বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মাহমুদ ইউসুফ
বাংলাদেশে যত অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ রয়েছে সেগুলোর বেশিরভাগই ভারতের। মদ, ফেনসিডিল দিয়ে তরুণ সমাজকে ধ্বংস করছে তারাই। সারা দেশে গিজ গিজ করছে তাদের গুপ্তচর। এরাই বাংলাদেশে সন্ত্রাস জঙ্গিবাদি নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করেছে। এক সময় বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী অধ্যয়ন করত ভারতীয় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। দেশে বিভিন্ন পর্যায়ে বেসরকারি, প্রাইভেট স্কুল কলেজ বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ায় শিক্ষার্থীদের বহির্গমন হ্রাস পায়। সাম্প্রতিক জঙ্গি সহিংসতার পেছনে এ বিষয়টিও কাজ করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা সৃষ্টির মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের ভাগিয়ে নিয়ে যাবে। অন্যদিকে সুন্দরবন ধ্বংস করে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ যাতে নির্বিঘেœ করা যায় সেজন্য জনগণের দৃষ্টিকে অন্যদিকে সরানোর জন্য তারা সন্ত্রাস জঙ্গি তৎপরতায় অংশ নেয়। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী যথার্থই বলেছেন, ভারতের কারণেই দেশে জঙ্গিবাদের সৃষ্টি (সূত্র : দৈনিক ইনকিলাব, ঢাকা; ৩ আগস্ট ২০১৬)।
ভারতের সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান ফিল্ড মার্শাল মানেক শ’ বলেন, বাংলাদেশীদের প্রতি আমরা সঠিক আচরণ করিনি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের সব রকমের সাহায্য করা উচিত ছিল। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা তা করেননি। তারা বেনিয়ার মতো আচরণ করছেন (সূত্র : দৈনিক স্টেটসম্যান, ভারত, ২৯ এপ্রিল, ১৯৮৮; উদ্ধৃতি : আসাদ বিন হাফিজ, দৃশ্যপট একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা প্রকল্প, প্রথম প্রকাশ, নভেম্বর-২০০৮)। আজও তারা এটাই করে যাচ্ছেন। তাই সঙ্গত কারণেই ভারতকে বিশ^াস করা বা বন্ধু ভাবার কোনো অবকাশ নেই।
বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সন্ত্রাস : ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাস জিইয়ে রেখেছে বিগত ৪৫ বছর যাবত। অফুরন্ত সম্পদের ভা-ার রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবানকে দখল করার নিমিত্তে বাংলাদেশ থেকে এ অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত ভারত। অন্যদিকে ভারতের হিন্দুত্ববাদী সীমান্তরক্ষী বাহিনী উগ্র বিএসএফ ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশে ১০ সহ¯্রাধিক নাগরিককে হত্যা করেছে। তাদের স্বীকৃতি মোতাবেক ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে নয় হাজার বাংলাদেশীকে খুন করে বর্বর বিএসএফ-এর হিং¯্র সদস্যরা (সূত্র : সালাহ উদ্দিন শোয়েব চৌধুরী : র-এর ভয়াল থাবা, জ্ঞান বিতরণী, ৩৮/৪ বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০, প্রথম প্রকাশ সেপ্টেম্বর ২০০১, পৃ ১৩৪)।
