা হয়। (শরহুল মাকাসিদ : ৩/৪২৩)। বস্তুত : নেক আমলের কম বেশি অনুযায়ী মানুষের ঈমানের স্তর বিভিন্ন হয়ে থাকে। উল্লেখ্য যে, ঈমানী স্তরের বিভিন্নতা ঈমানের নূর জ্যোতি ও পূর্ণতার বিচারেই হয়ে থাকে। অন্যথায় মূল ঈমানে কোনো ব্যবধান নেই বা হয় না।
কেননা, মূল ঈমান হলো ‘তাসদিক’ তথা আন্তরিক বিশ্বাস। মূলত: আন্তরিক বিশ্বাস সকলেরই সমান হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে ইমাম আযম আবু হানীফাহ (রহ:) ‘আলওয়াছিয়্যাহ’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, জানা উচিত আমল ঈমান হতে ভিন্ন ও ঈমান আমল হতে ভিন্ন, পৃথক বস্তু। এর প্রমাণ এই যে, অনেক সময় মুমিন হতে আমল তিরোহিত হয়। তাই বলে তার থেকে ঈমান তিরোহিত হয়েছে বলা যায়েজ হবে না। অনুরূপভাবে ঋতুবতী মহিলা হতে সালাতের হুকুম সাময়িকভাবে উঠে যায়। এজন্য তার থেকে ঈমান উঠে গেছে বলা সিদ্ধ হবে না। (শরহে ফিকহে আকবার : পৃষ্ঠা ৮৯)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।