বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
বালক বেলায় যখন ধামতী ইসলামিয়া ফাযিল মাদ্রাসায় (বর্তমানে কামিল) ভর্তি হই এবং মীযান-মুনশায়াব, জুমাল জুবদা, নাহমীর, জাওহারুল ফিকাহ ইত্যাদি কিতাবাদি পাঠ করা আরম্ভ করি, তখন আমাদের কাছে পাঞ্জম হুজুর নামে খ্যাত মাওলানা মোহাম্মাদ সুলতান আহমাদ (রহ.) খুবই প্রিয় হুজুর ছিলেন। তিনি প্রিয় হওয়ার কারণ ছিল এই যে, তিনি আমাদের অত্যন্ত সহৃদয়তার সাথে পাঠদান করতেন এবং পাঠদানের ফাঁকে ফাঁকে আমাদের মন ও মগজকে চাঙ্গা করার জন্য মজার মজার কথা ও গল্প শোনাতেন।
একদিন পাঠদানের সময় তিনি বললেন : ‘ওহে ছোট্ট মৌলভীরা! মনোযোগ দিয়ে শোন, আমাদের পিয়ারা নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : অতিসত্বর মানুষের মাঝে এমন একটা জমানা আসবে, (১) যখন শুধুমাত্র ইসলামের নামটা অবশিষ্ট থাকবে। ইসলামী জীবনব্যবস্থা বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না (২) আর কুরআনুল কারীমের লিখিত রূপটি যত্রতত্র পাওয়া যাবে, কিন্তু আল কুরআন পাঠকারীও কুরআনের হুকুম আহকাম, কর্মকর থাকবে না। (৩) পৃথিবীর সর্বত্র মসজিদগুলো বড় বড় সুরম্য অট্টালিকার মতো নির্মিত হবে, কিন্তু সেখান হতে হেদায়েতের নূর বিচ্ছুরিত হবে না। এগুলো বিরাম বাড়ির মতো মনে হবে। (৪) আর সে জমানার ওলামা অর্থাৎ বুদ্ধিমান শ্রেণীর লোকেরা হবে নষ্ট চরিত্রের অধিকারী। তাদের দ্বারা বিশ্বজোড়া ফিতনা ফাসাদ ও অশান্তির জোয়ার বইতে থাকবে। পৃথিবীতে শান্তির লেশমাত্র অবশিষ্ট থাকবে না। (৫) আর সে সময় পৃথিবীর জীবিত লোকেরা মৃতদের কথা স্মরণ করে আক্ষেপ করে বলবে, হায়! কি ভালো হতো, আমরাও যদি তাদের দলভুক্ত হতাম।
এ পর্যন্ত বলে পাঞ্জম হুজুর আমাদের প্রতি লক্ষ করে বললেন : ‘বল তো, উল্লেখিত হাদিসে কয়টি অবস্থার কথা বলা হয়েছে?’ ক্লাসের সবাই নীরব। কেউ কিছু উত্তর দিচ্ছে না। আমি আমতা আমতা করে আরজ করলাম, হুজুর! আপনার মুখনিঃসৃত বাণীগুলো খুব মন দিয়ে শুনেছি। কিন্তু এর বিষয়- আশয়গুলো গনাবাছা তো করিনি?
আমার কথা শুনে হুজুর মৃদু হাসলেন। এমনিতেই তিনি হাসিমুখ ছিলেন। তিনি পান খেতেন। পানের আরত্তিম রঙ দুই ঠোঁটে লেগেই থাকত। তাই যখন তিনি হাসতেন, তখন রক্ত রাগ লালিমার আভা সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠত। তিনি পুনরায় বললেন, ‘শোন বাছারা! উপরোক্ত হাদিসে পাঁচটি অবস্থার কথা সাইয়্যেদুল মুরসালীন, রাহমাতুল্লিল আলামীন (সা.) বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করেছেন, বুঝেছ? পাঁচ সংখ্যাটি মুমিন মুসলমানদের প্রাণশক্তি। কেননা আরবী ইসলাম শব্দে পাঁচটি বর্ণ আছে। ইসলামে প্রবেশ করতে হলে সাতটি বিষয়ের ওপর ঈমান আনয়ন করতে হয়। আরবী ঈমান শব্দেও পাঁচটি বর্ণ আছে। ঈমান আনয়নের পর ইবাদত-বন্দেগী করতে হবে ইহসানের সাথে। আরবী ইহসান শব্দেও পাঁচটি বর্ণ রয়েছে।
ইসলামের বুনিয়াদ পাঁচটি বস্তুর ওপর প্রতিষ্ঠিত। নামাজ পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ। কালেমাও পাঁচটি। বিশ্বনবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নাবুওয়াতকাল ২৩ বছর। এর এককও (২+৩) ৫। আমাদের প্রিয় নবী মোহাম্মাদুর রাসূলূল্লাহ (সা.)-এর জাগতিক সত্তাবাচক নাম মোহাম্মাদ। আরবী মোহাম্মাদ শব্দেও পাঁচটি বর্ণ রয়েছে। মানবদেহে পাঁচটি ইন্দ্রিয় রয়েছে, যদ্বারা সে জ্ঞান লাভ করে ও সে মোতাবেক কর্ম সম্পাদন করে। মানব জীবনও পাঁচটি স্তরে বিভক্ত। (ক) রূহানী জীবন, (খ) দুনিয়ার জীবন, (গ) কবর বা বরযখের জীবন, (ঘ) হাশরকালের জীবন এবং (চ) জান্নাত অথবা জাহান্নামের জীবন।
তারপর হুজুর বললেন : ‘ইসলামে পাঁচ সংখ্যার মর্মকথা যেহেতু শুরু করেছি, সেহেতু তার সমাপ্তিও আমাকেই টানতে হবে। সুতরাং আজ আর নয়। আজকে তোমাদের ছুটি।’ হুজুর চলে গেলেন। আমরাও ছুটির আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে নিজ নিজ লজিং বাড়ির দিকে রওনা হলাম। কিন্তু আমার মনের কন্দরে তীব্রভাবে একটি কথাই ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল যে, পাঞ্জম হুজুর এত কিছু জানেন। আমরা সেসব কবে জানব? এই ভাবনা-চিন্তার ভেতর দিয়ে কখন যেছায়েদ আলী ডাক্তার বাড়ির পাশে পৌঁছে গেছি তা টের করতেও পারিনি। এমন সময় ডাক্তার বাড়ির দিক হতে মধুর কণ্ঠের সুর ভেসে এলো, ‘সাধের পার ঘাটাতে তুমি পারের নাইয়া, দ্বীন বন্ধুরে, আমার দিন কি এমনে যাবে বইয়া।’
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।