সাম্প্রদায়িক স¤্রাট ভারত : ১৯৪৩ সালে ডেমরার রূপগঞ্জের মুড়াপাড়ায় কংগ্রেস-মহাসভা নেতা ড. শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেন, মুসলমান ইনসান হৌ তো জানোয়ার কৌন হো (সূত্র : আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল প্রথম খ-Ñ সরকার শাহাবুদ্দিন আহমদ, বুকস ফেয়ার, প্রকাশ ২০০৪, পৃষ্ঠা-২৬৩)। অর্থাৎ মুসলমানরা যদি মানুষ হয় তাহলে জন্তু জানোয়ার কারা? ভারতীয় হিন্দুদের জাতীয় আন্দোলনের পথিকৃত, রাষ্ট্রগুরু, কংগ্রেস নেতা বালগঙ্গাধর তিলক, ১৮৯৮ সালে কেশরী পত্রিকায় তিলক গো-হত্যা নিবারণী সভা প্রতিষ্ঠা করে মুসলমানদের খোলাখুলি এক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান করেন এবং ব্রিটিশ সরকারকে মসজিদের সামনে বাজনা বন্ধের আইন প্রত্যাহার করতে বলেন। তিনি গীতা হইতে প্রমাণ করিতে চাহিয়াছিলেন যে, মহাভারতের দৃষ্টিতে আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা কর্তব্য বিশেষ। অতএব যেসব পরদেশী (মুসলমান) এই দেশে বাস করিতেছেন তাহাদের এই দেশ হইতে বাহির করিয়া দেয়া কিংবা হত্যা করা দোষের নয় (সূত্র : রবাট বায়রন : স্টেটসমেন্ট অব ইন্ডিয়া; উদ্ধৃতি : আবুল আসাদ : যুগ সন্ধিক্ষণের পৃথিবী, মিজান পাবলিশার্স, ২১ শে বইমেলা ২০০৬, পৃষ্ঠা-১৩০)।
বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, মুসলমানদের পর ইংরেজ রাজা হইল। হিন্দুপ্রজা তাতে কথা কহিল না। বরং হিন্দুরাই ডাকিয়া রাজ্যে বসাইল। হিন্দু সিপাহীরা ইংরাজের হইয়া লড়িল। হিন্দুর রাজ্য জয় করিয়া ইংরাজকে দিল। কেননা, হিন্দুর ইংরাজের উপর ভিন্ন জাতীয় বলিয়া কোনো দ্বেষ নাই। আজিও ইংরেজের অধীন ভারতবর্ষ (হিন্দু সম্প্রদায়) অত্যন্ত প্রভুভক্ত (সূত্র : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় : ধর্মতত্ত্ব; উদ্ধৃতি : এস.এ সিদ্দিকী বার-এট-ল : রফিক মঞ্জিল, স্টেশন রোড, চট্টগ্রাম, প্রথম সংস্করণ : জুলাই ১৯৭৫, ভূমিকা, পৃ ১০)। ইংরেজ খিস্টানদের সাথে বঙ্কিমবাবুদের কোনো বিরোধ নাই। আক্রোশ, হিংসা, দ্বেষ, প্রতিশোধপরায়ণতা যত মুসলিমদের সাথে। এটাই সত্য-মিথ্যার চিরন্তন সংঘাত। আল্লাহ এবং আল্লাহদ্রোহীদের মধ্যে তফাত এটাই। সভ্যতার শুরু থেকেই এ দ্বন্দ্ব চলে আসছে।
আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক এমপি মরহুম আবদুল মোহাইমেন বলেছেন, দেশ বিভাগের সময় (১৯৪৭ সালে) কংগ্রেস এবং লীগ নেতারা প্রতিশ্রুত দিয়েছিলেন যে, তারা নিজ ভূখন্ডে সংখ্যালঘুদের পূর্ণমাত্রায় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবেন। দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান সরকার তাদের ওয়াদা পুরোপুরি রক্ষা করেছে। পাকিস্তান হওয়ার পর শুধু ১৯৫০ সাল ও ১৯৬৪ সালে মাত্র দু’বার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল। আর ভারতে গত ৬০ বছরে কয়েক হাজারবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। তাতে কয়েক লাখ মুসলমান এ যাবত নিহত হয়েছে। গত কয়েক বছর যাবত বাবরি মসজিদকে উপলক্ষ করে ভারতে বিভিন্ন রাজ্যে যেভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে মুসলিম নিধন চলছে এবং সাম্প্রতিককালে বোম্বে, গুজরাটে প্রভৃতি শহরে বিজেপির নেতৃত্বে যেভাবে পাইকারী হারে মুসলিম হত্যা হয়েছে এসব দেখার পর সাধারণভাবেই মুসলমানদের মনে দৃঢ় বিশ^াস জন্মেছে, হিন্দুদের কাছ থেকে কোনোদিনই মুসলমানরা সুবিচার পেতনা (যদি দেশ বিভাগ না হতো)। বাবরি মসজিদের ব্যাপারে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার খোলস সম্পূর্ণভাবে উন্মোচিত হয়ে গিয়েছে। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার ব্যাপারে কংগ্রেস সরকারের যে মৌন সম্মতি ছিল এবং ভেতরে ভেতরে বিজেপিকে যে নরসীমা সরকার সম্পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কংগ্রেসের এই গোপন হিন্দু-প্রীতিকেই জিন্নাহ সাহেব দারুণ ভয় ও অপছন্দ করতেন। শেষ পর্যন্ত হিন্দুস্বার্থের বেদিতে যে কংগ্রেস তার আদর্শকে জলাঞ্জলি দিবে এ সম্পর্কে জিন্নাহ সাহেব স্থির নিশ্চিত হয়েছিলেন। তাই তিনি মুসলিম লীগকে সংগঠিত করে পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে মুসলমানদের জন্য স্বাধীন আবাসভূমি সৃষ্টি করে ভারতের অধিকাংশ মুসলমানকে হিন্দু আধিপত্য থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন (সূত্র : এম. এ. মোহাইমেন : ইতিহাসের আলোকে দেশবিভাগ, পাইওনিয়ার পাবলিকেশন্স, মতিঝিল ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪, পৃ ২৪৫)।
বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ উপন্যাসে ভবা মহেন্দ্রকে বলেছেন, কোনো দেশের মানুষের সিন্দুকে টাকা রাখিয়া সোয়াস্তি নাই। সিংহাসনে শালগ্রাম রাখিয়া সোয়াস্তি নাই, ঝি-বউয়ের পেটে ছেলে রেখে সোয়াস্তি নাই, পেট চিরে ছেলে বার করে (মুসলমানরা)। সকল দেশের রাজার সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণের সম্বন্ধ আমাদের মুসলমান রাজ রক্ষা করে কই। ধর্ম গেল, এখন প্রাণ যায়। এ নেশাখোর নেড়েদের (মুসলমানদের) না তাড়াইলে আর হিন্দুর হিন্দুয়ানি থাকে না/ মহে। তাড়াবে কেমন করে?/ ভবা। মেরে (সূত্র : বঙ্কিম রচনাসমগ্র ১, উপন্যাসসমগ্র, (আনন্দমঠ, ১ম খ-, ১০ম পরিচ্ছেদ) বিজয় চৌধুরী ও বিপ্লব চৌধুরী সম্পাদিত, ১ম ক্যাবকো প্রকাশ, অমর একুশে গ্রন্থমেলা ১৯৯৯, পৃ ৫৪২)। বঙ্কিম মুসলমানদের তাড়াতে চান, মুসলমানদের দেশ ছাড়া করতে চান (সূত্র : যুগ সন্ধিক্ষণের পৃথিবী, আবুল আসাদ, মিজান পাবলিশার্স, ২১ শে বইমেলা ২০০৬, পৃষ্ঠা-১৩০)।
ভারতবর্ষে হিন্দু সা¤্রাজ্য স্থাপনের কল্পপথিক সাম্প্রদায়িক মহারাজা শিবাজি। সে কাজে কতকাংশে সফলও হয়েছিলেন। ১৯ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে শিবাজির উত্তরসূরীদের তথা হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের উন্মেষ ঘটে। তারই প্রকাশ দেখা যায় বাংলায় ‘হিন্দুসেনা’ পূনায় ‘সার্বজনীন সভা’ ও মাদ্রাজে ‘মহাজন সভা’র প্রতিষ্ঠায়। এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুদের মধ্যে ধমীঁয় একতার উন্নয়ন ও বিকাশ সাধন। সেই ধর্মীয় জোয়ারের মুখেই বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ-এ তাঁর ‘সন্তান-সেনাদের’ মুখে দিলেন সেই বিখ্যাত ‘বন্দে মাতরম’ গান, বক্ষে দিলেন শত্রু (মুসলিম) নিধনের জন্য কালিমাতার শক্তিবাদের ভক্তিপ্লুত অভয় মন্ত্র। ১৮৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত হলো স্বামী দয়ানন্দের ‘গো-রক্ষিণী সমিতি’। ১৮৯৬ সালে পশ্চিম ভারতে বাল গঙ্গাধর তিলক উদ্বোধন করলেন ‘শিবাজি উৎসব’ (এর সবকিছুর মধ্যে ছিল একটি গভীর যোগসূত্র