বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মাহমুদ ইউসুফ
বর্তমান দুনিয়ার একটা প্রধান সমস্যা জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ। মনুষ্যত্ব, মানবতা ও মানবাধিকারের ভিত্তিমূল দুর্বল হয়ে পড়েছে জঙ্গি সন্ত্রাসীদের আগ্রাসনে। আতঙ্কিত ও বিপর্যস্ত শান্তিকামী মানুষেরা। কম্পন সৃষ্টি হয়েছে বিবেকমান নাগরিকদের হৃদয়ে। আর অট্টহাসি হাসছে ইবলিসের প্রেতাত্মা ও তাদের ক্রীড়নকরা। কিন্তু কে এর কলকাঠি নাড়ছে? কী এদের পরিচয়? কারা এর পশ্চাতে জড়িত? কারা এখানে বিনিয়োগ করছে? কারা জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে? কাদের আশ্রয়-মদদে এরা ত্রাস করছে? তাদের মুখোশ উন্মোচন করাই এই প্রবন্ধের মুখ্য উদ্দেশ্য। আমাদের ধারণা, ভারতীয় আর্যহিন্দুদের অতীত ও বর্তমান পর্যালোচনা করলেই বিশ^জুড়ে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদের রহস্য বেরিয়ে আসবে।
সেই যুগ : ভারতীয় চিন্তাবিদ, গবেষক শেখ নাসীর আহমদ বলেন, আর্যরা এসেছিল এক যাযাবর জাতি হিসেবে। তারা এদেশের অনার্য সভ্যতাকে ধ্বংস করে। তাদের সর্বপ্রকার মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। তাদের মানবেতর দাসের জীবন গ্রহণ করতে বাধ্য করে। দেশীয় জনসাধারণ আত্মোন্নতির সর্বপ্রকার সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। মি. শেঠী লিখেছেন, ‘ব্রাহ্মণ্যবাদ উত্তর ভারতের সবকিছুকেই ধ্বংস করেছিল।’ আর্যরা অনার্যদের তাদের দেবভাষা সংস্কৃত লিখতে পড়তেও দেয়নি। ‘এভাবেই ব্রাহ্মণ্যবাদ সব সৃজনী প্রতিভাকে ধ্বংস করেছে’ (সূত্র : উদ্ধৃতি : ড. মুহাম্মাদ সিদ্দিক : ভারতের নির্মম গণহত্যা, আধুনিক প্রকাশনী, বাংলাবাজার ঢাকা-১১০০, পৃ ৫৩৪)।
আর্যরা এক বর্বর জাতি ছিল, তা আধুনিক প্রতœতাত্ত্বিক আবিষ্কার ও বৈদিক অনুশীলনের ফলে জানা গিয়েছে। এ সম্বন্ধে প্রথম মন্তব্য প্রকাশ করেন বিখ্যাত প্রতœতত্ত্ববিদ ভি. গর্ডন চাইল্ড। ১৯২৬ সালে তাঁর প্রসিদ্ধ বই ‘দি আরিয়েনস’-এ তিনি বলেন, আর্যদের বর্বরতা বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছিল তাদের কার্যকলাপে। জগতের যেখানেই তারা গিয়ে বসতি স্থাপন করেছিল, সেখানেই তারা সেখানকার উন্নত সভ্যতাকে ধ্বংস করে। চাইলড-এর মন্তব্য পরবর্তীকালে আবিষ্কৃত প্রাগার্য সভ্যতাসমূহের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে প-িত সমাজ এটা একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন। সর্বত্রই তারা উন্নতমানের প্রাগার্য সভ্যতাকে ধ্বংস করে, নিজেদের হীন ও বর্বর সভ্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করে (সূত্র : ড. অতুল সুর : হিন্দু সভ্যতার বুনিয়াদ, জিজ্ঞাসা এজেন্সিজ্ লিমিটেড, ১ এ কলেজ রোড, কলিকাতা-৯, প্রথম প্রকাশ জুন ১৯৯১, পৃ ৩৫)।
আর্যদের আদি নিবাস পোল্যান্ড ও দক্ষিণ রাশিয়া। পশুচারণকারী যোদ্ধা যাযাবর আর্য জনগোষ্ঠী কালক্রমে জীবনধারণের প্রয়োজনেই নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে চলে আসে পারস্যে অর্থাৎ বর্তমান ইরানে। ঐতিহাসিক মাইকেল এডওয়ার্ডিসের মতে, (এ হিস্টরি অব ইন্ডিয়া) ইরান থেকেই তাদের একাংশ এসেছিল ভারতবর্ষে। আর্যদের আগমনকালে ভারতবর্ষে পশ্চিমাঞ্চলে প্রজ্বলিত ছিল সিন্ধু সভ্যতার দীপশিখা। সেই দীপশিখাই নিভে গিয়েছিল আর্যদের সদর্প হুঙ্কারে। সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকারীদের বিপর্যস্ত করে যাযাবর আর্যরা (সূত্র : আসকার রচনাবলি ১০, সম্পাদনায় তাইমুর রশীদ, শিল্পতরু প্রকাশনী, ১২/৫ তাজমহল রোড, ব্লক-সি, মোহাম্মাদপুর ঢাকা-১২০৭, প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি-২০০৬, পৃ ২৫৩)। ভারতবর্ষের প্রাচীনতর সভ্যতা ও সংস্কৃতি ধ্বংসে বৈদিক আর্যরা যতখানি সাফাল্য লাভ করে তা পরবর্তী কোনো অভিযাত্রী বাহিনী করেনি। পরবর্তীকালেও বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস ও লুট করেছে হিন্দুরা (সূত্র : সুরজিৎ দাশগুপ্ত : ভারতবর্ষ ও ইসলাম, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা-১০০০, প্রথম বাংলাদেশ মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি-২০১৪, পৃ ২৫৭)।
পৃথিবীতে সর্বপ্রথম আর্যহিন্দুরা যুদ্ধ শুরু করেছে। যেমন রাম-রাবণের যুদ্ধ, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, আর্য-অনার্য সংগ্রাম এদেরই কীর্তি। আমাদের জানামতে, পৃথিবীতে সংঘটিত এগুলোই প্রথম যুদ্ধ। বিগ্রহ মূর্তিপূজার সাথে সংশ্লিষ্ট। এই বিগ্রহকে তারা যুদ্ধের সাথে একত্র করে যুদ্ধবিগ্রহ নাম দিয়েছে। অর্থাৎ যুদ্ধবিগ্রহ তাদের পূজা উপাসনা। এদের ইতিহাসই বর্বরতার, অসভ্যতার, মানবতাবিধ্বংসী। ধ্বংসযজ্ঞই আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদের নেশা-পেশা। এরা ভারতে প্রবেশ করেই অগণিত নগর শহর