বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
এ রচনার পটভ‚মিকায় অতি সামান্য আভাস দেয়া হয়েছে যে, সারওয়ারে কায়েনাত (সা.) কীভাবে দোজাহানের সম্রাট ছিলেন এবং তাকে ফকির, গরিব, দরিদ্র, অভাবী বলে আখ্যায়িত করা কত বড় অপরাধ।
দোজাহানের শাহেনশাহ হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়াত ও রেসালত জীবন মাত্র ২৩ বছরে সীমাবদ্ধ। তাঁর মক্কী জীবন ১৩ বছর কী অসহায় অবস্থা ও কঠিন নির্যাতনে কেটেছে তার উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। তবে মদীনায় হিজরতের পর থেকে মাত্র ১০ বছর সময় পেয়েছিলেন তাঁর নাবুওয়াতি মিশন প্রচার-প্রসারে। আল্লাহর দ্বীন প্রচার ও তার পরিপূর্ণতা অর্জিত হয়েছিল এ দশ বছরের মধ্যে, যাতে ইসলামের প্রচার-প্রসার ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল। তাঁর নবুওয়াতি জীবনের এ মাদানী অধ্যায়ে তাঁর জীবনচরিতের সকল দিক উদ্ভাসিত হয়েছে, তার আমলি কর্মকান্ডের পাশাপাশি তাঁর নবুওয়াতির মিশনও পরিপূর্ণভাবে সফল হয়েছে।
ইতিহাসের আলোকে দেখা যায়, হিজরি ৬ষ্ঠ বা ৭ম সালে হোদায়বিয়ার সন্ধির পূর্ব পর্যন্ত আরব ও আশেপাশের বহু এলাকার বিভিন্ন গোত্রের বহু লোক, হুজুর (সা.)-এর দাওয়াতে সাঁড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। ইতিপূর্বে ২য় হিজরি সালে বদর যুদ্ধে মুসলমানদের প্রথম অসাধারণ বিজয়, ওহোদ যুদ্ধ (তৃতীয় সালে) এবং ৪র্থ সালে খন্দক যুদ্ধ ও খাইবার প্রভৃতি রণাঙ্গনে মুসলমানদের বিজয় ছাড়াও ছোট বড় বহু অভিযান সফল হওয়ায় ইসলামের প্রভাব নানা স্থানে পরিলক্ষিত হতে থাকে এবং ইসলাম প্রচারের ধারা বিক্ষিপ্তভাবে শুরু হয়ে যায়।
হোদায়বিয়ার সন্ধির পর মুসলমানদের মধ্যে কিছুটা হলেও স্বস্তির সঞ্চার হয়। আল্লাহর রাস্তায় চলার জন্য উত্তম, সুন্দর পদ্ধতি-কৌশল অবলম্বনের জন্য খোদায়ী নির্দেশ আসে। সে মতে হুজুর (সা.) দুনিয়াময় আল্লাহর পয়গাম পৌঁছে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি সাহাবায়ে কেরামকে সমবেত করে এই মর্মে একটি ভাষণ দান করেন, ‘হে লোক সকল! আল্লাহ আমাকে সমগ্র দুনিয়ার জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছেন। ঈসা (আ.)-এর হাওয়ারী-অনুসারীদের ন্যায় পরষ্পর মতবিরোধে লিপ্ত হবে না। তোমরা বের হয়ে সত্যের পয়গাম প্রচার করো আমার পক্ষ হতে।’
এ ঘোষণার পর তিনি রোম সম্রাট কাইসার, আজিজ মিশর এবং আরব নেতৃবর্গের নামে ইসলামের দাওয়াতিপত্র প্রেরণ করেন। এ সব পত্র যারা বহন করে নিয়ে যান তাদের কয়েকজনের নাম যথা: হজরত দেহিয়া কালবী রোম সম্রাটের নিকট, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে হোজাফা সাহমী ইরানের খসরু পারভেজের নিকট, হজরত হাতেব ইবনে আবি বালতা আজিজ মিশরের নিকট, হজরত উমর ইবনে উমাইয়া আবিসিনিয়ার বাদশা নাজ্জাশীর নিকট, হজরত সুজাইনে ওহাব আল আসাদী সিরিয়া এলাকার প্রধান হারেস গাস্সানীর নিকট পেরিত হয়েছিলেন।
রোম সম্রাট কাইসার (হিরাক্লিয়াস)-এর নিকট হুজুর (সা.)-এর প্রেরিত পত্র হস্তগত হবার পর তিনি সে দেশে অবস্থানরত (তখন পর্যন্ত) ইসলামের মহাশত্রু কোরেশ নেতা আবুসুফিয়ানকে তলব করেন এবং তাদের মধ্যে যে গুরুত্বপূর্ণ কথোপকথন হয় তার বিস্তারিত বিবরণ নির্ভরযোগ্য সকল সীরাত গ্রন্থে রয়েছে। এখানে প্রতিপাদ্য ও প্রাসঙ্গিক বিষয় হিসেবে সংক্ষেপে তা উল্লেখ করতে চাই।
এ সম্পর্কে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, তাঁকে আবু সুফিয়ান বর্ণনা করেছেন, যখন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পত্র শামে (সিরিয়ায়) পৌঁছেছিল, তখন আমরা সেখানে অবস্থান করছিলাম। দেহিয়া কালবী চিঠিখানা এনেছিলেন। তিনি তা বুসরার আমিরকে (শাসনকর্তা) প্রদান করেছিলেন এবং বুসরার আমির তা হিরাক্লিয়াসকে প্রদান করেন। হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞাসা করেন, ‘যে ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবি করছেন, তাঁর কওমের কোনো লোক কি এখানে আছে?’
