হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
কামরুল হাসান দর্পণ
জনগণ তুমি কার? পুরনো এ প্রশ্নটি নতুন করে যদি তোলা হয়, তবে এর উত্তর সহজে মিলবে না। জনগণ যে কার আর জনগণের যে কে, তা এখন বোঝা মুশকিল হয়ে পড়েছে। জনগণ কার সঙ্গে বা কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আছে, তার একটা ধারণা আগে প্রতি পাঁচ বছর পরপর জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে পাওয়া যেত। সরকার যারা গঠন করত স্বাভাবিকভাবে তারা দেশের সব মানুষকেই তার বলে ভাবার সুযোগ পেত। প্রায় সাত বছর ধরে জনগণ কার তা বোঝার উপায় নেই। এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, সরকার থেকে শুরু করে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যে যার মতো করে জনগণকে নিজেদের বলে দাবি করে যাচ্ছে। সরকার তো বিলকুল নিশ্চিত, জনগণ কেবল তার সঙ্গেই আছে, আর কারো সঙ্গে নেই। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোরও একই দাবি। অন্যদিকে জনগণের এই সময় নেই যে মাথা তুলে আওয়াজ দিয়ে জিজ্ঞেস করবে, ‘আমি কার খালু রে?’ যে নিজেই দৌড়ের ওপর থাকে, তার অন্য কারো খোঁজ নেয়ার সময় থাকে না। আপন প্রাণ বাঁচিয়ে কোনো রকমে জানটুকু নিয়ে দিন গুজরান করতে পারলেই যেন বাঁচে। সে কার সঙ্গে আছে আর কে তার সঙ্গে আছে, এ নিয়ে ভাবার ফুরসত নেই। রাজনীতি নিয়ে যে খোশগল্প করবে বা চায়ের কাপে ঝড় তুলবে, এটা তার কাছে এখন দূর অতীত। রাজনীতি ও রাজনীতির ধারক-বাহকরা তাদের এমনই ‘ডলা’র মধ্যে রেখেছে যে, এ নিয়ে আলাপ করার আগ্রহ এখন তাদের নেই। অথচ ইতিহাস বলে, আমাদের দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি রাজনীতিপ্রিয়। তারা রাজনীতি সচেতন এবং এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে পছন্দ করে। নিজ নিজ দলের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার চর্চা করে। তর্ক-বিতর্ক যাই হোক, এর মাধ্যমে এক দলের কর্মকা- সম্পর্কে আরেক দলের সমর্থকরা জানতে ও বুঝতে পারে। তাদের এই কথা বলার কারণেই আমাদের দেশে একটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সুদীর্ঘকাল ধরেই নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে থমকে গেলেও তাদের কথা বলা ও প্রতিবাদের মধ্য দিয়েই তা পুনরুদ্ধার হয়েছে। এই যুগে, বিশেষ করে বিগত কয়েক বছর ‘রাজনীতি’র প্রতি জনগণের মধ্যে খুব একটা আগ্রহ দেখা যায় না। রাজনৈতিক দল ও তাদের অনুগত কিছু বুদ্ধিজীবী টাইপের লোকজনের মধ্যে পারস্পরিক দোষারোপের রাজনীতি থাকলেও সাধারণ মানুষ এ নিয়ে এখন আর তেমন মাথা ঘামায় না। এর কারণ সাধারণ মানুষ এখন এমনই পেরেশানির মধ্যে আছে যে, ‘জান বাঁচানো ফরজ’ বলেই মনে করছে, অন্য কোনো দিকে তাকানোর সুযোগ নেই। সাধারণত আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ রাজনীতি নিয়ে তখনই আলাপ-আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয়, যখন তাদের জীবনযাপনে টানাপড়েন কম এবং সহনীয় পর্যায়ে থাকে। সকালে কোনো রকমে খেলে রাতে কী খাব, এ চিন্তা করতে হয় না। বর্তমানে তাদের এই চিন্তায় বিরাট পরিবর্তন হয়ে গেছে। যখন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়, তখন রাজনীতির আলাপ করার মতো মানসিক অবস্থা কারো থাকে না। এখন বেশির ভাগ মানুষেরই সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে। বাজারে গেলে মাথা গরম হয়ে যায়। জিনিসপত্রের দাম কেবল বাড়ছেই। তার ওপর সরকার গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির দাম দ্বিগুণ-তিনগুণ হারে বাড়িয়ে দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ এই ভার সইতে পারবে কিনা, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবছে না। সরকারের দাম বাড়ানোর কাজ, বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটা যে জনবান্ধব কোনো সরকারের কাজ নয়, তা বুঝতে চাইছে না। আবার এ নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোরও কোনো উচ্চবাচ্য নেই। তারা জনগণের হয়ে জোরালো কোনো প্রতিবাদও করছে না।
দুই.
