যেভাবে ৫০০
ক্লাব ফুটবলে গোলের প্রায় সব রেকর্ডই তার দখলে। এবার সেই লিওনেল মেসি উঠে গেলেন আরেক উচ্চতায়। বার্সেলোনার জার্সি গায়ে ৫০০ গোলের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন মেসি।
শামীম চৌধুরী
দুই বড় বোন হুইটনি এবং হিলারিকে দেখে সাঁতারু হওয়ার নেশাটা চেপে যায় তার সেই ছোট্ট বয়সে। বয়স যখন মাত্র ৭ বছর, তখন সুইমিং পুলে এসে কি ভয়ই না পেয়েছিলেন ছোট্ট ফেল্পস। কাঁচু-মাচু করে পানির নিচে লুকিয়ে ছিলেন কিছুক্ষণ। তা দেখে সাঁতার প্রশিক্ষক জড়তা কাটাতে দিলেন নির্দেশ, পেছনে ফিরে সাঁতরাও! ৭ বছর বয়সে জড়তা নিয়ে সাঁতারে নাম লেখানো সেই ছেলেটিই এখন সাঁতারের কিংবদন্তী। জিতে নিয়েছেন অলিম্পিক থেকে ২৩টি স্বর্ণসহ ২৮টি পদক!
সাঁতারে অবিশ্বাস্য কিছু’র জন্ম দিবে ফেল্পস, ১২ বছর বয়সী ছেলেটিকে দেখে সে ভবিষ্যদ্বাণীই করেছিলেন ফেল্পসের সাঁতার গুরু বব বোম্যান। সাঁতারে দারুণ কিছুর স্বপ্ন দেখা বড় বোন হুইটনি খেয়েছেন হোঁচট। ১৯৯৬ আটলান্টা অলিম্পিক গেমসকে সামনে রেখে সাঁতার ক্যাম্পে থাকা বোন ইনজুরিতে পড়ে দল থেকে ছিটকে পড়েছেনÑতা ভীষণ কষ্ট দিয়েছিল ফেল্পসকে। ১৯৯৬ সালে আটলান্টা অলিম্পিক গেমসে অ্যাকুয়েটিক সেন্টারে ঝড় তুলেছেন ২ সাঁতারু টম ম্যালচো, টম ডোলানÑতা দেথে ভবিষ্যতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্নটা করেছেন লালন। তার স্বপ্ন পূরনে এগিয়ে এসেছেন সাঁতার কোচ বোম্যান। ১৫ তে পা দেয়ার আগে ১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র ‘বি’ দলে জায়গাটা পেয়েই স্বপ্ন পূরনে একটার পর একটা সিঁড়ি অতিক্রম করেছেন। ২০০০ সালে সিডনী অলিম্পিক গেমসে যুক্তরাষ্ট্র সাঁতার দলে ১৫ বছরের এই সাঁতারুর সুযোগ পাওয়াটাই ছিল সে সময়ের বিস্ময়। ২০০ মিটার বাটারফ্লাই ইভেন্টে পুলে নেমে অলিম্পিকে যুক্তরাষ্ট্রের ৬৮ বছরের সাঁতার ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ সাঁতারুর রেকর্ডটা করেছেন ফেল্পস। অলিম্পিকে নিজের অভিষেক পদকহীন কেটেছে ঠিকই, কিন্তু এই ক্ষুদে সাঁতারুর মধ্যেই ভবিষ্যতে ইতিহাসের সম্ভাবনা দেখেছেন তখন সাঁতার বিশ্লেষকরা।
পরের বছরেই নুতন সাঁতার বিস্ময়ের অভ্যুদয় দেখেছে বিশ্ব। ২০০১ সালে ২০০ মিটার বাটারফ্লাই ইভেন্টে বিশ্বরেকর্ড গড়ে সর্বকনিষ্ঠ সাঁতারু হিসেবে (১৫ বছর ৯ মাস) রচনা করেছেন ইতিহাস। সে বছরে জাপানের ফুকুয়ায় ওয়ার্ল্ড সুইমিং চ্যাম্পিয়নশিপে ২০০ মিটার বাটারফ্লাই ইভেন্টে ১ মিনিট ৫৪.৫৮ সেকেন্ড টাইমিংয়ে নিজের গড়া বিশ্বরেকর্ড ভেঙ্গে নুতন বিশ্বরেকর্ডে চমকে দিয়েছেন সবাইকে। ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিকে আবির্ভাবের আগেই আলোচনায় উঠে এসেছিলেন। টসন থেকে গ্রাজুয়েট ডিগ্রি নিয়ে ১৭ বছর বয়সে ওয়াল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে পাঁচ পাঁচটি বিশ্বরেকর্ড গড়ে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছেন ২০০৩ সালে। ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিকে ৬ স্বর্ণ, ২ ব্রোঞ্জে অলিম্পিকের এক আসরে সর্বাধিক পদক জয়ে সোভিয়েত জিমন্যাস্ট আলেকজান্ডার দিতিয়াতিনের রেকর্ডে ভাগ বসিয়ে রীতিমতো বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছেন। বাকিটা তো শুধুই ফেল্পস কাব্য।
