Inqilab Logo

বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সউদী আরব, ইউএই নাকি কাতার, হারলো কে?

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৭ জানুয়ারি, ২০২১, ৫:৪০ পিএম

সাড়ে তিন বছর আগে ২০১৭ সালের জুনে সউদী আরব এবং তার চার ঘনিষ্ঠ আরব মিত্র - সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর এবং বাহরাইন হঠাৎ করে কাতারের ওপর সর্বাত্মক অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক অবরোধের ঘোষণা দিলে, ছোট এই উপসাগরীয় দেশটিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। খাবার সঙ্কটের আতঙ্কে দোকানপাটে হামলে পড়েছিল লোকজন। দোহার শেয়ার বাজারে রাতারাতি ধস নামে। অনেক কাতারি নাগরিক মিশর, সউদী আরব, আমিরাতে আটকা পড়েন। কিন্তু দুদিন আগে মঙ্গলবার যখন কাতারি আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি উপসাগরীয় জোটের এক বৈঠকে যোগ দিতে সউদী আরবের আল উলা শহরে নামেন, তখন তাকে রাজকীয় সম্মান দেখান সউদী যুবরাজ মোহামেদ বিন সালমান স্বয়ং।

আনুগত্য আদায়ে যে ব্যক্তি ছোট্ট প্রতিবেশী কাতারকে হাঁটুর ওপর বসাতে চেয়েছিলেন, ক্ষমতাধর সেই সউদী যুবরাজ কাতারি আমিরকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে হাজির হন। এরপর নিজে গাড়ি চালিয়ে কাতারের আমিরকে আল ওলের প্রাচীন পুরাকীর্তি দেখিয়ে বেড়িয়েছেন সউদী যুবরাজ। এসব ভিডিও চিত্র সউদী রাষ্ট্রীয় টিভিতে দিনভর বার বার দেখানো হয়েছে। মঙ্গলবার আল উলাতেই সম্পর্ক পুন:স্থাপনের এই চুক্তি হয়েছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যে অবরোধ আরোপের সময় আল জাজিরা টিভি নেটওয়ার্ক বন্ধ, ইরানের সাথে সম্পর্কে রাশ টানা এবং তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি বন্ধ সহ যে ১৩টি দাবি ১০ দিনের আল্টিমেটাম দিয়ে সউদীরা কাতারের হাতে তুলে দেয়, তার একটিও কাতার তোয়াক্কা করেনি।

জানা গেছে, অবরোধ দিয়ে কাতারিদের প্রতি বৈষম্যের যে মামলা আন্তর্জাতিক আদালতে ঐ চারটি দেশের বিরুদ্ধে কাতার করেছিল, শুধু সেই মামলা প্রত্যাহার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা। অন্য কোনো ছাড়ই দেয়নি। অবরোধ ওঠানো বা সম্পর্ক পুনঃ:স্থাপন দিয়ে কোনো দেন-দরবারও কাতার করেনি। ঐ উদ্যোগ ছিল সউদী আরবের এবং পাশাপাশি ডোনাল্ড ট্রাম্পের।লন্ডনে রাজনৈতিক ঝুঁকি সম্পর্কিত গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারেস্টের প্রধান এবং মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির বিশ্লেষক সামি হামদি বলেন, ‘সউদী আরব কাতারের সাথে সমঝোতার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল। সউদীরা যুক্তরাষ্ট্রে বাইডেন সরকার নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। সুতরাং জো বাইডেন ক্ষমতা নেয়ার আগে বিতর্কিত বিষয়গুলো তারা যতটা সম্ভব ফয়সালা করার চেষ্টা করছে।’ তিনি বলেন, ইউএই কাতারের সাথে সমঝোতায় একেবারেই আগ্রহী ছিলনা, কিন্তু সউদীদের চাপে তাদের রাজী হতে হয়েছে। ইউএই মনে করে আমেরিকায় নতুন প্রশাসনের কাছ থেকে চাপ আসলেও তা সামাল দেয়ার ক্ষমতা এখন তাদের রয়েছে। তারপরও সউদী যুবরাজের কথা হয়ত আবুধাবির যুবরাজ প্রত্যাখ্যান করতে চাননি।’

