বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মুহাম্মদ (সা.)-কে রাহমাতুল্লিল আলামিন বা জগতের করুণাস্বরূপ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি নবীশ্রেষ্ঠ এবং রাসুল (সা.) গণের সরদার। তিনি সর্বশেষ নবী ও রাসুল (সা.)ও বটেন। তাঁর পর আর কোনো নবী-রাসুল (সা.) দুনিয়াতে আসবেন না। পবিত্র কোরআনের পরে আল্লাহ তা‘আলার তরফে আর কোনো কিতাব আসবে না। আসবে না কোনো প্রত্যাদেশ। কেয়ামত পর্যন্ত পবিত্র কোরআন আর রাসুল (সা.)-এর হাদিসই মানবমন্ডলীকে পথ দেখাবে, পরিচালিত করবে। যারা পবিত্র কোরআন ও হাদিস মানবে, অনুসরণ করবে, তারাই দুনিয়াতে ও পরকালে সফলকাম হবে।
মানবমন্ডলীর সার্বিক মুক্তি ও কল্যাণ ইসলামের লক্ষ্য। ইসলামের এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে মহানবী (সা.) সারাজীবন কাজ করে গেছেন। তিনি মানবমন্ডলীর পথপ্রদর্শক ও মুক্তিরদূত। তাঁর গোটা জীবন পবিত্র কোরআনেরই প্রতিরূপ। তিনি যখনই সুযোগ পেয়েছেন, তখনই মানবমন্ডলীর ইহ ও পরকালের সাফল্য ও কল্যাণের জন্য নির্দেশনা ও তাকিদ দিয়েছেন। দশম হিজরিতে মহানবী (সা.) পবিত্র হজ পালন করেন। হাজার হাজার মুসলমান সে বছর তাঁর সঙ্গে হজে শরিক হন। এ উপলক্ষে সমবেত জনতার উদ্দেশে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দান করেন। এর পরে তিনি আর কখনো হজ পালনের সুযোগ পাননি। এ জন্য এ হজকে রাসুল (সা.)-এর ‘বিদায় হজ’ বলে অভিহিত করা হয়। সেদিন যে ভাষণ তিনি দেন, তাকে ‘বিদায় হজের ভাষণ’ বলে বর্ণনা করা হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, রাসুলে করিম (সা.)-এর বিদায় হজের ভাষণ মানবমন্ডলীর জন্য তাঁর সর্বশেষ নসিহত বা নির্দেশ। অনেকে মনে করেন, ওই ভাষণে ইসলামের সারনির্যাস উঠে এসেছে।
লক্ষ্য করার বিষয়, ভাষণে তিনি ‘মুসলমান’ ‘মুমিন’ কিংবা ‘হজে আগত ব্যক্তিবর্গ’, ‘সমবেত জনতা’ ইত্যাদি বলে সম্বোধন করেননি। সম্বোধন করেছেন ‘হে মানুষ’ বা ‘হে মানবমন্ডলী’ বলে। এ থেকে সহজেই বলা যায়, সমগ্র মানবজাতির উদ্দেশেই তিনি ভাষণটি দিয়েছেন। বিশ্বমানবের ঐক্য-সংহতি, মুক্তি ও মঙ্গলের সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা আছে ওই ভাষণে।
মানুষের মধ্যে বংশ, গোষ্ঠী, গোত্র, সম্প্রদায়, বর্ণ, জাত ইত্যাদির পার্থক্য লক্ষ করা যায়। বিশ্বাস, আচার-আচরণ ও সংস্কৃতির দিক দিয়েও তাদের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়। আসলে সব মানুষ একই উৎস থেকে আগত। একজন পুরুষ (হজরত আদম আ.) এবং একজন নারী (হজরত হাওয়া আ.) থেকে সৃষ্টি হয়েছে সবাই। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেছেন: হে মানুষ, আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পার। সুরা হুজুরাত : ১৩। রাসুলে আকরাম (সা.) তাঁর বিদায় হজের ভাষণে পবিত্র কোরাআনের এ আয়াতাংশ উদ্ধৃত করে বলেন: অতএব, শুনে রাখো; মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। আরবের ওপর কোনো অনারবের, অনারবের ওপর কোনো আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তেমনি সাদার ওপর কালোর বা কালোর ওপর সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী, যে আল্লাহকে ভালোবাসে।
মানবজাতি এক, অভেদ এবং অভিন্ন। অথচ যুগে যুগে মানুষের মধ্যে বিভেদ ও পার্থক্য সৃষ্টি করা হয়েছে। বর্ণের শ্রেষ্ঠত্ব, এলাকার শ্রেষ্ঠত্ব, জাতির শ্রেষ্ঠত্ব সামনে আনা হয়েছে। এতে বিভেদ-বিসংবাদের জন্ম হয়েছে। সঙ্ঘাত ও অশান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে সাম্প্রতিককালে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। কালো ও মিশ্র রংয়ের মানুষ সাদাদের দ্বারা অত্যাচারিত ও নিপীড়িত হচ্ছে। তাদের মানবিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ভারতে হিন্দুত্ববাদ জাগিয়ে তোলা হয়েছে। হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর এর প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেখানে বর্ণবাদী ভেদাভেদ ঐতিহাসিক ও সামাজিকভাবেই বিদ্যমান। ফলে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের বিশেষ করে মুসলিম এবং তাদের সঙ্গে নিম্নবর্ণের মানুষের নিরাপত্তা ও অধিকার সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। তারা হিন্দুত্ববাদীদের হাতে নানাভাবে নিপীড়িত ও নির্যাতিত হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে ইসলামোফোবিয়া বিস্তার লাভ করেছে। প্রায় সব ধর্ম-সম্প্রদায়ই ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লেগেছে। শুরু হয়েছে এক অঘোষিত ক্রুসেড। এছাড়া আরব-অনারব ইউরোপ-এশিয়া বা ইউরোপ-আফ্রিকা ইত্যাকার বিভেদও বিরাজমান এবং ইদানিং তা বাড়ছেও।
এ সবের ফলাফল কী হচ্ছে, আমরা সবাই দেখছি। বিরোধ-বিতর্ক, সঙ্ঘাত-সন্ত্রাস, দমন-পীড়ন ও যুদ্ধ বিস্তার লাভ করছে। মানবতা চরম অবনতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এই আতঙ্কিত, ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপর্যয়কর পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটতে পারে, যদি সব দেশ, সব মানুষ মহানবী (সা.)-এর বিদায় হজের ভাষণে বর্ণিত ‘মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই’-এ বাণী অনুসরণ করে এবং সমাজ ও দেশে তার প্রতিফলন ঘটায়, মানব এক জাতি, এক পুরুষ ও এক নারী থেকে উদ্ভ‚ত এ সত্য স্বীকার করে নিলে বর্ণগত-সম্প্রদায়গত-জাতিগত-বিরোধ, সঙ্ঘাত-সঙ্কট, যুদ্ধ দুনিয়াতে থাকতে পারে না। শান্তিময় ও নিরাপদ বিশ্ব গড়তে আল্লাহপাক ও রাসূল (সা.)-এর দেখানো পথ অনুসরণের বিকল্প নেই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।