ধ্বংস করে এবং লাখ কোটি বনি আদম হত্যা করে। কোটি কোটি মানুষের রক্তের ওপর এ ধর্ম প্রতিষ্ঠিত। এ প্রসঙ্গে বিশ^বিখ্যাত দার্শনিক, চিন্তাবিদ, ভারতীয় রাজনীতিক শ্রী মানবেন্দ্র নাথ রায় যথার্থই বলেছেন, ‘হিন্দুদর্শনই ভারতীয় সমাজদেহে আনে বিরাট বিশৃঙ্খলা’ (সূত্র : এম এন রায় : ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান, (তরযমা-আবদুল হাই), মল্লিক ব্রাদার্স, ৫৫ কলেজ স্ট্রিট, কলিকাতা ৭৩, দ্বিতীয় সংস্করণ, জানুয়ারি ১৯৯৫, পৃ ৮৩)।
যুদ্ধ কাহিনী রামায়ণ : রামায়ণ রচনা করেন কবি বাল্মীকি প্রায় আড়াই-তিন হাজার বছর পূর্বে। রাম-রাবণের যুদ্ধ কাহিনী নিয়ে এ গ্রন্থ। আর্য নেতা রামের স্ত্রী সীতাকে রাবণ অপহরণ করায় তাকে উদ্ধার করার জন্য সংঘটিত হয় রক্তক্ষয়ী জঙ্গি যুদ্ধ। এই লড়াইয়ে রামের হাতে নিহত হয় দ-কবনে খর, দূষণ, ত্রিশিরা এবং ১৪ হাজার রাক্ষস (সূত্র : রাজশেখর বসু অনূদিত, বাল্মীকি রামায়ণ, নবযুগ প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০, পঞ্চম মুদ্রণ, জুলাই-২০১৪, যুদ্ধকা-ের ২১/সর্গ ৭৮-৭৯, পৃ ২৫১)। ৬৭ কোটি বানর ব্রাহ্মাস্ত্রের আঘাতে নিহত হয় (সূত্র : রাজশেখর বসু অনূদিত, বাল্মীকি রামায়ণ, যুদ্ধকা-Ñ ১৯/সর্গ ৭৪, পৃ ২৪৮)। রামায়ণে যাদের বানর ও রাক্ষস আখ্যা দেয়া হয়েছে, তারা ভারতের প্রাগার্য জাতিসমূহ ব্যতীত আর কেউই নয়। বালী, সুগ্রীব প্রভৃতিকে বানর বলাও বাল্মীকির কল্পনাপ্রসূত। কেননা তাদের পিতা সুষেণই ছিলো সে যুগের একজন সুদক্ষ শল্য চিকিৎসক (সূত্র : ড. অতুল সুর : হিন্দু সভ্যতার বুনিয়াদ, কলিকাতা ৯, প্রথম প্রকাশ জুন ১৯৯১, পৃ ৬)। অতএব এ সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে যারা নিহত হয় তারা সবাই ছিল আমাদের মতোই রক্তগোশতের মানুষ।
ব্রাহ্মণ্য প্রতিক্রিয়ায় বৌদ্ধ-বিপ্লব যখন পর্যুদস্ত হয়ে গেল আর তাতেই হলো ভারতের সমাজে বিশৃঙ্খলার উৎপত্তি (সূত্র : এম এন রায় : ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান, (তরযমা-আবদুল হাই), মল্লিক ব্রাদার্স, ৫৫ কলেজ স্ট্রিট, কলিকাতা, পৃ ৮৭)। শ্রী ভারতীয় গবেষক সুরজিৎ দাশগুপ্তের ভাষায়, পঞ্চম শতাব্দী নাগাদ বৌদ্ধধর্মকে (কেরল থেকে) সম্পূর্ণ উৎখাত করে ব্রাহ্মণ্য ধর্মই সর্বশক্তিমান হয়ে ওঠে ও সমাজের সর্বস্তরে তার কঠোর বিধান শাসনকে অমোঘরূপে প্রতিষ্ঠা করে। এই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মধ্যে