হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মোবায়েদুর রহমান
সাম্প্রতিক দুটি খবর দিয়ে আজকের লেখা শুরু করছি। দুটি দুঃখজনক ঘটনার খবর। একটি ঘটেছে গত শনিবার সাতক্ষীরায়। আরেকটি হবিগঞ্জে গত ১৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই যে, দুটি ঘটনাই ঘটেছে ভারতীয় টেলিভিশনের একটি বাংলা সিরিয়াল দেখাকে কেন্দ্র করে। ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলটির নাম ‘স্টার জলসা’। আর সিরিয়ালটির নাম ‘কিরণমালা’। কিরণমালা দেখাকে কেন্দ্র করে গত শনিবার ২০ আগস্ট সাতক্ষীরায় যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটি নি¤œরূপ :
বাড়ির সবাই ভারতীয় টিভি চ্যানেল স্টার জলসায় কিরণমালা দেখায় মগ্ন। আর সেই ফাঁকে পানিতে ডুবে মারা গেছে দুই শিশু। নিহতরা হলোÑ সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার আসাদুর রহমান আসাদ (৬) ও মনিরা খাতুন (৪)। আসাদ আবদুস সবুর মোল্লার ছেলে এবং মনিরা মোমিন মোল্লার মেয়ে। তারা চাচাতো ভাইবোন। শনিবার সকাল ৯টার দিকে উপজেলার আটুলিয়া ইউনিয়নের বাদুড়িয়া গ্রামে এ দুর্ঘটনা ঘটে। শ্যামনগর থানার ওসি এনামুল হক জানান, শিশু দুটি বাড়ির পাশে পুকুর পাড়ে খেলার সময় পানিতে পড়ে যায়। অনেকক্ষণ তারা নিখোঁজ থাকার পর তাদের লাশ পানিতে ভাসতে দেখে গ্রামবাসী উদ্ধার করে।
দ্বিতীয় ঘটনাটি পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট মোতাবেক নি¤œরূপ :
হবিগঞ্জে ভারতীয় টিভি সিরিয়াল কিরণমালা দেখাকে কেন্দ্র করে বিরোধের জেরে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে আহত হয়েছেন নারী ও শিশুসহ কমপক্ষে দুই শতাধিক লোক। বৃহস্পতিবার (১৮ আগস্ট) সকাল ৬টা থেকে ১১টা পর্যন্ত হবিগঞ্জ সদর উপজেলার ধল বাজারে দফায় দফায় এ সংঘর্ষ চলে। এ সময় হবিগঞ্জ-লাখাই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। স্থানীয় সূত্র জানায়, বুধবার রাতে ধল বাজারে শাকির রেস্টুরেন্টে স্টার জলসায় কিরণমালা সিরিয়াল দেখা নিয়ে ধল গ্রামের সানু মিয়ার মেয়ে রেবা ও হাফসার সঙ্গে একই গ্রামের শেফালীর বাকবিত-া হয়। এ নিয়ে উভয় পরিবারের লোকজন শাকির রেস্টুরেন্টে এসে ঝগড়া ও হাতাহাতিতে লিপ্ত হন। এ সময় রেস্টুরেন্টের মালিক কামরুলসহ পাঁচজন আহত হন। পরে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা রাতেই বিষয়টি মীমাংসা করে দেন।
এর জের ধরে বৃহস্পতিবার সকালে উভয়পক্ষের লোকজন বাজারের পাশের একটি খেলার মাঠে টেঁটাসহ দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ সময় বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও যানবাহন ভাঙচুর করেন তারা। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে লাঠিচার্জ ও নয় রাউন্ড রাবার বুলেট, পাঁচ রাউন্ড টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
রাবার বুলেট ও টেঁটাবিদ্ধ অবস্থায় আতর আলী, নানু মিয়া, গিয়াস উদ্দিন, মোশারফ, খেলু মিয়া, টেনুসহ ১০ জনকে উদ্ধার করে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াসিনুল হক জানান, বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। ফের সংঘর্ষ এড়াতে ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
এই দুটি খবর একদিকে আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতের বন্ধ্যত্ব এবং অন্যদিকে ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বার্তা দেয়। আজকে এই কলামে আমি এমন কিছু কথা বলব যেগুলো একদিকে হবে অত্যন্ত অপ্রিয়, ‘ অন্যদিকে সেগুলো হবে চরম ও তিক্ত সত্য। আমি যেটা সত্য বলে মানি সেটি অকপটে বলে থাকি। সেই সত্যাশ্রয়ী হিসেবে এখন দুটি কথা বলব।
