পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
![img_img-1720113079](https://old.dailyinqilab.com/resources/images/cache/169x169x3_1678437663_IMG-20230310-WA0005.jpg)
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
৫ ডিসেম্বর ভাসানচরে পা রেখেছেন রোহিঙ্গাদের প্রথম দল। সব ধরণের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পেয়ে সেখানে শুরু হয়েছে রোহিঙ্গাদের রঙিন জীবন। প্রথম দফায় যে সব রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নেয়া হয়েছে তারা বসবাসের পরিবেশ দেখে দারুণ খুশি। শিশু ও ছেলেমেয়েরা খোলা জায়গা পেয়ে হৈহুল্লোড় করে ঘুরে বেড়িয়েছে। মূলত মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয় রোহিঙ্গারা। ঘিঞ্জি পরিবেশে সেখানে তাদের বসবাস করতে হয় স্বাসরুদ্ধ অবস্থায়।
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড় কেটে ৬ হাজার ৫শ’ একর জমিতে ৩২টি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ২ লাখ ১২ হাজার ৬০৭টি ঘরে ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাস করছে। বৃষ্টিতে পাহাড় ধস, হাতির ভয়সহ নানা ভোগান্তির মধ্যেই থাকতে হয়। সেখান থেকে ভাসানচরে খোলামেলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত গিয়ে রঙিন জীবনে প্রবেশ করছে তারা।
১৩ হাজার কিলোমিটার আয়োতনের ভাসানচর। সাগরের বুকে জেগে ওঠা চরে ছবির মতো করে সাজানো হয়েছে ঘরবাড়ি, মাঠ, ম্যানগ্রোভ বন। ওপরে নীলআকাশ দূরে সমুদ্র সমতলে লাল আর সবুজ। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের রাখার জন্য এখানেই গড়ে তোলা হয়েছে অস্থায়ী আশ্রয়ণ প্রকল্প। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতনে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের থাকার জায়গা। এরই মধ্যে এক হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গাকে নেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, দ্বীপের ১৩ হাজার কিলোমিটার আয়োতনের মধ্যে ব্যবহার উপযোগী ৬ হাজার ৪২৭ একর। প্রকল্প এলাকা এক হাজার ৭০২ একর। তবে ক্লাস্টার এরিয়া নির্মাণ করা হয়েছে কেন্দ্রের মাত্র ৪৩২ একরের মধ্যে। এখনও ৯১৮ একর জমি অব্যবহৃত। এর মধ্যে ৩৫২ একর জমি ভবিষ্যতে নৌবাহিনীর ফরওয়ার্ড বেইস তৈরির জন্য রাখা হয়েছে। বাকি এলাকার মাটি অত্যন্ত উর্বর হওয়ায় সব ধরনের ফসল ফলানোর চাষযোগ্য করা হয়েছে।
স›দ্বীপ থেকে ভাসানচরের দূরত্ব ৪ দশমিক ৫ নটিক্যাল মাইল। স›দ্বীপ থেকে ট্রলারে ভাসানচরে যেতে সময় লাগে মাত্র এক ঘণ্টা। এছাড়া জাহাঙ্গীরচর থেকে ১১, হাতিয়া থেকে ১৩ দশমিক ২, নোয়াখালী থেকে ২১ এবং চট্টগ্রামের পতেঙ্গা পয়েন্ট থেকে মাত্র ২৮ নটিক্যাল মাইল দূরে এই দ্বীপের অবস্থান।
ব্রিটিশ নকশায় আধুনিক সুবিধাসহ তৈরি করা হয়েছে নোয়াখালীর ভাসানচরের প্রকল্প। শক্তিশালী বাঁধ দিয়ে দ্বীপকে সুরক্ষিত করা হয়েছে। সাগরের মাঝে গড়ে ওঠা নিরাপদ, সুরক্ষিত এবং পরিবেশসম্মত। যে কোনো পরিস্থিতিতে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনের লক্ষ্যে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, থানা, বাজার এবং ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রসহ বসবাসের সব সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। এতিমখানা, ডে-কেয়ার সেন্টার এবং সুপারশপের জন্য আলাদা ভবন করা হয়েছে। প্রকল্পটিতে ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ১শ’ কোটি টাকা। এখানে রেশন কার্ডের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের খাবার নিশ্চিত করা হবে।
যারা সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন তাদের ভাষ্যমতে কার্যত ক্লাস্টার হাউস, শেল্টার স্টেশন বা গুচ্ছগ্রমকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ভাসানচর। রয়েছে মোট ১২০টি ক্লাস্টার হাউস। পরিকল্পিত নকশায় ভূমি থেকে প্রতিটি ক্লাস্টার হাউস ৪ ফুট উঁচু করে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি হাউসে ১২টি ঘর এবং প্রতিটি ঘরে ১৬টি কক্ষ। প্রতিটি কক্ষে পরিবারের ৪ জন করে থাকতে পারবেন। নারী-পুরুষের জন্য রয়েছে আলাদা টয়লেট, গোসলখানা।
