যেভাবে ৫০০
ক্লাব ফুটবলে গোলের প্রায় সব রেকর্ডই তার দখলে। এবার সেই লিওনেল মেসি উঠে গেলেন আরেক উচ্চতায়। বার্সেলোনার জার্সি গায়ে ৫০০ গোলের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন মেসি।
ইমামুল হাবীব বাপ্পি
দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল বিশ্ব ক্রীড়াযজ্ঞের সবচেয়ে বড় আসর গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক। ৫ আগস্ট রিও ডি জেনিরোর মারাকানা স্টেডিয়ামে যে শিখা জ্বলেছিল ‘একটি নতুন বিশ্ব’ গড়ার শ্লোগানে, টানা ১৬ দিন সেই শিখায় আলোকজ্জ্বল ছিল পৃথিবী নামের এই গ্রহটি। বিশ্বজুড়ে ২০৭ জাতি আর ১১ হাজার ৩০৩ ক্রিড়াবিদ এক সারিতে দাঁড়িয়ে গেয়েছেন মানবতার জয়গান। সব ভেদাভেদ ভুলে মঞ্চে নিজেদের ক্রিড়া শৈলী দেখিয়েছেন ৩০৬টি ভিন্ন ভিন্ন প্রতিযোগিতায়। এরই মাঝে রেকর্ড ভেঙে হয়েছে নতুন রেকর্ড। কেউ জন্ম দিয়েছেন নতুন ইতিহাস। কেই ভবিষ্যতের জন্য দিয়ে রেখেছেন আগাম বার্তা। কেউ আবার সবাইকে ছাড়িয়ে নিজেকে নিয়েছেন এক স্বপ্নীল উচ্চতায়।
দেশ হিসেবে বরাবরের মত এবারও আধিপত্য বজায় রাখে যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে ১৭ বার অলিম্পিকের পদক তালিকার শীর্ষে থেকে আসর শেষ করে উত্তর আমেরিকার দেশটি। ৪৬টি স্বর্ণ পদকসহ এবার মোট ১১৬টি পদক দখলে নেয় তাদের গর্বিত ক্রীড়াবিদরা। ১৯৮৪ সালে ঘরের মাঠ লস এঞ্জেলসের পর এক আসরে এটিই তাদের সর্বোচ্চ পদক জয়। সেবার তারা সাকুল্যে পদক জিতেছিল ১৭৪টি।
তবে মোটের হিসেবে এবারের আসরে চমক দেখিয়েছে যুক্তরাজ্যের ক্রিড়াবীদরা। ঘরের মাঠ লন্ডন অলিম্পিকে তারা মোট ৬৫ পদক জিতে ছিল পদক তালিকার তৃতীয় অবস্থানে। এবার আরো দুটি পদক বেশি নিয়ে উঠে আসে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে। আর সবচেয়ে হতাশা উপহার দিয়েছেন চীনের ক্রিড়াবিদরা। লন্ডনে যেখানে তারা আসর শেষ করেছেল ৩৮টি স্বর্ণসহ মোট ৮৮টি পদক নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে থেকে, এবার তাদের ঝুলিতে ২৬টি স্বর্ণসহ মাত্র ৭০টি পদক। সবচেয়ে খারাপ পারফর্ম করেছে তারা অ্যাথলেটিক্সে। অথচ অ্যাথলেটিক্সই তাদের অন্যতম ফেভারিট ইভেন্ট।
অ্যাথলেটিক্সের ক্রীড়াশৈলিতে এবার শ্রেষ্ঠত্ব দেখায় যুক্তরাষ্ট্র। এই পর্বে মোট ৩১টি পদক জিতেছে তারা, যার মধ্যে ১৩টি-ই স্বর্ণ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদকজয়ী জ্যামাইকার চেয়ে যা ২০টি বেশি। এই পর্বে জাম্যাইকার স্বর্ণ মোট ৬টি। তবে অ্যাথলেটিক্সে একক আধিপত্য দেখালেও যুক্তরাষ্ট্র সর্বোচ্চ সংখ্যক পদক জিতেছে পুলের লড়াই থেকে। যেখানে মোট ৩৩টি পদকের ১৬টিই স্বর্ণ। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়া এই পর্বে স্বর্ণ জেতে ১০টি, যার মধ্যে ৩টি স্বর্ণ।