সেটা হলো ভারতবর্ষ থেকে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের নির্মূল) এবং তা থেকে জাতীয়তাবোধের যে রূপ ফুটে ওঠে তা হচ্ছেÑ হিন্দুর ধর্ম, হিন্দুর জাতি-জ্ঞান এবং তদজাত জাতীয়তা-জ্ঞানের এক বিপুল সমাহার (সূত্র : আসকার রচনাবলি ১০, সম্পাদনায় তাইমুর রশীদ, শিল্পতরু প্রকাশনী, ১২/৫ তাজমহল রোড, ব্লক-সি, মোহাম্মাদপুর ঢাকা-১২০৭, প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০০৬, পৃ ১৮৬-১৮৭)।
বাংলাদেশে প্রথম জঙ্গিবাদি আন্দোলন শুরু হয় বিশ শতকের গোড়ার দিকে। ঢাকাকেন্দ্রিক পূর্ববঙ্গ ঘোষিত হলে একমাত্র ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন ছাড়া সকল হিন্দু বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা, সূর্যসেন এই জঙ্গিবাদি আন্দোলনেরই প্রডাক্ট। পলাশীর ষড়যন্ত্রীরা, বঙ্গভঙ্গ বিরোধীরা, ১৯৪৭ সালে স্বাধীন অবিভক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠার বিরোধিতাকারী, স্বাধীন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষবাদী, ১/১১-এর কুশীলব।
১৯০৬ সালে পালিত হয় শিবাজি উৎসব। ড. বি. বি. মিশ্র তাঁর গবেষণা বই ‘দি ইন্ডিয়ান মিডেল ক্লাস: দেয়ার গ্রোথ’ এ লিখেছেন (তরযমা), বাল গঙ্গাধর তিলক হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতায় বিশ^াসকে মূলধন করে হিন্দু যুবকদের সন্ত্রাসবাদে উত্তেজিত করেছিলেন। (পৃ ৩৮৩-৩৮৪)। বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে স্বদেশী আন্দোলন ও হিন্দুধর্মীয় আন্দোলন সমান উৎসাহে চলতে থাকে। এমনি পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটেই অরবিন্দ-বারীন্দ্র ঘোষ ভ্রাতৃদ্বয় ‘অনুশীলন সমিতি’র পরিকল্পনা করেন এবং বঙ্গভঙ্গ রোধ করার ব্রতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ‘অনুশীলন সমিতি’র সন্ত্রাসবাদী যুবকেরা, বঙ্কিমচন্দ্রের সেই কল্পিত ‘সন্তান-সেনারা’। ইতিহাস তাই প্রমাণ করে যে, শিবাজি-বঙ্কিমচন্দ্র-তিলক-লাজপত রাই প্রমুখ পথিকৃৎদের কাছ থেকেই বাংলার সন্ত্রাসবাদী দলসমূহ লাভ করত তাদের বিপ্লবী সংগ্রামের অনুপ্রেরণা (সূত্র : ওই, পৃ ১৮৮)। বর্তমান পাক-ভারত-বাংলার জঙ্গিবাদিরাও ওই আদর্শে অনুপ্রাণিত ও বিভ্রান্ত।
নোবেল খেতাবপ্রাপ্ত ঠাকুর কবিও শিবাজি উৎসবকে স্বাগত জানালেন। তিনি শিবাজির প্রশস্তি গেয়ে লিখলেন কবিতা, চিত্রিত করলেন তাঁকে হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির বাঁধনে উদ্বুদ্ধ ‘এক ধর্মরাজ্য স্থাপনের প্রচেষ্ঠায় রত মুঘলদের বিরুদ্ধে সংগ্রামশীল এক মহানায়ক হিসেবে। ঠাকুর লিখলেন : ধ্বজা করি উড়াইব বৈরাগীর উত্তরীবসন-দরিদ্রের বল/এক ধর্মরাজ্য হবে এ ভারতে ‘এ মহাবচন করিব সম্বল’ (সূত্র : ওই, পৃ ১৮৮-১৮৯)। বর্তমান ভারতে ৫০ শতাংশের বেশি অধিবাসী মুসলিম, হরিজন, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, উপজাতি সম্প্রদায়ের। হিন্দুদের অবস্থান ৫০ শতাংশের নিচে। অথচ কথিত কবিগুরু, বিশ^কবি হিন্দুরাষ্ট্র গড়া এবং সকল ভারতীয়কে হিন্দুধর্মে দীক্ষিত করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