সাধারণ মানুষকে রাজনীতিবিমুখ করে তোলার ফলাফল কি ভালো হয়? এ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক হতে পারে। যারা রাজনীতিবিমুখ করে তুলতে চায়, তারা নিশ্চিতভাবেই বলবে, সাধারণ মানুষের রাজনীতি নিয়ে ভাবার দরকার কি! এ জন্য তো আমরা আছি। এ ধরনের কথাবার্তা স্বৈরাচারী মনোভাবের পরিচায়ক। তারা ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য সাধারণ মানুষকে জোর করে চুপ করিয়ে রাখে। চুপ করিয়ে রাখা জায়েজ করার জন্য উন্নয়নের ধুয়া তোলে। তারা মনে করে, জনগণের সামনে যদি উন্নয়নের কিছু সাইনবোর্ড তুলে ধরা যায়, তবে তারা বেজায় খুশি হবে। এ উন্নয়ন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষকেই চেপে ধরতে হবে। বিভিন্ন ছুঁতোয় তাদের পকেট থেকে অতিরিক্ত অর্থ বের করে তা দিয়েই উন্নয়ন করতে হবে। বলা হবে, আমরা নিজেরাই নিজেদের অর্থ দিয়ে উন্নয়ন করতে সক্ষম। কারো কাছে হাত পাততে হয় না। জনগণ যে উন্নয়নের চাপে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে, সেদিকটি উপেক্ষা করেই বলে, আমরা উন্নয়ন করছি। গোল হোক বা না হোক রেফারির বাঁশি বাজানোর আগেই গোয়ারের মতো ‘আমরা জিতেছি, আমরা জিতেছি’ বলে লাফাতে থাকে। উন্নয়নের এই উল্লম্ফন জনগণের চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। এসব উন্নয়ন করতে গিয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষকে যে প্রান্তিক পর্যায়ে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, তা মোটেও বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। সাধারণ মানুষ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অবলোকন করছে, কষ্ট করে যে পয়সা উপার্জন করেছিল, এ জীবনে তা পুনরায় উপার্জন করা হবে না। তাদের যেভাবে একধাপ পিছিয়ে দেয়া হয়েছে, সামনে যেতে হলে তাদের আরও দুই ধাপ এগোতে হবে। এটি যে কত কঠিন, তা কেবল তারাই জানে। উল্লিখিত প্রশ্নের আরেকটি উত্তর দিতে গিয়ে মুক্তমনা শ্রেণি বলবে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বা ভিত্তি শক্ত করতে সাধারণ মানুষের রাজনীতি নিয়ে ভাবার খুবই প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তা না হলে দেশ ও জনগণ ভালো থাকতে পারবে না। সত্যিকার অর্থে, তাদের এ কথাই সঠিক। আফসোসের বিষয়, তাদের এসব কথা যতই সঠিক হোক এখন আর তার কোনো দাম নেই। সাধারণ মানুষেরও কোনো কাজে আসছে না। শাসক শ্রেণি জনগণকে এমনই উন্নয়নের ঘোরের মধ্যে ফেলে দিয়েছে যে, এসব সঠিক কথা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো সুযোগ নেই। জীবনের তাগিদে তাদের কেবল দৌড়াতে হচ্ছে। সাধারণ মানুষের এই অস্থিরতার মধ্যেই গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এক চুলা ১১০০ টাকা, দুই চুলা ১২০০ টাকা। এ কথা শুনে মানুষের পেরেশানি আরও বেড়ে গেছে। তারা বুঝতে পারছে, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আরও নানাবিধ প্রতিক্রিয়া তাদের ওপর দিয়ে বয়ে যাবে। জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, বাসা ভাড়া বাড়বে, যানবাহনের ভাড়া বাড়বেÑ আরও কত কি! সুযোগসন্ধানী বেনিয়ারা তো বসেই থাকে কোনো একটি ছুঁতোর অপেক্ষায়। যেসব পণ্যের সাথে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির সম্পর্ক নেই, সেসব পণ্যের সাথেও টেনেটুনে এসবের দাম বৃদ্ধির কারণ জুড়ে দেয়। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির অজুহাতটিও যে জুড়ে দেয়া হবে, তাতে সন্দেহ নেই। মানুষ যখন দুঃশ্চিন্তায় অস্থির, তখন অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘ভাত-ডাল রান্নার কাজে গ্যাসের ব্যবহার পুরোপুরি অপচয়। গ্যাস অতি মূল্যবান, এটা দিয়ে ভাত-তরকারি রান্নার কোনো মানে হয় না।’ তার এ কথা ‘কাটা গায়ে নুনের ছিটা’র চেয়ে অধিক যন্ত্রণাদায়ক হলেও কিছু করার নেই। এ অবস্থায় যাত্রাপালার ‘বিবেক’ চরিত্রটি জেগে উঠে বলতে পারে, ‘জনগণ এবার ঠেলা সামলাও। কে দেবে তোমাদের আশা, কে দেবে ভরসা।’ বলাবাহুল্য, যে অপকর্ম করে সেও নানা যুক্তি দিয়ে অপকর্ম জায়েজ করার চেষ্টা করে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নিয়েও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এন্তার যুক্তি উপস্থাপন করে চলেছে। সর্বশেষ অর্থমন্ত্রী যে কথা বলেছেন, তারপর তো আর কোনো কথাই থাকে না। কাজেই সাধারণ মানুষকে রান্নাবান্নার কাজে এখন কাঠখড়ের যুগে ফিরে যাওয়া ছাড়া গতি নেই। কারণ তাদের বিপুল সংখ্যকের পক্ষে ২২০০-২৩০০ টাকা দিয়ে সিলিন্ডার বা বোতলভর্তি গ্যাস কিনে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। ব্যবহার করলেও এক সিলিন্ডার দিয়ে মাস যাবে না। না গেলে অবধারিতভাবেই এই খরচ তিন-চার হাজার টাকায় গিয়ে পৌঁছবে। সাধারণ মানুষের এই কষ্টের কথা চিন্তা করার যেন কেউ নেই। যে স্বল্পসংখ্যক সচেতন মানুষ এই দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ করেছেন, সরকারের কাছে তাদের কথার দুই পয়সাও দাম নেই। তারা বলেছেন, সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবসায়ীদের কারসাজির কাছে সরকার নত হয়ে পড়েছে। তাদের ব্যবসার সুবিধা দিতেই এ কাজ করেছে। তাদের এ কথা যতই গ্রহণযোগ্য হোক না কেন, সরকার তো তার তোয়াক্কা করছে না। করবেও না। তবে এই তোয়াক্কা না করার ফলাফল যে সব সময় ভালো হয় না, বোধকরি সরকার তা বুঝতে পারছে না। প্রকৃতির নিয়মে অ্যাকশনের রিঅ্যাকশন থাকে। এখন গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হলে, এর রিঅ্যাকশনও দেখা দেবে। অনেকেই বিদ্যুতের হিটারের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। এর ফলে যা হবে তা হচ্ছে, সরকার যে বিদ্যুৎ খাত নিয়ে গর্ব করছে, তাতে টান ধরবে। ঘাটতি দেখা দেবে। সরকার আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ঘরে ঘরে শতভাগ বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার যে পরিকল্পনা করছে, তা ব্যাহত হবে। যদি গ্যাসের পরিবর্তে সাধারণ মানুষ বিদ্যুৎ দিয়ে রান্নাবান্নার কাজ শুরু করে, তবে সরকার কি তা ঠেকাতে পারবে? ঠেকাতে হলে বিদ্যুতের দামও বৃদ্ধি করতে হবে। এভাবে দাম বাড়াবাড়ি করে জনসাধারণের অসন্তোষ চরমে নিয়ে যাওয়া সরকারের জন্য কী ভালো হবে?