উচ্চ আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল জনসাধারণের বৃহত্তর অংশকে অপমান, ঘৃণা, পীড়ন ও শোষণ করার সামাজিক সমর্থনÑপ্রকৃতপক্ষে আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অগ্রগামিতা ও উদারতা এবং ব্যবহারিক ক্ষেত্রে বিচিত্রতর প্রতিক্রিয়াশীলতা ও সঙ্কীর্ণতা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অন্তর্নিহিত বিরোধ (সূত্র : সুরজিৎ দাশগুপ্ত : ভারতবর্ষ ও ইসলাম, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা-১০০০, প্রথম বাংলাদেশ মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি ২০১৪, পৃ ১৪১)।
বেদে যা আছে : আর্যদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ। চার বেদের মধ্যে ঋগবেদ প্রাচীন। ঋগবেদখানা পড়লে বোঝা যায় যে, আর্যরা ছিল একটা হাঘরে জাত। ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বেদের উৎপত্তি হলেও সমগ্র বেদখানাতে প্রকটিত হয়েছে দেবতাদের কাছে, তাদের বৈষয়িক প্রার্থনাÑ ঋগবেদের ১০ হাজার মন্ত্রের মধ্যে হাজারখানেকে শুধু একই কথা বলা হয়েছেÑ দাও আমাদের শত্রুর ধন দাও, দাও আমাদের শত্রুর সম্পদ, দাও আমাদের শত্রুর গাভী, দাও আমাদের শত্রুর মেয়েছেলে ইত্যাদি। সর্বত্রই বলা হয়েছেÑ ‘আমার শত্রুকে ধ্বংস কর, তাদের সকল সম্পদ আমাদের দাও, অন্য কাউকে দিও না। কেবল আমাদের মঙ্গল কর (সূত্র : ড. অতুল সুর : হিন্দু সভ্যতার বুনিয়াদ, কলিকাতা ৯, প্রথম প্রকাশ জুন ১৯৯১, পৃ ৩৬)। বিপরীত সম্প্রদায়ের ধ্বংসই যেন ওদের কাম্য।
ইন্দ্র হলো হিন্দুপুরাণের স্বর্গের দেবতাদের রাজা। আর্যসভ্যতার ইতিহাসবেত্তাদের মতে, ইন্দ্র সম্ভবত ভারতে আগত আর্যদের মধ্যে কোনো এক রাজা বা পরাক্রান্ত নেতার নাম, যা কালক্রমে দেবতাদের রাজা আখ্যা পেয়েছে হিন্দুধর্মে। ঋগবেদে ইন্দ্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। ইন্দ্র ঋগবেদের দেবতাদের মধ্যে প্রধান। দুর্দমনীয় যোদ্ধারূপেই তিনি পরিকল্পিত। অগ্নি এবং পূষা তার ভ্রাতা। তিনি আর্য জাতির রক্ষক, তার জন্য তিনি দস্যুদের বধ করতেও কুণ্ঠিত নন(ঋগবেদ ৩/৩৪/৯)। (সূত্র : উইকিপিডিয়া/ ঋগে¦দ-সংহিতা [প্রথম খ-], পৃ ৪৩, ৩২৮)। বহু শত্রুর দমনকারী, বহু বরণীয় ধনের স্বামী ইন্দ্রকে লক্ষ্য করে গাওয়া হয়, তিনি আমাদের উদ্দেশ্য সাধন করুন, তিনি ধন প্রদান করুন, তিনি স্ত্রী প্রদান করুন, তিনি অন্ন নিয়ে আমাদের নিকটে আগমন করুন (সূত্র : ঋগবেদ- ১/৫/২-৩, ঋগে¦দ-সংহিতা [প্রথম খ-], হরফ প্রকাশনী, এ-১২৬ কলেজ স্ট্রিট মার্কেট, কলকাতা ৭, পৃ ৬২)। লোভ-লালসা, পরধন গ্রাস আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদের চিরন্তন রীতি।