এই সাইক্লোন শেল্টারের স্টেশনগুলো এমনভাবে স্টিল, কংক্রিট এবং কম্পোজিট স্ট্র্যাকচারে তৈরি করা হয়েছে যা ২৬০ কিলোমিটার গতির ঘূর্ণিঝড় সহ্যে সক্ষম। দুর্যোগ থেকে রক্ষায় প্রতিটি ক্লাস্টার হাউসের সঙ্গে রয়েছে একটি করে সাইক্লোন শেল্টার। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় রোহিঙ্গারা সেখানে আশ্রয় নিতে পারবে। এক্ষেত্রে প্রতিটিতে এক হাজার করে ১২০টি সেন্টারে এক লাখ ২০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। প্রতিটি সাইক্লোন শেল্টারের নিচতলায় রাখা যাবে ২শ’ করে গবাদিপশু।
দ্বীপটির নিরাপত্তার জন্য ৯ ফুট উচ্চতার ১৮টি সুইসগেটসহ ১২ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। সমুদ্রের ঢেউ থেকে ভাসানচর সুরক্ষায় ২ দশমিক ১ কিলোমিটার স্ক্রিন ব্রেকওয়াটারের মাধ্যমে শোর প্রটেকশনের কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধে বাঁধের উচ্চতা ৯ থেকে ১৯ ফুট পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। রোহিঙ্গাবিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের সুপারিশ অনুযায়ী ৪ তলাবিশিষ্ট দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে।
বসবাসরত রোহিঙ্গাদের জন্য সরকারি কোম্পানি টেলিটকসহ এরই মধ্যে তিনটি মোবাইল ফোন কোম্পানির নেটওয়ার্ক নেয়া হয়েছে। দ্রæত সেবার জন্য জরুরি প্রয়োজনে দিনরাত মানুষকে স্থানান্তরের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। জ্বালানি সরবরাহে ২৫০ টন ধারণক্ষমতার ২টি ফুয়েল ট্যাংক নির্মাণ করা হয়েছে। আবাসন এলাকা পরিবেশসম্মত করা এবং বাতাস ঠান্ডা রাখার জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত পুকুর। প্রতিটি ক্লাস্টার হাউসের সামনে একটি করে পুকুর। জ্বালানির জন্য রান্নাঘরে গ্যাস সিলিন্ডার রাখার সুবিধা আছে। ২৪ ঘণ্টাই বিদ্যুৎ সরবরাহে কেন্দ্রীয়ভাবে ১ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ এবং আরো ১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ ২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়াও প্রতিটি ক্লাস্টার হাউসে রয়েছে সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা। কেন্দ্রীয়ভাবে করা হয়েছে বায়োগ্যাস প্লান্ট। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং সরকারের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) জন্য রয়েছে আলাদা ভবন। খাদ্য মজুদের জন্য এখানে সুবিশাল গোডাউন নির্মাণ করা হয়েছে। আরো রয়েছে ৩টি সুরক্ষিত ওয়্যার হাউস। এসব গোডাউনে এক লাখ মানুষের তিন মাসের খাবার মজুদ রাখা যাবে। নামাজ আদায়ের জন্য তৈরি করা হয়েছে ৩টি মসজিদ। স্বাস্থ্যসেবায় রয়েছে ২টি ২০ শয্যার হাসপাতাল এবং ৪টি কমিউনিটি ক্লিনিক। এসব হাসপাতাল থেকে রোগীদের ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসা ও ফ্রি ওষুধ সেবা দেয়া হবে।
জাতিসংঘসহ বেশ কয়েকটি উন্নত দেশ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেয়ার বিরোধিতা করে আসছে। কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত পাঠাতে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে জাতিসংঘ ব্যর্থ হয়েছে। আর যে সব উন্নত দেশ রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেয়ার বিরোধিতা করছেন সে সব দেশ সিরিয়ার উদ্বাস্তু লোকজনকে নিজ দেশে আশ্রয় দেয়নি। বরং বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মানবিকতার পরিচয় দিয়েছে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্র্থীদের উন্নত জীবনযাপনের যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