তিন.
জীবনে যখন অভাব-অনটন লেগে থাকে এবং ক্রমাগত বাড়তে থাকে, তখন কারো পক্ষে মেজাজ ঠিক রাখা সম্ভব নয়। এই মেজাজ খারাপের কারণ যদি সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে হয়, তখন তা সহাও যায় না বলাও যায় না। মানুষের এই অব্যক্ত বেদনা একসময় ক্ষোভে পরিণত হয়। বহু মানুষের ভেতর যদি ক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে, তবে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সমাজে দেখা দিতে বাধ্য। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, সন্ত্রাসসহ পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ কমে সমাজ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। যাদের ক্ষমতা আছে, তারা অন্যেরটা কেড়ে নিয়ে নিজের অভাব পূরণ করে। এর অসহায় শিকার হয় সাধারণ মানুষ। আবার প্রভাবশালীদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই শুরু হলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়। যারা সাধারণ মানুষ তাদের যখন ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ তখন সংসারে চরম অশান্তি দেখা দেয়। অশান্তি থেকে অনেকে আত্মহননের মতো পথও বেছে নেয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সমাজে বেশির ভাগ আত্মহননের মূল কারণ পারিবারিক অশান্তি। এই অশান্তির পেছনের কারণ অর্থনৈতিক টানাপড়েন। তার পেছনের কারণ সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত। এর মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অন্যতম। এর ওপর বছর যেতে না যেতেই বাসাভাড়া, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির মূল্যবৃদ্ধি তাদের কাছে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দেয়। এক হিসাবে দেখা গেছে, নগরে যারা ভাড়া বাসায় থাকে, তাদের আয়ের সত্তর ভাগই খরচ হয়ে যায় বাসা ভাড়া দিতে গিয়ে। এভাবে যদি সবকিছুর দাম বাড়তে থাকে, তবে একজন নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের মাথা ঠিক থাকার কথা নয়। ১০০ টাকার মধ্যে ৩০ টাকায় খাওয়া-দাওয়া, সন্তানের পড়ালেখা, আত্মীয়তা ও সামাজিকতা রক্ষা করা কি সম্ভব? বিশেষ করে যার আয় সীমিত এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে, তার পক্ষে সংসার চালানো কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে ওঠে। অধিকাংশ মানুষের এই সমস্যার কথা সরকার চিন্তা করে বলে মনে হয় না। যদি চিন্তা করত, তবে দফায় দফায় প্রয়োজনীয় উপকরণের দাম বৃদ্ধির চিন্তা করত না। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির দাম বৃদ্ধিসহ প্রায় সর্বক্ষেত্রে ভ্যাট-ট্যাক্স আদায়ের মাধ্যমে এটাই প্রতীয়মান হয়, সরকার যেন সাধারণ মানুষের সেবার পরিবর্তে ব্যবসা করছে। অনেকটা সামন্তবাদীদের মতো, যারা জোর করে প্রজাদের কাছ থেকে অর্থকড়ি আদায় করত। প্রজাদের কষ্টের ওপর দাঁড়িয়ে তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করত। সরকার কেবল মনে করছে, তার প্রশাসনে যারা চাকরি করছে, তারা ভালো থাকলেই আর কারো ভালো থাকার প্রয়োজন নেই। কাজেই তাদের বেতন বৃদ্ধিসহ যত ধরনের সুযোগ-সুবিধা আছে তা বাড়ালেই জনসাধারণের কাজ হয়ে যাবে। তাদের আয় বৃদ্ধি মানে জনসাধারণের আয় বৃদ্ধি হওয়া। কোনো সরকার যদি এরকম