হে ইন্দ্র! আমাদের রক্ষণার্থে সম্ভোগযোগ্য, জয়শীল, সদা শত্রুবিজয়ী ও প্রভূত ধন দাও। যে ধনদ্বারা (নিযুক্তি সৈন্যদিগের) নিরন্তর মুষ্টিপ্রহার দ্বারা আমরা শত্রুকে নিবারণ করব অথবা তোমার দ্বারা রক্ষিত হয়ে অশ^ দ্বারা শত্রুকে নিবারণ করব। হে ইন্দ্র! তোমার দ্বারা রক্ষিত হয়ে আমরা কঠিন অস্ত্র ধারণ করি, যুদ্ধে স্পর্ধাযুক্ত শত্রুকে জয় করব। হে ইন্দ্র! তোমার সহায়তায় আমরা বীর অস্ত্রধারীদের সাথে সৈন্যসজ্জাযুক্ত শত্রুকেও পরাভব করতে পার। ইন্দ্র মহৎ এবং সর্বোৎকৃষ্ট, বজ্রধারী ইন্দ্রে মহত্ত্ব অবস্থিতি করুক; তাঁর সৈন্য আকাশের ন্যায় প্রভূত। যে পুরুষেরা সংগ্রামে লিপ্ত হন অথবা পুত্র লাভ ইচ্ছা করেন অথবা যে বিজ্ঞ লোকেরা জ্ঞানাকাক্সক্ষায় থাকেন (তাঁরা সকলেই ইন্দ্রের স্তুতি দ্বারা সিদ্ধি লাভ করেন) (সূত্র : ঋগবেদ- ১/৮/১-৬, ঋগে¦দ-সংহিতা [প্রথম খ-], হরফ প্রকাশনী, এ-১২৬ কলেজ স্ট্রিট মার্কেট, কলকাতা ৭, পৃ ৬৪-৬৫)।
ঘোড়াই আর্যদের সম্বল ছিল, তারা সিন্ধু সভ্যতার বাহকদের কাছ থেকে গাভী চুরি করে এনেছিল। দূতী সরমাকে পাঠিয়ে তারা এর সন্ধান করেছিল। তারপর তারা গুহার মধ্যে রক্ষিত গাভীসমূহ অপহরণ করেছিল। (ঋগবেদÑ ১/৬/৫)। তারা প্রার্থনা করত, হে ইন্দ্র! শত্রু বধকালে এ উভয় জগৎ তোমাকে ধারণ করতে পারে না, তুমি স্বর্গীয় জল জয় কর, আমাদের সম্যকরূপী গাভী প্রেরণ কর। (ঋগবেদÑ ১/১০/৮)। গাভী লাভার্থে ইন্দ্র সিন্ধু সভ্যতার বাহকদের নগরসমূহ বিদীর্ণ করেছিল। (ঋগবেদÑ ১/৫৩/৭, ৪/২৬/৩)। সেজন্য ইন্দ্রের নাম হয়েছিল ‘পুরন্দর’। একমাত্র সিন্ধু সভ্যতার বাহকরাই নগরে বাস করত। আর্যরা বাস করত গ্রামে; কেননা, তাদের সমাজ ও সংস্কৃতি ছিল গ্রামীণ (সূত্র : ড. অতুল সুর : হিন্দু সভ্যতার বুনিয়াদ, পৃ ৩৭; Ñঋগে¦দ-সংহিতা [প্রথম খ-], হরফ প্রকাশনী, এ-১২৬ কলেজ স্ট্রিট মার্কেট, কলকাতা ৭, পরিমার্জিত সংস্করণ ২০০৪, পৃ ৬৩, ৬৬, ১১২, ৩৮২, ৪৭)। সোমরসে তুষ্ট ইন্দ্রের সাহায্যে আমরা দস্যুকে ধ্বংস করব এবং শত্রু হতে মুক্তি লাভ করে সম্যকরূপে অন্ন ভোগ করব। (ঋগবেদÑ ১/৫৩/৪) (সূত্র : ঋগে¦দ-সংহিতা [প্রথম খ-], হরফ প্রকাশনী, এ-১২৬ কলেজ স্ট্রিট মার্কেট, কলকাতা ৭, পরিমার্জিত সংস্করণ ২০০৪, পৃ ১১২)। এখানে দস্যু ও শত্রু বলতে ভারতবর্ষের আদিবাসীদের বোঝানো হয়েছে।
