দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
নামায ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম বিধান, যা প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ নর-নারীর উপরই ফরজ। সেই সাথে পুরুষের জন্য রয়েছে মসজিদে নামাজ পড়ার বিধান। এই বিধান কি শুধুই পরুষর জন্য নাকি নারীর জন্যও? কুরআন ও হাদিসে কী এসেছে? নারীরা মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়বে কিনা এ নিয়ে আমাদের সমাজে কিছু ইখতিলাফ পরিলিক্ষত হচ্ছে। মূলত এটি কোনো ইখতিলাফের বিষয় নয়। কেননা, হাদিসে এর স্পষ্ট সমাধান রয়েছে। হয়তো আমাদের ইলমের সংকীর্ণতার কারণে অথবা দুই-একটি হাদিসের কিতাবে ইসলামকে সীমাবদ্ধ করার কারণে এ মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে। পবিত্র কুরআনুল করিমে আল্লাহ তা‘আলা নারী জাতিকে উদ্দেশ্য করে ইরশাদ করেছেন- ‘আর তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাক-জাহেলি যুগের মতো সৌন্দর্য প্রদর্শন কোরো না। তোমরা সালাত কায়েম করো, যাকাত প্রদান করো এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করো।’(সূরা আহযাব ঃ ৩৩) হুযুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ ছিল সোনালী যুগ, সে যুগের মানুষদেরকে বলা হত স্বর্ণ মানব। মুসলিম নারীরাও ছিলেন ঈমানী চেতনায় বলীয়ান, যাদের অন্তর ছিল পূত-পবিত্র, যাদের ব্যাপারে সামান্যতম কূধারণার কল্পনাও করা যায় না। তারা হলেন কেয়ামত অবধি সকল নারী জাতির জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, আদর্শ পরাকাষ্ঠা। যাদের অনুপম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং অতুলনীয় পর্দা থাকার কারণে ফিৎনার কোন আশংকাই ছিল না। তারা রাতের আধারে কেবলমাত্র ফজর ও ইশায় আপাদমস্তক ঢেকে অত্যন্ত আড়ম্বরহীনতার সহিত অতি সংগোপনে খুব হেফাজতে রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইক্তেদার সৌভাগ্য অর্জনার্থে মসজিদে গমন করতেন। তথাপি শান্তির আধার, মানবতার মুক্তিদূত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে মার্জিত ভাষায়, কোমলভাবে মসজিদে না আসার প্রতি অনুপ্রাণিত করেছেন। তাদের ঘরের কোণকে তাদের জন্য উত্তম, উৎকৃষ্টতম মসজিদ, অধিক সওয়াবের মাধ্যম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে: মহিলাদের মসজিদে নামাজ পড়া অপেক্ষা ঘরে নামাজ পড়ায় পঁচিশ গুণ ছওয়াব বেশী হয়। (মুয়াত্তায়ে ইমাম মালিক; দায়লামি,২/৩৮৯) অন্যত্র রয়েছে- মহিলাদের জন্য নিজ কক্ষে নামায আদায় করা আন্দর মহলে আদায় করা থেকে উত্তম। আন্দর মহলে আদায় করা দালানে আদায় করা থেকে উত্তম। দালানে আদায় করা উঠানে আদায় করা থেকে উত্তম। (কানযুল উম্মাল, হাদীস:৮৬৫)
উপরোক্ত হাদীস বর্ণনা করে ইমাম আলা হযরত শাহ আহমদ রেযা খাঁন রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন: মহিলা বৃদ্ধা হোক কিংবা যুবতী নামায আদায়ের জন্য মসজিদে গমন করাই নিষেধ। মসজিদে ও জামাআতে অংশগ্রহণ করা মহিলাদের জন্য ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে, বরং নিষিদ্ধ। এ প্রসঙ্গে বর্ণিত সহিহ হাদিসসমূহ বিশ্লেষণ করলে নিম্নোক্ত মসজিদ অপেক্ষা উত্তম। খ. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই নারীদেরকে মসজিদে গমনের প্রতি নিরুৎসাহিত করেছেন। গ. আর হাদিসের কয়েকটি বর্ণনা, যা নারীদের মসজিদে আসা প্রসঙ্গে পাওয়া যায়,{যেমন:‘তোমরা তোমাদের নারীদের মসজিদে যাতায়াতে বাধা দিও না। তবে তাদের ঘরই তাদের (নামাযের জন্য) উত্তম স্থান।’