একদিকদর্শী হয়, তবে সে দেশের সাধারণ মানুষের ভালো থাকার কোনো কারণ থাকতে পারে না। সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের টানাপড়েনের মধ্যে আবার নতুন নতুন উপসর্গ দেখা দিয়েছে। জঙ্গি হামলা এবং এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান মানুষকে নিরাপত্তা শঙ্কায় নিক্ষিপ্ত করেছে। পেটে কোনো রকমে সহালেও পিঠ যেন আর বাঁচছে নাÑ এমন এক পরিস্থিতিতে পড়েছে তারা। বিপদের ওপর বিপদ। এই বিপদ সমাজ থেকে শুরু করে পুরো অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তীব্র করে তুলেছে। সরকার যতই বলুক ‘সবকিছু ঠিক আছে’, সাধারণ মানুষ দেখছে, অনুভব করছে, কোনো কিছুই ঠিক চলছে না। তারা দেখছে, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। অর্থনীতির মূল যে উপাদান ‘বিনিয়োগ’ তা করুণ অবস্থায় রয়েছে। এই গত সপ্তাহেই একটি দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে, ব্যাংকে এক লাখ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য যদি স্থবির না হতো, তবে কি অর্থের এই অলস পাহাড় ব্যাংকগুলোতে পড়ে থাকত? যে অর্থ খাটে না, সে অর্থ বাড়ে নাÑ অর্থনীতির এটাই নিয়ম। ব্যাংকের মূল কাজই হচ্ছে, আমানতকারীর অর্থ জমা রাখা এবং সে অর্থ ঋণ দিয়ে ব্যবসা করা। ব্যাংকগুলোর যদি এই সুযোগ কমে যায়, তবে অর্থনীতি ভালো বা ভালো হচ্ছে, সাধারণ মানুষ ভালো আছেÑ এ কথা কি বিশ্বাসযোগ্য হবে?
চার.
সাধারণ মানুষের জীবনযাপন কঠিন করে তোলা সুশাসনের পরিচায়ক হতে পারে না। সুশাসকের কাজ হচ্ছে মানুষের আরাম-আয়েশ ঠিক রেখে দেশ পরিচালনা করা। কোনো সুশাসকের আমলে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি করার কথা কল্পনাও করা যায় না। দাম বৃদ্ধি হতেই পারে, তবে তা যদি আয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে করা হয়, তাতে কারো আপত্তি থাকে না। পৃথিবীর সব দেশেই এ হিসাব করে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি করা হয়। আমরা শায়েস্তা খাঁর আমলের কথা স্মরণ করি এ কারণে যে, তিনি প্রজাদের অতি অল্প দামে জিনিসপত্র ভোগ করার ব্যবস্থা করেছিলেন। জনগণের আয়ের সাথে ব্যয়ের সমন্বয় করেছিলেন। এখন আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে অহরহ বলা হচ্ছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, ক্রয়ক্ষমতাও নাকি বেড়েছে। এ ক্ষমতা কত বেড়েছে, এ হিসাবটি আর দেয়া হয় না। এটা তো স্বাভাবিক কথা, বাঁচতে হলে মানুষকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতেই হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা প্রয়োজনের তুলনায় কতটা কিনছে? এক কেজির পরিবর্তে আধা কেজি কিনে কোনো রকমে প্রয়োজন মেটাচ্ছে কিনা? গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পর তাদের যে বাড়তি অর্থ গুনতে হবে, এ অর্থ তারা জোগাড় করবে কী করে, এ বিষয়টি কি সরকার ভাবছে? যদি এমন হয়, আমার বাড়িয়ে দেয়ার দরকার বাড়িয়ে দিলাম, সাধারণ মানুষ তা কীভাবে দেবে এটা আমার দেখার বিষয় নয়, তাহলে বলার কিছু নেই। বলার আছে এটুকুই, এ ধরনের মনোভাব কোনো দায়িত্বশীল ও জনবান্ধব সরকারের হতে পারে না। সাধারণ মানুষকে চাপে ফেলে দাবিয়ে রাখার ফল শুভ হয় না।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।