মুসলিমমুক্ত ভারত প্রতিষ্ঠায় এগুচ্ছে বর্ণহিন্দু নেতৃবৃন্দ : ভারতীয় বুদ্ধিজীবী ভি. টি. রাজশেখর বলেছেন, ‘স্পেন থেকে ইসলাম কীভাবে উৎখাত হলো ভারতে হিন্দু নাজীদের জন্য এ বিষয়টি বিংশ শতাব্দীর ৩০ থেকে ৪০ দশকের গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল। সুদীর্ঘ সময়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফসলস্বরূপ আহত জ্ঞানকে তারা অনুরূপভাবে ভারতবর্ষে (বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার...) বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করল। অপরদিকে মুসলিম নেতৃবৃন্দের প্রতিরোধে জোরালো ভূমিকা নেয়া থেকে বিরত থাকায় হিন্দু নাজী গোষ্ঠী এখানে স্পেনীয় মেথড প্রয়োগে একের পর এক পদক্ষেপ (মুসলিম উৎখাত ও নির্মূলের) নেয়া শুরু করে (সূত্র : ভি.টি. রাজশেখর : ভারতীয় মুসলমানদের সমস্যা, অনুবাদ-ড. আ.ই.ম. নেছারউদ্দিন, ইখওয়ান লাইব্রেরি, ৩৪/২, নর্থব্রুক হল রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা-১২০০, ফেব্রুয়ারি-২০০৩, পৃষ্ঠা-১ ও ৪৮)। ভারতের বিশ^ হিন্দু পরিষদ নেত্রী সাধ্বী প্রাচী সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন, মুসলিমমুক্ত ভারত প্রতিষ্ঠার। তিনি বলেছেন, মুসলিমমুক্ত ভারত চাই (সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন ৮ জুন ২০১৬, এমটি নিউজ২৪.কম ৭ জুন ২০১৬, কালের কণ্ঠ, ৯ জুন ২০১৬)।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প মুসলিমবিদ্বেষী প্রার্থী হিসেবে নিজেকে জাহির করেছেন। তিনি আমেরিকায় মুসলিমদের প্রবেশ নিষিদ্ধেরও প্রস্তাব করেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুসলিম অ্যালার্জির কারণেই দিল্লির হিন্দু সেনারা তার জয়ের প্রার্থনায় পূজা অর্চনার আয়োজন করে (সূত্র : দৈনিক ইনকিলাব ১৩ মে ২০১৬, দৈনিক যুগান্তর ১৩ মে ২০১৬)। ট্রাম্পকে নিয়ে তারা মুছে দিতে চায় মুসলিমদের নাম-নিশানা। দুনিয়ায় যত প্রকার সাম্প্রদায়িক চর্চা আছে সবগুলোতেই দক্ষ বর্ণহিন্দুরা।
অবিরাম সহিংসতায় জড়িত ভারত : ২০০৫ সালে মার্কিন কংগ্রেসে ভারতের সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে বলা হয়, ভারতে সংখ্যালঘুরা জিম্মি হয়ে পড়েছে। কংগ্রেসম্যান হডলফাস টাউন্স বলেন, ভারতে সুন্দর একটি সংবিধান আছে। কিন্তু স্বাধীন ৫৮ বছরেও সেই সংবিধানের সুন্দর সুন্দর বাক্যগুলোকে কার্যকরী হতে দেখা যায়নি। ভারতীয় সংবিধানে কোনো শিখ সদস্য স্বাক্ষর করেনি।... (সূত্র : এনা; দৈনিক ইনকিলাব ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০০৫)।
ভারত বিখ্যাত মানবাধিকার কর্মী অরুন্ধতি রায়ের ভাষ্যে, ভারত এমন এক রাষ্ট্র, যে অবিরাম যুদ্ধে লিপ্ত। আর ভারত রাষ্ট্র সর্বদাই উপজাতীয় লোকজন, খ্রিস্টান, মুসলিম, শিখ প্রভৃতি সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে; তবে কখনো মধ্যবিত্ত ও উচ্চবর্ণ হিন্দুর বিপক্ষে নয়। সরকার ও পুলিশের কাছে নির্যাতন এখন পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য ব্যাপার। ভারত সরকার সবার পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়ে রেখেছে (সূত্র : অরুন্ধতী রায়, অরুন্ধতী রায়ের সাক্ষাৎকার, তরযমাÑ মীযানুল করীম, মাসিক অন্য এক দিগন্ত, ঢাকা, ৬ নভেম্বর ২০১৪)। [সমাপ্ত]
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।