এদিকে নোয়াখালী থেকে বিশেষ সংবাদদাতা আনোয়ারুল হক আনোয়ার জানান, ভাসানচরে পা রেখেই বেশ আনন্দিত রোহিঙ্গা নারী পুরুষ। সর্বাধিক নিরাপত্তা ও যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দেখে অনেকে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। শরণার্থীদের জন্য অস্থায়ী বসবাসের এমন সুযোগ সুবিধা প্রদান বিশ্বে বিরল। যেটা প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়েছে।
৩০ বছর বয়সী সৈয়দ উল্লাহ স্ত্রী, তিন মেয়ে ও এক পুত্র নিয়ে ভাসানচর এসে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে জানান, আলহামদুলিল্লাহ আমরা অত্যন্ত খুশী হয়েছি। ভাসানচরে আমাদের জন্য যে এত সুন্দর, নিরাপদ ও যাবতীয় সুযোগ সুবিধা রাখা হয়েছে তা কল্পনাও করিনি। এখানে আসতে কেউ আমাদের বাধ্য করেনি বরং উন্নত পরিবেশ ও সুন্দরভাবে থাকতে স্বেচ্ছায় এসেছি। কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা অন্যদেরও অনুরোধ করছি, যাবতীয় ভাসানচর আসার জন্য। তিনি আরও বলেন, মিয়ানমারের রাখাইনে আমার জমিজমা, ঘরবাড়ি ও চাষাবাদ সবকিছু ছিল। সে দেশের সেনারা আমার সবকিছু পুড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু ভাসানচর এসে আমার দুঃখ কষ্ট লাঘব হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানাই।
ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের উন্নত জীবনযাপনের জন্য নির্মিত হয়েছে স্কুল, হাসপাতাল, মসজিদ, খেলার মাঠ, মেডিকেল টিম, সড়ক, খাদ্য মজুতের জন্য গুদামঘর, সোলার সিস্টেম, লাইট হাউস, মোবাইল ফোন টাওয়ার, হাট-বাজার, কমিউনিটি সেন্টার, পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা, বিশুদ্ধ খাবার পানি ব্যবস্থা, সুপার শপ, ডে কেয়ার সেন্টার, সেলুন, কমিউনিটি সেন্টার ও সার্বিক নিরাপত্তা বিধানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য স্থায়ী থানা। ভাসনচরে পণ্য পরিবহনের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে একটি অত্যাধুনিক জেটি। এছাড়া সরকারি সহায়তার পাশাপাশি লক্ষাধিক রোহিঙ্গার জীবিকা নির্বাহ ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার লক্ষে এখানে চাষাবাদ, দুগ্ধ খামার, হাঁস মুরগি পালন, হস্তশিল্প ও সেলাই মেশিনের ব্যবস্থাসহ যাবতীয় সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।
ভাসানচরে রোহিঙ্গা অবস্থান নিয়ে স্থানীয়ভাবে আতঙ্কের কথা শোনা যায়। এ প্রসঙ্গে হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইমরান হোসেন ইনকিলাবকে জানান, যেহেতু ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য সর্বাত্মক সুযোগ সুবিধা রাখা হয়েছে সেহেতু তাদের বাইরে যাবার প্রয়োজন নেই। এছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে কারও পক্ষে ভাসানচর প্রবেশের সুযোগ নেই। সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নৌপথ ও ভাসানচর নৌঘাট তত্ত্বাবধান করবে। তবে কেউ অসুস্থ হলে তাকে চিকিৎসার জন্য বিশেষ ব্যবস্থাধীনে হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠনো করা হবে। ভাসানচরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে একজন ইন্সপেক্টরের নেতৃত্বে পুলিশ ফাঁড়ি রয়েছে।
ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের আশ্রায়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রশাসনকে সহযোগিতা করেন হাতিয়ার সাবেক এমপি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী। এ প্রসঙ্গে তিনি ইনকিলাবকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পূর্ণ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের যাবতীয় সুযোগ সুবিধা সম্বলিত ভাসানচরে আশ্রয় দিয়েছেন। এজন্য প্রধানমন্ত্রী প্রশংসার দাবিদার। এখানে রোহিঙ্গার নিরাপদ জীবন যাপন করতে পারবে। এজন্য স্থানীয় প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান অব্যাহত রাখব।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।