হে ইন্দ্র! তুমি শত্রুবর্ষণকারীরূপে যুদ্ধ হতে যুদ্ধান্তরে গমন কর, বলদ্বারা নগরের পর নগর ধ্বংস কর। হে ইন্দ্র! তুমি নথী ঋষির সহায়ে দূরদেশে মনুচি নামক মায়াবীকে বধু করেছিলে। তুমি অতিথিগ¦ নামক রাজার জন্য করঞ্জ ও পর্ণর নামক শত্রুদ্বয়কে তেজস্বী বর্তনী দ্বারা বধ করেছ; তারপর তুমি অনুচর রহিত হয়ে ঋজিশ^ান নামক রাজার দ্বারা চারদিকে বেষ্টিত বঙ্গৃদ নামক শত্রুর শত নগর ভেদ করেছিলে। সহায় রহিত সুশ্রবা নামক রাজার সাথে যুদ্ধ করবার জন্য যে বিংশ নরপতি ও ৬০,০৯৯ অনুচর এসেছিল, হে প্রসিদ্ধ ইন্দ্র! তুমি শত্রুদের অলঙ্ঘ্য রথচক্র দ্বারা তাদের পরাজিত করেছিলে (ঋগবেদÑ ১/৫৩/৭-৯) (সূত্র : ওই, পৃ ১১২)।
আর্যরা মনে করে এ পৃথিবী তাদের। কারণ ‘আমি আর্যকে পৃথিবী দান করেছি (ঋগবেদÑ ৪/২৬/২) (সূত্র : ওই, পৃ ৩৮২)। অন্য কারও এ ধরাতে বসবাসের অধিকার নেই। অতএব অন্য সকল অধিবাসীকে নির্মূল করতে হবে। অপর জাতি ও সম্প্রদায়ের শক্তি খর্ব করতে হবে, তাদের ধনসম্পদ আত্মসাৎ করতে হবে। এই হলো তাদের মনমানসিকতা।
হে মনুষ্যগণ! যিনি দ্যোতমান, যিনি জন্মগ্রহণ মাত্রেই দেবগণের প্রধান... যুদ্ধকালে শত্রুগণকে বিনাশ করেন, তিনিই ইন্দ্র (ঋগবেদÑ ২/১২/১-৩) (সূত্র : ওই, পৃ ২৬৫)। হে মনুষ্যগণ! যিনি এ সমস্ত নশ^র বিশ^ নির্মাণ করেছেন, যিনি দাসবর্ণকে নিকৃষ্ট এবং গুঢ়স্থানে অবস্থাপিত করেছেন, যিনি লক্ষ্য জয় করে ব্যাধের ন্যায় শত্রুর সমস্ত ধন গ্রহণ করেন, তিনিই ইন্দ্র (ঋগবেদÑ ২/১২/৪) (সূত্র : ওই, পৃ ২৬৫)। হে মনুষ্যগণ! যিনি বজ্রদ্বারা বহুসংখ্যক মহাপাপী অপূজককে বিনাশ করেছেন, যিনি গর্বকারী মনুষ্যকে সিদ্ধি প্রদান করেন না, যিনি দস্যুগণের হন্তা, তিনিই ইন্দ্র। ... যিনি বল প্রকাশকারী অহিনামক শয়ান দানবকে বিনাশ করেছিলেন, তিনিই ইন্দ্র।... যিনি বজ্রবাহু হয়ে স্বর্গারোহণ্যেদ্যত রৌহিণকে বিনাশ করেছিলেন, তিনিই ইন্দ্র (ঋগবেদÑ ২/১২/১০-১২) (সূত্র : ওই, পৃ ২৬৫)। এখানে এদেশের প্রাচীন জাতিগোষ্ঠীর পরাজয়ে ওরা ইন্দ্রের জয়গান করছে।