॥ দুই ॥
ভারতীয় বাংলা টিভি চ্যানেলের একটি অনুষ্ঠান দেখা নিয়ে বাংলাদেশে দুটি শিশু মারা গেছে এবং সংঘর্ষে ২০০ ব্যক্তি আহত হয়েছেন। আপনারা আমাকে বলুন তো, বাংলাদেশের প্রায় ৩০টি চ্যানেলের সিরিয়াল, নাটক বা সিনেমা দেখে এই ধরনের একটি ঘটনাও কি ঘটেছে? অথচ পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আমল মিলে আমাদের টেলিভিশনের বয়স হয়েছে ৫১ বছর। ১৯৬৪ সালে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাদেশ টেলিভিশন সেন্টারের উদ্বোধন করেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান। আমার যতদূর মনে পড়ে এই ৫১ বছরে মাত্র ৪টি সিরিয়াল অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এগুলো হলোÑ ‘সকাল সন্ধ্যা’, ‘এই সব দিন রাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’ এবং ‘অয়োময়’। এগুলোর মধ্যে সকাল সন্ধ্যা ছাড়া অবশিষ্ট তিনটি ধারাবাহিকের রচয়িতা ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। সকাল সন্ধ্যার রচয়িতা ছিলেন একজন মহিলা। তার নাম ভুলে গেছি। গুগলে সার্চ করেও সকাল সন্ধ্যা এবং তার লেখিকা সম্পর্কে কিছুই বের করতে পারিনি। এসব নাটক জনগণের মাঝে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কিরণমালার মতো পাবলিকের মাঝে বাস্তব জীবনে মৃত্যু বা মারামারির ঘটনা ঘটেনি।
তবে একটি ঘটনা ঘটেছিল। সেটি হলোÑ ‘কোথাও কেউ নেই’ ধারাবাহিকে বাকের ভাইয়ের ফাঁসির ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকার রাস্তায় মিছিল হয়েছিল। ওই মিছিল থেকে স্লোগানও দেওয়া হয়েছিল, “বাকের ভাইয়ের কিছু হলে/জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে”। তবে কোনো মৃত্যু বা গুলি বন্দুকের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। এসব ধারাবাহিক যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল সেটিও এক ব্যক্তির কারণেই। তিনি হলেন মরহুম হুমায়ূন আহমেদ। হুমায়ূন আহমেদ, হুমায়ূন আহমেদই। আর দ্বিতীয় হুমায়ূন আহমেদ জন্মায়নি, জন্মাবেও না।
॥ তিন ॥
ওই ৪/৫টি ব্যতিক্রমী ধারাবাহিক ছাড়া আপনারা বলুন, বাংলাদেশের অসংখ্য চ্যানেলের ভিড়ে কোন চ্যানেলের কোনো অনুষ্ঠানটি হিট করেছে? কেন করেনি? কেন করে না? যদি বলি, বছরের পর বছর পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু চালু ৩১ কি ৩২টি চ্যানেলের মধ্যে একটি চ্যানেলের একটি অনুষ্ঠানও ক্লিক করতে পারেনি। কেন পারেনি? তাহলে কি আমাদের এখানে প্রতিভার অভাব? মেধাবী লেখক, পরিচালক প্রমুখের অভাব?
স্টার জলসার আরেকটি সিরিয়ালের নাম ‘বধূবরণ’। এটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে যিনি অভিনয় করছেন তার নাম অঞ্জনা বসু। নাটকে তার চরিত্রের নাম ইন্দিরা চৌধুরী। বাংলাদেশে নর-নারী এবং আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা নির্বিশেষে সকলে হুমড়ি খেয়ে পড়েন বধূবরণ দেখতে, বিশেষ করে অঞ্জনা বসুকে দেখতে।
॥ চার ॥
আমি তো বহু পরিবারকে জানি যারা সময় পেলেই কলকাতার চ্যানেলগুলো দেখেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, ‘জি বাংলা’, ‘স্টার জলসা’, ‘সনি আট’, ‘কালারস বাংলা’ প্রভৃতি। তারা কিন্তু এসব চ্যানেলে ‘এসো মা লক্ষ্মী’, ‘ভক্তের ভগবান শ্রী কৃষ্ণ’, ‘দুর্গা’সহ অনেক দেব-দেবীর অনুষ্ঠান অবলীলাক্রমে দেখে যাচ্ছেন। এ ছাড়া যেগুলো তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, সাধারণ পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান সেগুলোর প্রায় প্রত্যেকটিতে একাধিকবার তাদের ঠাকুর ভক্তি