২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে সুইমিং পুলে কি ঝড়ই না তুলেছিলেন মাইকেল ফেল্পস। ৮ টি ইভেন্টের সব ক’টিতে স্বর্ণ, যার মধ্যে ৭টিই আবার বিশ্বরেকর্ড! ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে সেখানে খেয়েছেন হোঁচট। ৪ স্বর্ণ, ২ রৌপ্যে থেমেছে ওই অলিম্পিক। নিজের উপর অভিমান করে দিয়েছিলেন অবসরের ঘোষণা। অবসর ভেঙে ফিরেছেন ২ বছর পর।
অলিম্পিকে অমরত্ব পেয়েছেন আগেই, এথেন্স থেকে লন্ডনÑ এই তিনটি আসরে ১৮ স্বর্ণপদক জিতে অলিম্পিকের সব রেকর্ড নিজের করে নেয়া মাইকেল ফেল্পস অবসর ভেঙে রিও অলিম্পিকে এসে ৩১এ ফিরে পেয়েছেন তারুণ্য, জিতেছেন আরো ৫টি স্বর্ণ। কথা দিয়েছিলেন, ফ্রি স্টাইলের কোন ইভেন্টে আর নয়, তারপরও রিও’র সুইমিং পুলে নেমেছেন দলের প্রয়োজনে। ৪*১০০ মিটার ফ্রি স্টাইল ইভেন্ট দিয়ে রিও তে শুরু, জিতেছেন দলীয় ইভেন্ট ৪*২০০ মিটার ফ্রি স্টাইল, শেষ ইভেন্টটিও তার রিলে থেকে (৪* ১০০ মিটার ইনডিভিজ্যুয়াল মিডলে)। ২০০ মিটার ইনডিভিজ্যুয়াল মিডলে ইভেন্ট এবং ২০০ মিটার বাটারফ্লাই ইভেন্টে ব্যক্তিগত স্বর্ণপদকও। ফিরে পেয়েছেন হারানো মুকুট। রিও অলিম্পিক থেকে ৬টি ইভেন্টের সব ক’টিতে স্বর্ণ জিতলে হয়ে যেতো আর একটি অধ্যায়। তবে ৫ম ইভেন্টে এসে থামলেন ফেল্পস, রৌপ্যতেই থামতে হলো ওই ইভেন্ট। ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিককে সামনে রেখে সিঙ্গাপুরে ট্রেনিং সেশনে যে ছেলেটি ফেল্পসকে এক নজর দেখতে, তার সঙ্গে ছবি তুলতে ছুটে এসেছিলেন, সেই স্কুলিংয়ের কাছে হেরে গেছেন। তবে অলিম্পিক থেকে অর্জিত ২৮টি পদকের মধ্যে ২৩ টি স্বর্ণ, ৩টি রৌপ্য, ২ টি ব্রোঞ্জÑ এমন অর্জনকে ছোঁয়ার সাধ্যি কার বলুন?
লন্ডন অলিম্পিকে ৪ স্বর্ণ ২ রৌপ্য জিতে নিজের উপর অভিমানে নিয়েছিলেন অবসর। অবসর ভেঙে ফিরেছেন ২ বছর পর। ফিরে সাঁতারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে করেছেন হতাশ, গতিসীমা ছাড়িয়ে গাড়ি চলানোর অপরাধে যুক্তরাষ্ট্র আদালত থেকে ৬ মাস সাঁতারের উপর নিষেধাজ্ঞাদেশও পেতে হয়েছে। ৩১ এ এসে সেই ফেল্পসকে ভরা তারুণ্যেই দেখতে পেলো বিশ্ব। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন রিও অলিম্পিকে ফ্রি স্টাইলের কোন ইভেন্টে আর দিবেন না ঝাঁপ। এমনকি দলগত ইভেন্টেও নয়। রিও অলিম্পিককে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র সাঁতারুদের যে ট্রায়াল বাধ্যতামূলক, সেই ট্রায়াল পর্যন্ত দেননি। এমনকি রিও অলিম্পিকের প্রিলিমিনারি রাউন্ডেও পর্যন্ত ৪*১০০ মিটার ফ্রি স্টাইল রিলেতে ছিলেন না ফেল্পস। অথচ, সেই ফেল্পসই রিও অলিম্পিক ২টি স্বর্ণ জিতেছেন ৪*২০০ ও ৪*১০০ মিটার দলগত ফ্রিস্টাইল ইভেন্ট থেকে। ২০০ মিটার বাটারফ্লাই ইভেন্টে ফিরে পেয়েছেন মুকুট। আর এথেন্স থেকে ২০০ মিটার ইনডিভিজ্যুয়াল মিডলে ইভেন্টটি একান্ত নিজের করে নিতে জীবনের শেষ অলিম্পিকেও ধরে রেখেছেন মুকুট।