নগর ধ্বংস : অশ^বাহিত জঙ্গি রথে চেপে আর্যরা ভারতবর্ষে আসে (সূত্র : ড. অতুল সুর : হিন্দু সভ্যতার বুনিয়াদ, কলিকাতা ৯, জুন ১৯৯১, পৃ ২৫)। আর্যরা ছিল যোদ্ধার জাত, আর সিন্ধু সভ্যতার বাহকরা ছিল বণিকের জাত। এই বণিকের ঐশ^র্য ও ধনদৌলত আর্যদের মনে ঈর্ষার সঞ্চার করেছিল। সেজন্যই আর্য গ্রামবাসীরা সিন্ধু সভ্যতার নগরসমূহকে ধ্বংস করতে প্রবৃত্ত হয়েছিল। নগরসমূহকে ধ্বংস করে বিজয়গৌরবের উন্মত্ততায় তারা তাদের প্রধান দেবতা ইন্দ্রের নাম রেখেছিল পুরন্দর (সূত্র : ওই, পৃ ১৪)।
আমি ইন্দ্র সোমপান মত্ত হয়ে শম্বরের নবনবতি সংখ্যক পুরী এককালে ধ্বংস করেছি। আমি যখন অতিথিগ¦ দিবোদাসকে যজ্ঞে পালন করেছিলাম তখন তাকে শততম পুরী বাসের জন্য দিয়েছিলাম (ঋগবেদÑ ৪/২৬/৩), পৃ ৩৮২। অর্থাৎ ইন্দ্র শম্বরের ৯৯টি পুরী ধ্বংস করেছিলেন এবং দিবোদাসকে শততম পুরী বসবাসের জন্য দিয়েছিলেন (সূত্র : ওই, পৃ ৪৭)।
ইন্দ্র শম্বরের নগরসমূহ ধ্বংস করেন এবং ৫০ হাজার কৃষ্ণবর্ণ শত্রুকে (ভারতের আদিবাসী দ্রাবিড়দের) বিনাশ করে (ঋগে¦দ ৪/১৬/১৩)। তিনি দাসবর্ণকে (আদিবাসী) নিকৃষ্ট স্থানে অবস্থাপিত করেন (ঋগে¦দÑ ২/১২/৪)। দুস্যদের (ভারতের প্রাচীন নাগরিক) বধ করে আর্যবর্ণকে রক্ষা করছেন (ঋগে¦দÑ ৩/৩৪/৯) (সূত্র : ওই, পৃ ৪৭)।
নারী অপহরণ : ভারতীয় নারীদের ওপর আর্যদের অত্যন্ত লোভ ছিল এবং তাদের পাবার জন্যই তারা ইন্দ্রের কাছে পুনঃ পুনঃ প্রার্থনা করত। পতœী অর্থে ‘বধু’ শব্দের প্রয়োগ। সামগায়নের উনাদিসূত্র (১/৮৫) অনুযায়ী ‘বধু’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে যাকে বহন করে আনা হয়েছে। তার মানে যাকে কেড়ে আনা হয়েছে। নৃতত্ত্বের ভাষায় যাকে ‘ম্যারেজ বাই ক্যাপচার’ বলা হয় (সূত্র : ড. অতুল সুর : হিন্দু সভ্যতার বুনিয়াদ, কলিকাতা ৯, প্রথম প্রকাশ জুন ১৯৯১, পৃ ১৪, ৩৮)। আর্য হিন্দু পুরুষ কর্তৃক অনার্য বা ভারতীয় নারী অপহরণই সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম গুম অপহরণের ঘটনা। বর্তমান দুনিয়ায় গুম, অপহরণ, নিখোঁজ, কিডন্যাপ, পাচারের সূত্র এখানেই।
প্রাগার্যজাতিসমূহের তুলনায় আর্যরাই ছিল বর্বর জাতি। বৈদিক আর্যরা ভারতীয় আদিবাসীদের দস্যু, দাস, অনার্য, অসুর, পণি, কিরাত, নিষাদ প্রভৃতি অবজ্ঞাসূচক শব্দের দ্বারা অভিহিত করত। এদেশে আগমনের সময় থেকেই বৈদিক আর্যরা উপমহাদেশের প্রাচীন অধিবাসীদের সঙ্গে অবিরাম সংগ্রাম চালায়। বঙ্গজনপদকেও আর্য ভাষাভাষীগণ তষ্কর, বর্বর, পক্ষী, অচ্ছ্যুত, ম্লেচ্ছ ইত্যাদি অধ্যুষিত দেশ বলে গণ্য করত (সূত্র : ওই, পৃ ৫, ১৩; কাবেদুল ইসলাম : প্রাচীন বাংলার জনপদ ও জনজাতিগোষ্ঠী, উত্তরণ, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০. প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৪, পৃ ২৫)।