রিওতে আরো একটি মাইলফলক স্পর্শ করেছে আমেরিকা। অলিম্পিক ইতিহাসে প্রথম দেশ হিসেবে ১ হাজার স্বর্ণ পদক জয়ের মাইলফলক ছাড়িয়েছে তারা। সাকুল্যে যে সংখ্যাটা আড়াই হাজারেরও অধীক। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ঢের এগিয়ে তারা। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বর্ণ পদকের সংখ্য মোট ৩৯৫টি, ২৬১টি গ্রেট বৃটেনের। ২২৬ স্বর্ণ পদক নিয়ে চতুর্থ অবস্থানে চীন।
তিনটি জাতিকে এবার প্রথম অলিম্পিক স্বর্ণ জয়ের উল্লাসে মাতিয়েছে রিও। রাগবির সংক্ষিপ্ত সংস্করণ পুরুষ রাগবি সেভেনে স্বর্ণ জিতেছে ফিজি। আহমেদ আবুঘাউশের (তায়োকান্দো -৬৮কেজি) হাত ধরে প্রথম অলিম্পিক স্বর্ণ জিতেছে জর্ডান। কসোভোর ইতিহাসের স্বর্ণ পাতায় নাম লিখেছেন একজন নারী জুডোকি, নাম মাজলিন্ডা কালমেন্ডি।
যুক্তরাষ্ট্রের আধিপথ্যের মুলে এবার ছিল তিনটি নামÑ মাইকেল ফেল্পস, কেটি লেডেকি ও সিমোনে বাইলস। ফেল্পস তার অলিম্পিক পদক সংখ্যাকে নিয়ে যান ধরা ছোঁয়ার বাইরে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম হয়তো তার এই কীর্তি উর্ধে¦ চেয়ে দেখবে, ভাঙা তো পরের কথা হয়তো ছুঁতেও পারবে না। ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে সুইমিং পুলে কি ঝড়ই না তুলেছিলেন মাইকেল ফেল্পস। ৮ টি ইভেন্টের সব ক’টিতে স্বর্ন, যার মধ্যে ৭টিই আবার বিশ্বরেকর্ড! ১৮টি স্বর্ণসহ মোট ২২টি অলিম্পিক পদক নিয়ে রিওতে পা রেখেছিলেন ফেল্পস। আসর শেষে যে সংখ্যাটা পৌঁছে ২৩ স্বর্ণ সহ মোট ২৮টিতে। অলিম্পিক ইতিহাসে যে রেকর্ড শুধুই তার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৮টি পদক (৯টি স্বর্ণ) সোভিয়েত জিমন্যাস্ট লারিসা ল্যাটিনিনার।
ফেল্পসের মত পুলে ঝড় তুলে ৪টি স্বর্ণ ও একটি রৌপ্য জিতেনেন ১৯ বছর বয়সী নারী সাঁতারু কেটি লেডেকি। আর নিজের প্রথম অলিম্পিকে জিমন্যাস্টিক্সে বিষ্ময় উপহার দিয়ে ৪টি স্বর্ণসহ ৫টি পদক জিতে নেন ১৯ বছর বয়সী সিমোনে বাইলস। এবারের অলিম্পিকে ব্যক্তিগত পদক জয়ের সংখ্যায়ও সবাইকে ছাড়িয়ে যথাক্রমে এই তিন আমেরিকান। চতুর্থ সর্বোচ্চ ৩টি স্বর্ণসহ মোট ৪টি পদক জেতেন হাঙ্গেরির সাঁতারু কাতিনকা হসসু। এর পরেই স্প্রিন্ট বিষ্ময় উসাইন বোল্টের নাম।