লোকেরা জানাল, ‘জী হ্যাঁ, আছে’। তাই তারা আমাকে এবং কয়েকজন সঙ্গীকে হিরাক্লিয়াসের নিকট নিয়ে যান। হিরাক্লিয়াস জানতে চাইলেন, ‘ঐ ব্যক্তির (নবুওয়াতের দাবিদার) নিকটস্থ আত্মীয় কে আছে (এখানে)?’ আবু সুফিয়ান বললেন, ‘আমি’। আবু সুফিয়ানকে হিরাক্লিয়াসের তর্জুমান (ভাষ্যকার) এর মাধ্যমে বলা হয়, ‘আমরা নবুওয়াতের দাবিদার সম্পর্কে তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাই। ইনি যদি আমাদের কাছে গলদ বলেন, তাহলে তোমরা (আবু সুফিয়ানের সঙ্গীরা) তা প্রকাশ করে দেবে।’
আবু সুফিয়ান বললেন, ‘যদি আমার মিথ্যা প্রকাশের আশংকা না হতো, তাহলে আমি এ দিন বহু মিথ্যা কথা বলতাম।’ আবু সুফিয়ানের উক্তিটি প্রনিধানযোগ্য। রোম সম্রাটের সামনে মিথ্যাচার প্রকাশের সাহস হলো না। তাই তিনি সকল জিজ্ঞাসার সঠিক জবাব দেন।
হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তাঁর (নবুওয়াতের দাবিদার) বংশ কেমন?’ তিনি জবাবে বললেন, ‘আমাদের মধ্যে তাঁর বংশ খুবই উত্তম।’ অতঃপর প্রশ্ন করা হয়, ‘তাঁর পূর্ব পুরুষদের মধ্যে কেউ বাদশাহ ছিল কি-না?’ আমি বললাম, ‘না’। ফের জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘নবুওয়াতের দাবি করার পূর্বে তোমরা তাকে কখনো মিথ্যাবাদী পেয়েছ কি?’ আমি বললাম, ‘না’। জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘তাঁর অনুসরণ শরিফ লোকেরা করে, নাকি যোআফা (দুর্বলরা)?’ আমি বললাম, ‘দুর্বলরা’ ইত্যাদি।
সকল প্রশ্নের জবাব শুনার পর রোম সম্রাট বললেন, ‘তুমি যা বলেছ তা সত্য হলে তিনি অবশ্যই নবী। আমরা তো জানি একজন নবীর আবির্ভাব ঘটবে, কিন্তু জানা ছিল না যে তিনি তোমাদের মধ্যে হতে হবেন। আমার ইচ্ছা, যদি তার সাথে আমার সাক্ষাৎ হতো, আমি তাঁর পদধূলি গ্রহণ করতাম। তাঁর রাষ্ট্র আমার এই স্থান পর্যন্ত পৌঁছাবে।’ কিন্তু এ সম্রাট ইসলাম গ্রহণ করেননি এবং খ্রিস্টান থেকে যান বলে অন্য বর্ণনা হতে জানা যায়।
বিশে^র রাজন্যবর্গের নামে রাসূলুল্লাহ (সা.) যে সব পত্র প্রেরণ করেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ ইসলাম গ্রহণ করে, কেউ কেউ অস্বীকার করে এবং কেউ কেউ পত্রের অবমাননা করে রাজত্ব হারায় ও ধ্বংস হয়। তাদের মধ্যে হরমুজ (কেসরা)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অপরপক্ষে হাবশা (আবিসিনিয়া) এর রাজা নাজ্জাশী ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি তার দরদি মনোভাবের প্রশংসনীয় ভ‚মিকার কথাও সীরাত গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত হয়েছে। তার মৃত্যুর খবরে রাসূল্লাহ (সা.) দারুণভাবে ব্যথিত হয়েছিলেন এবং তার গায়েবী জানাজা পড়েছিলেন।
উল্লেখ্য, হিজরতের পূর্বে হুজুর (সা.)-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির প্রথম বর্ষ মুসলমানগণ হাবশায় হিজরত করেছিলেন। সপ্তম বর্ষে হুজুর (সা.) নাজ্জাশীর নামে পত্র প্রেরণ করেন। সুতরাং, তৎকালীন আরব বিশ্ব ও আশেপাশের এলাকাগুলো ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বে সর্ব প্রথম ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে গিয়েছিল হাবশায়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।