অবশ্য ডোনাল্ড ট্রাম্পও প্রথম দিকে এই অবরোধ নিয়ে মাথা না ঘামালেও সাম্প্রতিক সময়ে কাতার ও সউদী আরবের মধ্যে সমঝোতায় আগ্রহী হয়ে পড়েন। কুয়েত এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় এই সমঝোতা নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয় সেপ্টেম্বর মাসে। প্রথমে কথা হয় সউদী আরব এবং কাতারের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি নিয়ে, কিন্তু কাতার শর্ত দেয় চুক্তি হতে হবে ব্যাপক-ভিত্তিক যেখানে অবরোধকারী বাকি তিনটি দেশকেও আনতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) এক অনলাইন প্রকাশনায় গবেষক জন বি অল্টারম্যান লিখেছেন - যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্র দপ্তর হোয়াইট হাউজকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে কাতারের ওপর অবরোধ অর্থহীন এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইরানকে একঘরে করার নীতির জন্য এটি ক্ষতিকর। ইরানের সাথে যৌথভাবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্যাস ক্ষেত্রের উন্নয়নে যে কাজ কাতার করছিল, অবরোধ আরোপের পরে সেই সহযোগিতা তারা আরো বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া, সউদী আরব এবং আমিরাতের আকাশসীমা ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাতার এয়ারওয়েজ বিকল্প হিসাবে ইরানের আকাশসীমা ব্যবহার শুরু করে যার ফি হিসাবে প্রতি বছর ১০ কোটি ডলার তারা ইরানকে দিচ্ছে। উপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সেনাঘাঁটিটি কাতারে। ফলে এই অবরোধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নীতি নির্ধারকের মধ্যে প্রথম থেকেই অস্বস্তি ছিল। তারা হোয়াইট হাইজকে চাপ দিয়ে গেছে।

সউদী আরবের আশা জল-স্থল-আকাশে অবরোধের চাপে কাতারের অর্থনীতির এমন বারোটা বাজবে যে কাতার হাঁটু গেড়ে তাদের দাবি মানতে বাধ্য হবে। প্রথম কয়েক সপ্তাহ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল ২৫ লাখ জনসংখ্যার ছোট দেশটিতে। খাবারের সঙ্কটের ভয়ে মানুষজন দোকান পাটে হামলে পড়েছিল। শেয়ার বাজারে ধস নামে। কাতারের ৩৭ বছর বয়সী আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি আপোষ করতে অস্বীকার করেন। বদলে সাহায্যের জন্য হাত বাড়ান তুরস্ক এবং ইরানের কাছে। সউদী আরবের বৈরি ঐ দুই দেশ জরুরী ভিত্তিতে কাতারে খাবার পাঠায়। সউদী আরব সামরিক অভিযান চালাতে পারে এই ভয়ে তুরস্কের কাছে সামরিক সাহায্য চায় কাতার। এক বছরের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ায় কাতার।

আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিসংখ্যান বলছে অবরোধে কাতারের অর্থনীতির কোনো ক্ষতিতো হয়নি, বরং তিন বছর পর কাতার এখন খাদ্য উৎপাদন সহ অনেকে ক্ষেত্রে অনেক স্বাবলম্বী। একইসাথে আন্তর্জাতিক মহলে ছোটো এই দেশটি তাদের সম্মান এবং ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। সউদী আরব এবং ইউএই’র শাসকদের ঘনিষ্ঠ বিশ্লেষকরাও এখন বলছেন সাড়ে তিন বছরের অবরোধ কিছুই অর্জিত হয়নি। আরব আমিরাতের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আব্দুল্লাহ খালেক আব্দুল্লাহ নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকাকে বলেন, ‘এই অবরোধ কাতারকে কোনা অসুবিধাই করতে পারেনি, বরঞ্চ কাতার এখন ভাবতে শুরু করেছ যে তারা জিতেছে।’