রেকর্ড গড়ে আবার তা ভাঙার জন্যে। এটাই নিয়ম। কিন্তু প্রচলিত নিয়মকে এই অনেকার্থেই বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিলেন জ্যামাইকান বজ্রবিদ্যুৎ। নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যা কারো পক্ষে ছোঁয়া অসম্ভব (প্রায়)। হয়তো তার এই কীর্তি অক্ষত থাকবে বহুকাল। তিন অলিম্পিকে অংশ নিয়ে ১০০ ও ২০০ ও ১০০ মিটার রিলে দৌড়ে অংশ নিয়ে জিতেছেন সম্ভব্য ৯টি স্বর্ণ, যাকে বলা হচ্ছে ‘ট্রিপলের ট্রিপল’। ট্রিপল তো দুরের কথা টানা দুই আসরেই যে রেকর্ড নেই কারো। অলিম্পিক অ্যাথলেটিক্সে ৯টি স্বর্ণ জয়ের রেকর্ড আছে আরো দুই জনের। কিংবদন্তি কার্ল লুইস (মোট ১০টি) ও পার্তো নুর্মির (মোট ১২টি)। তবে জ্যামাইকান বজ্রবিদ্যুতের কীর্তিটা তাদেরকেও ছাড়িয়ে। লুইসের নয়টি স্বর্ণের চারটি এসেছে লম্বা লাফ থেকে। আর নুর্মি ছিলেন দূরপাল্লার দৌড়বিদ। অলিম্পিক ইতিহাসে কেউই কখনো টানা তিন আসরে স্প্রিন্টে সোনা জয়ের কীর্তি দেখাতে পারেননি। সবচেয়ে বড় কথা অলিম্পিকে অংশ নিয়ে প্রথম ছাড়া কখনো দ্বিতীয় হননি ক্যারিবিয় তারকা। বোল্টের মহত্বটা এখানেই। অ্যাথলেটিক্সের ইতিহাসে এভাবেই ট্রাক এন্ড ফিল্ডের রাজা নিজেকে নিয়ে গেছেন অস্পৃশ্য উচ্চতায়। নিজেকে প্রমাণ করেছেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ দৌড়বিদ হিসেবে।
স্প্রিন্টের কথা আসলে এসে যায় আরো একটি নামÑ মোহাম্মদ ফারাহ। ৪ বছর আগের লন্ডন অলিম্পিক থেকে এই ইভেন্টে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে পা রেখেছিলেন ব্রাজিলের রিওতে। তখনই জানান দিয়েছিলেন, কিংবদন্তি’ হতেই এসেছেন। সেই স্বপ্ন পূরণে বাকি ছিলো কেবল একটি সোনালী আভায় মোড়ানো পদক গলায় ঝোলানো। সেটিও করে ফেলেন গ্রেট ব্রিটেনের এই দৌড়বিদ। নিজেকে কিংবদন্তির পর্যায়ে আগেই নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে ৫ হাজার মিটার দৌড়ের সোনালী পদকটাও নিজের করে নিয়ে কিংবদন্তি হওয়ার সব বন্দোবস্ত পাকা করে ফেলেন। পরপর দুবার, ২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিকের পর এবারের রিও অলিম্পিকেও ১০ হাজারের পর ৫ হাজার মিটারের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখে ডাবল জয়ের ‘ডাবল’ কীর্তি গড়লেন তিনি। ১৯৭৬ সালের মন্ট্রিল অলিম্পিকে এমন কীর্তি শেষবারের মতো করেছিলেন ফিনল্যান্ডের ল্যাসে ভিরেন। অলিম্পিকের দূরপাল্লার দুই ইভেন্ট ১০ ও ৫ হাজারে স্বর্ণ জিতেছিলেন পরপর দুবার (১৯৭২ মিউনিখ ও ১৯৭৬ মন্ট্রিল)। ৪০ বছর পর এমন কীর্তির পুনরাবৃত্তি করলেন সোমালিয়ায় জন্ম নেওয়া ৩৩ বছর বয়সী ফারাহ। চলে গেলেন অলিম্পিকের সর্বকালের সেরারের দলে। শেষ ল্যাপের লড়াইয়ে কেউই ফারাহর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেননি। ফারাহ সময় নেন ১৩ মিনিট ৩.৩০ সেকেন্ড। ওদিকে স্প্রিন্টের নারী বিভাগে ফ্লোরেন্স গ্রিফিত-জয়নারের পর ডাবল জিতেন জ্যামাইকান স্প্রিন্টার এলাইন থম্পসন।