গীতার বিষয়বস্তু যুদ্ধ : গীতার উৎস মহাভারত; যেটি একটি যুদ্ধকাহিনী নিয়ে রচিত। কুরুক্ষেত্রের আর্য-অনার্য যুদ্ধ নিয়েই ব্যাসদেব রচনা করেন মহাভারত। কুরুক্ষেত্রের ভয়ানক যুদ্ধশেষে মাত্র ১১ জন মানুষ জীবিত ছিল (সূত্র : প্রমথ চৌধুরী, মহাভারত ও গীতা শীর্ষক প্রবন্ধ, প্রবন্ধসংগ্রহ, বিশ্বসাহিত্য ভবন, ৩৮/৪ বাংলাবাজার, ঢাকা-১০০০, পৃ ১৯০)। অন্যান্য যোদ্ধাদের কেউ জীবিত ছিল না। উল্লেখ্য, যুদ্ধ ময়দানে দুর্ধর্ষ নারায়ণ সেনাই ছিল ১০ কোটি (সূত্র : সুধীরচন্দ্র সরকার : পৌরাণিক অভিধান, এমসি সরকার অ্যান্ড সন্স প্রা. লি. ১৪ বঙ্কিম চাটুজ্যে স্ট্রিট, কলকাতা ৭৩, ১০ম সংস্করণ, বৈশাখ ১৪১৫, পৃ ৯৯)। সকলেই শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুন, পঞ্চপা-ব ও অন্যান্যদের হাতে নিহত হয়।
আধুনিক যুগে প্রধান মারণাস্ত্র পারমাণবিক বোমা। এই বিধ্বংসী অস্ত্র আবিষ্কারের পেছনেও গীতার দর্শন কাজ করে। মহাভারতের অজস্র পৃষ্ঠা থেকে ঝাড়াই বাছাই করে ওয়ারেন হেস্টিংসের সম্পাদনায় জন্মানো বইটিই বর্তমান ভারতের জাতীয় গ্রন্থ গীতা। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রিচার্ড ডেভিস তাঁর ‘দ্য ভগবগদ্গীতা : আ বায়োগ্রাফি’তে দেখিয়েছেন, গীতা একইসঙ্গে দুই বইয়ের দ্যোতনা। একটি যুদ্ধের গীতা, অন্যটি দার্শনিক গীতা। প্রথম পরমাণু বিস্ফোরণের পর বিজ্ঞানী ওপেনহাইমার গীতার শ্লোক আউড়েছিলেন (সূত্র : গৌতম চক্রবর্তী : জাতীয় গ্রন্থ’ ঘোষণার আগে গীতার রহস্য একটু জেনে নিলে ভালো হয়, দৈনিক আনন্দবাজার, কলকাতা, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৪)।
গীতায় নারী, বৈশ্য ও শুদ্রকে বলা হয়েছে পাপযোনি। অর্থাৎ সকল অপকর্মের মূল, পাপাত্মা, পাপাচারের মুখ্য নিয়ন্ত্রক। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন, আমাকে আশ্রয় করে স্ত্রী, বৈশ্য, শুদ্র এসব পাপযোনিরাও পরম গতি লাভ করে (গীতা ৯/৪১)। অর্থাৎ নারী, বৈশ্য, শুদ্ররাই পাপের মূল! (সূত্র : কঙ্কর সিংহ : ধর্ম ও নারী প্রাচীন ভারত, র্যাডিক্যাল, ৪৩ বেনিয়াটোলা লেন, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০০৯, পৃ ১৩৩)। [চলবে]
য় লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।