থাকবেই। এমনকি জি বাংলার ‘হ্যাপি প্যারেন্টস ডের’ অনুষ্ঠানগুলোতেও যখন অংশগ্রহণকারীদের ইচ্ছে পূরণ করা হয় তখন যুবক-যুবতী এবং প্রৌঢ় বৃদ্ধ নির্বিশেষে অনেক পাত্র-পাত্রী শিব মূর্তি, কালী মূর্তি, দুর্গা মূর্তি, লক্ষ্মী বা সরস্বতী মূর্তি, বিষ্ণু মূর্তি চেয়ে নেন। মূর্তি হাতে পেলে টেলিভিশনের স্ক্রিনে ওই মঞ্চেই দেবীকে প্রণাম করেন। আমি কিন্তু তাদের এই দেবী ভক্তি দেখে বা ধর্মের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ দেখে খুশি হই। কারণ সেটি প্রসেনজিৎ বলেন, জিৎ বলেন, আর যিসু সেন বলেন, শ্রাবন্তী বলেন বা রাইমা সেন বলেন, সকলেই বিন¤্র শ্রদ্ধায় তাদের দেবীর অর্চণা করেন। তারপরেও ওইসব অনুষ্ঠান কলকাতার সর্বশ্রেণির দর্শক আন্তরিকতার সাথে দেখেন।
কিন্তু বাংলাদেশে? আল্লাহ, খোদা, রাসূল (সা.), নামাজ-কালাম বা কোরআন হাদিস পড়ার দৃশ্য থাকলেই তথাকথিত প্রগতিবাদী এবং সো কল্ড মুক্তমনারা নাসিকা কুঞ্চন করেন। এদের সকলকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া উচিত এবং তাদেরকে ট্রেনিং দেওয়া উচিত। হিন্দু ভাইদের দেখে ওদের শিক্ষা নেওয়া উচিত, কীভাবে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে হয় এবং কীভাবে ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে হয়।
॥ পাঁচ ॥
‘কেলোর কীর্তি’ ছবিটির বাংলাদেশে প্রদর্শন নিয়ে কয়েক দিন সিনেমা জগতের লোকরা মৃদু শোরগোল তুলেছিলেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। আর হবেই বা কেন? জনগণ তো তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়নি। কেন দেবে? আমরা তো হরহামেশা ভারতীয় ছবি দেখছি। মাত্র সেদিন ‘সুলতান’ ছবিটি ভারতে রিলিজড হলো। তার সাত দিনের মধ্যেই আমি ইউটিউব অথবা মিডিয়া সার্ভার থেকে ডাউনলোড করে ঝকঝকে প্রিন্টে সেই ছবিটি দেখলাম। এখন বাংলাদেশে বড় লোকরা তো বটেই, মধ্যবিত্তের অনেক ঘরেও ৪০ ইঞ্চি, ৪৮ ইঞ্চি বা ৫০ ইঞ্চি স্মার্ট টিভির ছড়াছড়ি। ওই বিগ স্ক্রিনে ‘বজরঙ্গি ভাইজান’, ‘পিকু’, ‘বাজিরাও মাস্তানি’, ‘বাহুবলী’ বা ‘সুলতান’ দেখতে পারলে বাংলাদেশের সিনেমা হলে সেগুলো দেখাতে দোষ কি? ১৯৬৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় সিনেমা, ভারতীয় পত্র-পত্রিকা, ভারতীয় ম্যাগাজিন প্রভৃতি অবাধে এবং বৈধ চ্যানেলে আসত। ‘আন’, ‘বহুৎ দিন হুয়ে’, ‘ইনসানিয়াত’, ‘সবার ওপরে’, ‘সাগরিকা’, ‘সাপ মোচন’সহ সুচিত্রা-উত্তমের সব ছবি তো পাকিস্তান আমলে ঢাকার গুলিস্তান এবং বগুড়ায় উত্তরা, মেরিনা প্রভৃতি সিনেমা হলে দেখেছি। সুপ্রিয়া চৌধুরী, সন্ধ্যা রায়, বিশ্বজিৎ, দিলীপ কুমার, অশোক কুমার, রাজ কাপুর, দেবানান্দ, নার্গিস, মধুবালা, বৈজয়ন্তিমালা, মিনা কুমারী, সায়েরা বানুÑ এদেরকে তো ঢাকা এবং বগুড়ার সিনেমা হলেই চিনলাম। আজ দিপীকা পাডুকোন, জ্যাকুলিন ফার্নান্দেজ, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, ক্যাটরিনা কাইফ, কারিনা কাপুর, রনবীর সিং, সালমান খান, আমির খান, শাহরুখ খান এদেরকে ঢাকা বা বগুড়া তথা বাংলাদেশের সিনেমা হলে চিনতে দোষ কোথায়? আমাদের দেশের প্রযোজক বা পরিচালকরা একটিও বজরঙ্গি ভাইজান বানাতে পারেন না। তাহলে ওদেরকে বাংলাদেশের সিনেমা হলে দেখব না কেন? বাংলাদেশে যেসব ছবি নির্মিত হচ্ছে সেগুলো তো বাংলাদেশের মানুষরাই দেখে না। তাহলে ভারতীয়রা সেগুলো দেখবে কেন? আর এখনকার বাংলাদেশের ইয়াং জেনারেশন বাংলাদেশের ছবির নায়ক-নায়িকাদেরকেই চেনে না। কিন্তু বলিউডের নায়ক-নায়িকাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজও বুঝতে পারে।
Email: [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।