এছাড়াও ব্যক্তিগত অর্জনে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়েছেন অনেকে। জাপানের কহেই উচিমুরের কথাই ধরুন। জিমন্যাস্টিক্সের ৪৪ বছরের ইতিহাসে তিনিই প্রথম অল-অ্যারাউন্ডে টানা দুইবার স্বর্ণ জেতেন। দলীয় ইভেন্টেও ২০০৪ সালের পর দেশকে স্বর্ণ জয়ে অবদান রাথেন উচিমুরা। টেনিসের একক দৈরথে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে টানা দুইবার স্বর্ণ জিতে ইতিহাসের অংশ হয়েছেন অ্যান্ডি মারেও। টানা দুই আসরে ডিক্যাথলনে স্বর্ণ জয়ের রেকর্ড গড়েন যুক্তরাজ্যের অ্যাস্টন এটোন। প্রথম ক্রীড়াবিদ হিসেবে ডাইভিংয়ে ৫টি স্বর্ণ নিয়েছেন চীনের জু মিনজিয়া। এছাড়া আর্চ্যারিতে সম্ভব্য সব ক’টি (৪টি) স্বর্ণ দখলে নিয়ে রেকর্ড গড়ে দক্ষিণ কোরিয়া। গত ৯ অলিম্পিকে আর্চ্যারির ৩৬টি স্বর্ণের ২৩টি-ই যায় দক্ষিণ কোরিয়ার দখলে।
সব মিলে ৭টি খেলায় মোট ২৭টি রেকর্ড ভেঙেছে রিও অলিম্পিক। এগুলো হলÑ সাঁতার, ভারোত্তলন, ট্রাক সাইক্লিংয়, অ্যাথলেটিক্স, আর্চ্যারিত মডার্ন প্যানথেলন ও শুটিংয়ে।
আবার জোসেফ স্কুলিংয়ের মত নবীনেরা ফেল্পসের সত মহীরুহকে হারিয়ে বার্তা দিয়েছে আগামীকে শাসন করার। এমন বিষ্ময় জন্ম দেয়ার টনিকটা তিনি পেয়েছিলেন বেইজিং অলিম্পিককে সামনে রেখে সিঙ্গাপুরে ট্রেনিং ক্যাম্পে ফেল্পসেরই কাছ থেকে! সেই ট্রেনিং ক্যাম্পে সিঙ্গাপুরের ১৩ বছরের এক কিশোর সাঁতারু মাইকেল ফেল্পসকে দেখে তাকে আইডল মেনে ভবিষ্যতে এই কিংবদন্তীর মতো হতে চেয়েছিলেন, ফেল্পসের সঙ্গে ছবি তুলে তা ফ্রেমে লাগিয়ে টানিয়ে রেখেছিলেন নিজ শয়ন কক্ষে। সেই ক্ষুদে সাঁতারুকে চিনতে হয় ফেল্পসকে নিজের অলিম্পিক ক্যারিয়ারে শেষ ইভেন্টে এসে ! ১০০ মিটার বাটারফ্লাই ইভেন্টে ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে গড়েছিলেন বিশ্বরেকর্ড, ৮ বছর পর সেই ইভেন্টেই সিঙ্গাপুরের উদীয়মান সাঁতারু জোসেফ স্কুলিংয়ের বিশ্বরেকর্ড দেখতে হলো ফেল্পসকে, তাও আবার পাশের লেন থেকে ঝাঁপ দেয়া সিঙ্গাপুর যুবকের কাছে হারতে হলো ফেল্পসকে। যে ছেলেটি কি না অলিম্পিক ইতিহাসে সিঙ্গাপুরের প্রথম সাঁতারু হিসেবে জিতেছেন স্বর্ন।
এমনই সব ঘটন-অঘটনের জন্ম দেওয়া রিওর এই ক্রীড়াযজ্ঞ শুরু হয়েছেল বিশ্বজুড়ে জঙ্গী হামলা, জিকা ভাইরাস ও দেশের রাজনৈতিক দোলাচলের মধ্য দিয়ে। সব শঙ্কাকে উড়িয়ে সফলভাবেই শেষ হল অলিম্পিকের ৩১তম আসর। এবার অপেক্ষা টোকিওর। চার বছর পর ২০২০ সালে আবার বিশ্ব ক্রিড়াবীদদের মিলনমেলা দেখা যাবে সূর্যদয়ের দেশ খ্যাত জাপানের ইয়েকোহামায়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।