সউদী আরব এবং ইউএইর প্রধান রাগ যে কাতার তাদের নীতির সাথে তাল না মিলিয়ে স্বতন্ত্র সিদ্ধান্তে ইরান এবং তুরস্কের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক করছে। এছাড়া, কাতার মধ্যপ্রাচ্যে এমন সব ইসলামী গোষ্ঠী এবং সংগঠনকে সাহায্য করছে যারা সন্ত্রাসে জড়িত, যে অভিযোগ অবশ্য কাতার সবসময় প্রত্যাখ্যান করে। কাতারি টিভি নেটওয়ার্ক আল জাজিরা নিয়েও চরম খাপ্পা সউদী এবং তার তিন মিত্র। তাদের কথা - আল জাজিরা মুসলিম ব্রাদারহুডের মত কট্টর ইসলামিদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে, এবং আরব সরকারগুলোর সমালোচনায় লিপ্ত। কিন্তু সমঝোতা চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলার সময় সউদী বা আমিরাতের শর্ত নিয়ে কোনো কথাই শুনতে চায়নি কাতার।

তাহলে কি যে সউদী আরব কাতারকে পর্যুদস্ত করতে চেয়েছিল, তারা এখন নিজেরাই মাথা নোয়াচ্ছে? সামি হামদি মনে করেন পরাজয় যতটা না হয়েছে সউদী আরবের তার চেয়ে বেশি হয়েছে কাতারের ঘোরতর শত্রু সংযুক্ত আরব আমিরাতের। তিনি বলেন, ‘কাতারের সাথে বড় টক্কর আসলে ইউএইর। সউদীরা অবশ্যই পথ বদলেছে, কিন্তু ইউএই বাধ্য হচ্ছে সউদীদের নতুন পথে হাঁটতে।’ সামি হামদি মনে করেন ইউএই এবং সউদী আরবের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে চাইছে কাতার এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের তারা সউদীদের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ ছাড়েনি। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় কাতার এখন চেষ্টা করবে ইউএইর ওপর সউদীদের যে নির্ভরতা সেটা কমাতে। সউদী আরবকে হয়তো কাতার দেখাতে চাইবে যে ইউএই তাদেরকে যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ফায়দা দিতে পারে, তারা তার চেয়েও বেশি ছাড়া কম পারবে না..তাদের কাছে আল জাজিরা রয়েছে।’ সামি হামদি বলেন, আল জাজিরাতে গত কদিনে হঠাৎ করে সউদী আরব নিয়ে ‘ইতিবাচক’ প্রচার চোখে পড়েছে। সউদী সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ বিশ্লেষকদের মতামত নেয়া হচ্ছে। দুদিন আগে রিয়াদের আধুনিকায়ন নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি প্রচার হয়েছে তারা।

সউদী-কাতার সমঝোতার মধ্যস্থতায় প্রধান ভূমিকা রেখেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাই জ্যারেড কুশনার। কিন্তু দুদিন পর যিনি ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছেন তাকে গুরুত্ব কেন দিল কাতার?

সামি হামদি মনে করেন, অনেক মানুষের মত কাতারিরাও হয়ত মনে করছে ট্রাম্প নিজে অথবা তার পরিবারের কেউ হয়তো চার বছর পর হোয়াইট হাউজে আবারো ফিরতে পারেন। ফলে, ট্রাম্পকে চটাতে চায়নি তারা। ট্রাম্প এই সমঝোতার বদলে কাতারকে কোনো শর্ত কি দিয়েছেন? তার কোনো স্পষ্ট কোনো ইঙ্গিত এখনও নেই। অবশ্য তেমন কোনো প্রতিশ্রুতি এখন অর্থহীনও কারণ জো বাইডেন মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে কী করেন অঞ্চলের অন্য সব দেশের মত কাতারও এখন সেই অপেক্ষায়। তাছাড়া, এ অবরোধ নিয়ে কাতার এবং সউদী আরব ও তার মিত্রদের মধ্যে যে অনাস্থা ও তিক্ততা তৈরি হয়েছে তাতে এই বোঝাপড়া কতদিন টিকবে তা নিয়েও অনেক পর্যবেক্ষক সন্দিহান। সিএসআইএসের জন অল্টারম্যান বলেন, ‘বোঝাপড়া হয়েছে কিন্তু ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অবিশ্বাস, অনাস্থা, ক্রোধ দূর হয়নি।’ তার মতে, আস্থা ফিরতে বছরের পর বছর লাগতে পারে। পরিস্থিতি নতুন সঙ্কটেও মোড় নিতে পারে। সূত্র: বিবিসি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