অলিম্পিকে এককভাবে সর্বাধিক ৯টি করে স্বর্ণ জয়ের রেকর্ড ছিল সাবেক সোভিয়েত জিমন্যাস্ট লারসিয়া লাতিনিয়া, ফিনল্যান্ডের দৌড়বিদ পাভো নুরমি, যুক্তরাস্ট্রের সাঁতারু মার্ক স্পিৎজ,ও স্প্রিন্টার কার্ল লুইসের। বেইজিংয়ে সেই রেকর্ড ছাপিয়ে লন্ডনে এসে সব রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন। রিওতে এসে নিজেকে নিজের ছাড়িয়ে যাওয়া লড়াইয়ে জিতে অলিম্পিক থেকে অর্জিত হলো তার ২৮টি পদকের মধ্যে তার সাফল্যে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত বেজেছে ২৩ বার! এভারেস্ট উচ্চতায় উঠে আসা ফেল্পসের গল্প থেমে গেল এখানেই।
৭ বছর বয়সে সাঁতারকে ভবিষ্যতের জন্য নিয়েছিলেন বেছে, মাত্র ১৫ বছর বয়সে সিডনী অলিম্পিকে ২০০ মিটার ইনডিভিজ্যুয়াল মিডলে ইভেন্টে পুলে ঝাঁপ দিয়ে সে সময়ে অলিম্পিক ইতিহাসে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বকনিষ্ঠ সাঁতারুর রেকর্ড গড়া ফেল্পস বিস্ময়গাঁথা ছিল টানা ৪টি অলিম্পিকে। আর নয় সঁাঁতার, আর নয় অলিম্পিক, এই ঘোষণাই দিয়েছেন সাঁতার কিংবদন্তীÑ ‘আমি আর ৪ বছর থাকতে চাই না। যেভাবে শেষ করতে পেরেছি, তাতেই আমি খুশি। লন্ডনে শপথ করে বলেছিলাম আর ফিরে আসব না। তারপরও ফিরে শেষ করেছি। আর নয়, আগামীকাল (শুক্রবার) এটাই এখন স্বাক্ষর করে দিতে চাই।’ তবে ফেল্পসের টীমমেট লোকচে ফেল্পসের এমন অবসর ঘোষণা বিশ্বাস করছেন নাÑ ‘আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, ২০২০ টোকিও অলিম্পিকে ফেল্পসকে দেখতে পাব।’
অথচ কি জানেন, ফেল্পসের সাঁতারু হয়ে ওঠার গল্পটা কিন্তু এতোটা মসৃণ ছিল না। বাবা ফ্রেড ছিলেন অ্যাথলিট, মা একটি মাধ্যমিক স্কুলের অধ্যক্ষ। বাবা-মা’র আদর, বোনদের ভালবাসায় সাঁতারকে বেছে নেয়া ফেল্পসের আকাশে নেমে আসে অন্ধকার। ১৯৯৪ সালে ফেল্পসের বয়স যখন মাত্র ১০, তখন ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় বাবা মা’র। তার পর মা’র সংগ্রামী জীবন, ২ মেয়ে এবং ছেলে ফেল্পসকে নিয়ে শুরু মা’র এই কঠিন জীবনটাই প্রত্যয়ী করে তুলেছে ফেল্পসকে।
সাফল্যের এতো সব কৃতিগাঁথার পরও কিন্তু ফেল্পসের জীবনটা বড়ই বৈচিত্রপূর্ণ। ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিকে নিজেকে চেনানোয় (৬ স্বর্ণ ২ ব্রোঞ্জ) যুক্তরাষ্ট্রে ফেল্পস বন্দনায়ও তার অপরাধকে ক্ষমা করেনি দেশটি। মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর দায়ে গ্রেফতার পর্যন্ত হয়েছিলেন। ২৫০ ডলার জরিমানার সঙ্গে তার ড্রাইভিং লাইসেন্স ১৮ মাসের জন্য কেড়ে নেয়া হয়েছিল। ২০১৪ সালে সাঁতারে ফিরে একবার গতিসীমার চেয়ে বেশি গতিতে গাড়ি চলানোর অপরাধে সাঁতারের উপর নিষেধাজ্ঞাদেশ জারী হয় তার উপর। এমন বৈচিত্রপূর্ণ জীবনকেও স্মরণীয়তম করে রেখেছেন। অলিম্পিকে এমন কিছু সৃষ্টি করেছেন, তাতে অমর হয়ে রইবেন শত শত বছর। পানি থেকে রেকর্ড, ইতিহাসে ছুঁয়েছেন আকাশ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।