} তা প্রাথমিক যুগের কথা, তখন নারী- পুরুষ কেউ ইসলামের সকল মাসআলা জানতেন না, তখন কয়েকটি কঠিন শর্তসহকারে রাতের আঁধারে নির্দিষ্ট দরজা দিয়ে একদম পেছনের কাতারে নারীদের দাঁড়ানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। দৈনন্দিন জীবনের নিত্য নতুন শরীয়তের বিভিন্ন হুকুম, আহকাম অবতীর্ণ হত, সে সকল বিষয় জানার জন্যও মহিলাদের মসজিদের জামাআতে আসার প্রয়োজন ছিল। তাছাড়া মহিলাদের অনেক জটিল বিষয়ে মাসআলা জানার প্রয়োজন হত, যা স্বয়ং রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই কেবল সমাধান দিতে পারতেন। তাই নারীদের মসজিদে আসার ব্যাপারে বাধা দিতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু বর্তমানে কিতাবাদী, আলেমদের ওয়াজ, নসীহত ও আরো বিভিন্ন পদ্ধতিতে শরীয়তের বিষয়াদির প্রচার-প্রসার ঘটেছে, কাজেই মসজিদে গিয়ে ইমাম সাহেবের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণের কোন প্রয়োজন নেই। সুতরাং ওইসব হাদিস দ্বারা বর্তমানে নারীদের মসজিদে গমন জায়েয বলা যাবে না। তাই উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়েশা ছিদ্দিীকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন, যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখতেন যে, নারীরা সাজসজ্জা গ্রহণে, সুগন্ধি ব্যবহারে ও সুন্দর পোশাক পরিধানে কী পন্থা উদ্ভাবন করেছে তাহলে অবশ্যই তাদেরকে মসজিদে যেতে নিষেধ করে দিতেন, যেমন নিষেধ করা হয়েছিল বনী ইসরাঈলের নারীদেরকে। আর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা আমীরুল ফারুকে আযম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফতকালে ছোট ছোট পাথর মেরে মহিলাদের মসজিদে গমনে বাঁধা দিতেন। বুখারী শরিফের ব্যাখ্যাকার আল্লামা বদরুদ্দিন আইনী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) উপরোক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, ‘হযরত আয়েশা ছিদ্দিীকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার এই মন্তব্য তো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুনিয়া থেকে বিদায়ের কিছুদিন পরের নারীদের সম্পর্কে। অথচ আজকের যুগের নারীদের উগ্রতা আর বেহায়াপনার হাজার ভাগের এক ভাগও সে যুগে ছিল না। তাহলে এ অবস্থা দেখে তিনি কী মন্তব্য করতেন?’ আল্লামা বদরুদ্দিন আইনী রহমাতুল্লাহি আলাইহি নিজ যুগ তথা হিজরি নবম শতাব্দীর নারীদের সম্পর্কে এ কথা বলেছেন। তাহলে আজ হিজরি পঞ্চদশ শতাব্দীতে সারা বিশ্ব যে অশ্লীলতা আর উলঙ্গপনার দিকে ছুটে চলেছে, বেপর্দা আর বেহায়াপনার আজ যে ছড়াছড়ি, মেয়েরা যখন পুরুষের পোশাক পরিধান করছে, পেট-পিঠ খুলে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ঠিক সে মুহূর্তে অবলা মা-বোনদের সওয়াবের স্বপ্ন দেখিয়ে মসজিদে আর ঈদগাহে টেনে আনার অপচেষ্টা বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। অথচ এর জন্য দলিল দেওয়া হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগের নারীদের দ্বারা। এ যুগের নারীরা কি সে যুগের নারীদের মতো? কস্মিনকালেও নয়। তা সত্তে¡ও সে যুগেই নারীদের মসজিদে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। তাহলে কিভাবে এ যুগের নারীদের মসজিদে ও ঈদগাহে গিয়ে নামাযের জন্য উৎসাহ দেওয়া যায়? বরং বর্তমানে নারীদের বেহায়াপনা, অশ্লীলতা, পর্দাহীনতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফেতনা-ফ্যাসাদ হওয়াটাই স্বাভাবিক। এসব ফেতনা-ফ্যাসাদ থেকে বাঁচার জন্যই মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন: ‘ফেতনা-ফ্যাসাদ হত্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর অপরাধ।’ তাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ফতওয়া হলো- বর্তমান ফিৎনার যুগে কুলুষযুক্ত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বৃদ্ধা, যুবতী, কিশোরী, কোন মহিলারই মসজিদে গমন বৈধ হবে না। মহিলারা পাঁচ ওয়াক্ত, জুমুয়া, তারাবীহ ও ঈদের নামাযসহ যে কোন নামায জামাআতে আদায় করার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হওয়া বা মসজিদে যাওয়া মাকরূহে তাহরীমী।” (সহিহ বুখারী, হাদীস: ৮৬৯, ৮৯৯; সহিহ মুসলিম, হাদীস :৪৪৫,১০১৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৫৬৭ উমদাতুল ক্বারী, ২/১৫৬;; আল ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু : ১/১১৭২; মালফুযাতে আলা হযরত,২/৩৫৯-৩৬০; দুররে মুখতার,২/২৬৭,ফতহুল কাদীর,১/৩৭৬)
মহিলারা মাজারে গমন প্রসঙ্গে আলা হযরত রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, গুনিয়া কিতাবে রয়েছে, মহিলারা মাযারে গমন করা জায়েয কি নাজায়েয- এ কথা জিজ্ঞেস করো না, বরং জিজ্ঞাসা করো ঐ মহিলার উপর আল্লাহ তায়ালা ও কবরবাসীর পক্ষ থেকে কি পরিমাণ লানত বর্ষিত হয়, যখন সে ঘর থেকে সংকল্প করে তখন থেকে লা’নত শুরু হয়ে যায়। আর যতক্ষণ পর্যন্ত পূনঃরায় ঘরে ফিরে আসে না ততক্ষণ পর্যন্ত ফেরেস্তারা লা’নত করতে থাকে। অতএব হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজায়ে আকদাস ব্যতিত কোন মাযারে মহিলাদের গমন করার অনুমতি নেই। রাসূলুল্লাহর রওজায় উপস্থিত হওয়া মহা সুন্নাত, ওয়াজিবের নিকটবর্তী এবং কুরআনুল করিমে ইহা পাপরাশি মোচনের ও মাগফিরাতের ঠিকানা হওয়ার ব্যাপারে ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে- “এবং যখন তারা নিজ আত্মার উপর জুলুম করে আপনার দরবারে উপস্থিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, আর রাসূল তাদের জন্য শুপারিশ করবে তবে অবশ্যই আল্লাহ তায়ালাকে তারা তাওবা কবুলকারী এবং অতি দয়ালু হিসাবে পাবে।” (সুরা নিসা:আয়াত-৬৪) নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:“যে ব্যক্তি আমার রওজা যিয়ারতে উপস্থিত হবে, তার জন্য আমার শুপারিশ অবধারিত। অন্যত্র ইরশাদ করেন:“যে ব্যক্তি হজ্ব করেছে আর আমার রওজা যিয়ারত করেনি, নিশ্চয় সে আমাকে কষ্ট দিলো।” প্রথমত: এটা (রওজার যিয়ারত) ওয়াজিব আদায়, দ্বিতীয়ত: তাওবা কবুল, তৃতীয়ত: শুপারিশের মহাধন অর্জন, চতুর্থত: নবীজিকে কষ্ট দেয়া থেকে পরিত্রাণের মাধ্যম। পক্ষান্তরে অন্যান্য কবরস্থান, মাযার সমুহের ব্যাপারে এমন কোন জোর তাকিদ নেই। ফিতনা-ফ্যাসাদের সম্ভাবনাও রয়েছে। যদি প্রিয়জনের কবর হয়, তবে ধৈর্যহারা হবে। আর আউলিয়ায়ে কেরামের মাযারে পার্থক্যকরণ ব্যতিরেকে বেয়াদবী করা কিংবা অজ্ঞতাবশত সম্মানে অতিরঞ্জিত করার সম্ভাবনা রয়েছে। যেমনটা পরিলক্ষিত হয় এবং অনুমেয়। তাই বিরত থাকাটাই নিরাপদ। কেননা, সমুদ্রের ভিতরে অনেক উপকার রয়েছে, কিন্তু যদি নিরাপত্তাই উদ্দেশ্য হয়, তবে নদীর কিনারায় অবস্থান করা বাঞ্চনীয়। (উমদাতুল ক্বারী, ২/৪২০; শুয়াবুল ঈমান, হাদীস:৪১৫৯; মাকাসিদুল হাসানা, হাদীস:১১১)
লেখক: আরবী প্রভাষক, রাণীরহাট আল আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদ্রাসা; রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।