Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আজারবাইজানের সাথে যুদ্ধ, আর্মেনিয়ার হিসাবে কি ভুল ছিল?

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৫ নভেম্বর, ২০২০, ৬:২৫ পিএম

আর্মেনিয়ার ভুল সিদ্ধান্তের ফলে সৃষ্ট দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিগুলো সহজেই দেখা যাচ্ছে। ক্ষতির একটি অংশ বস্তুগত হলেও তার থেকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ ক্ষতি হয়েছে মানসিকভাবে। আর্মেনিয়ার সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতিটি এখন ভেঙে গেছে এবং তারা নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় দেখতে পাচ্ছে।

প্রথমত, আজারবাইজানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আর্মেনিয়া একটি বাজি ধরেছিল। তবে বাকু যে এতদূর অগ্রসর হবে সেটি তাদের ধারণার বাইরে ছিল। তাদের ধারণা ছিল, মস্কো পদক্ষেপ নেবে এবং আর্মেনিয়াকে উদ্ধার করবে। তবে সেই সম্ভাবনাও খুব কমই ছিল। পাশিনিয়ান যেভাবে আর্মেনিয়ায় ক্ষমতায় আসেন, তাতে পুতিন বিরক্ত ছিলেন। তিনি পাশিনিয়ানকে এভাবে অপমানিত হতে দিয়েছেন সম্ভবত এই প্রত্যাশায় যে, ইয়েরেভানে আগের শক্তি ক্ষমতায় ফিরে আসবে। এটি উল্লেখযোগ্য যে, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ গত আগস্টে তার সরকারের অভ্যন্তরে অবশিষ্ট রাশিয়ানপন্থীদেরকে সরানোর পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং আর্মেনিয়ায় রাশিয়ার সামরিক সরবরাহের বিষয়ে পুতিনের কাছে প্রকাশ্যে অভিযোগ করেছিলেন। ককেশাসের সর্বাধিক কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশের উপর কিছুটা প্রভাব ফেলতে আজারীদের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখার প্রয়োজনকে প্রতিফলিত করে পুতিনের সতর্ক পদক্ষেপ।

দ্বিতীয়ত, আর্মেনিয়ান নেতারা মূলত এটি দেখতে ব্যর্থ হয়েছিলেন যে, রাশিয়া যতই তর্জন গর্জন করুক, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়া পরে বিশ্বব্যাপী পাশাপাশি আঞ্চলিকভাবেও তাদের শক্তি অনেক হ্রাস পেয়েছে। তবে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারত, যদি এই যুদ্ধে সিদ্ধান্তমূলকভাবে হস্তক্ষেপ করলে রাশিয়ার কোন লাভ হতো। এমনকি শেষ অবধি তারা সংঘাত নিরসনে শান্তিরক্ষী মোতায়েন করলেও এতে তাদের তেমন কোন লাভ হবে না। সব মিলিয়ে, আর্মেনিয়া তার উপদেষ্টারা যতটা বলেছেন, তার থেকেও অনেক বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।

তৃতীয়ত, আর্মেনিয়ান নেতারা দক্ষিণ ককেশাস এবং মধ্য প্রাচ্যের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সংযোগ এবং বিশেষত এই অঞ্চলে তুরস্কের ভূমিকা সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ২০১৫ সাল থেকে তুরস্কে একটি শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী শক্তির উত্থান হয়েছে। তুর্কি পররাষ্ট্রনীতির আওতা ক্রমবর্ধমান হারে নির্ধারণ করেছেন। প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেপ এরদোগান- যিনি যতটা না জাতীয়তাবাদী, তার থেকে বেশি ইসলামপন্থী। তিনি দেশকে আরও বেশি জাতীয়তাবাদের পথে ঠেলে দিয়েছেন, যার ফলে আঙ্কারা সিরিয়া এবং লিবিয়া উভয় ক্ষেত্রেই মস্কোকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এসেছে। তুর্কি ড্রোনগুলো অন্তত লিবিয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়ার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যেভাবে শক্তিশালী প্রমাণিত হয়েছে, তাতে আর্মেনিয়ার আরও সাবধান হওয়া এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত ছিল। কারাবাখ আজারবাইজানের জন্য যেমন, তুরস্কের জন্যও তেমন তাৎপর্যপূর্ণ, ফেব্রুয়ারী এরদোগানের দেয়া এই বক্তব্যের মতো স্পষ্ট সতর্কতা সত্ত্বেও, আর্মেনিয়ান নেতারা এই দ্বন্দ্বের বিষয়ে তুরস্কের অবস্থানের পরিবর্তনকে পুরোপুরি অনুমান করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, এই গ্রীষ্মে সেভ্রেস চুক্তি সাক্ষরের মতো পদক্ষেপের মাধ্যমে তারা তুরস্কের অবস্থানের এই পরিবর্তনকে আরও ত্বরান্বিত করেছেন।

সবশেষে, আর্মেনিয়ান নেতারা আজারবাইজানের সাম্প্রতিক অভ্যন্তরীণ রূপান্তরকে বুঝতে ব্যর্থ হন। বহু বছর ধরে, ইলহাম আলিয়েভ তার চারপাশে বিভিন্ন ব্যবসায়ী নেতার দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। তবে বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে, আজারবাইজানের এই নেতা দেশকে আরও দক্ষ করে তোলার জন্য সুদূরপ্রসারী শুদ্ধি প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। আলিয়েভ সতের বছর আগে তার পিতার কাছ থেকে যে অবস্থায় শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন, সেখান থেকে তিনি নিজেকে মুক্ত করেছেন। আর্মেনিয়ান নেতারা বুঝতে পারেন নি যে, ভবিষ্যত নিয়ে আলিয়েভের দৃষ্টিভঙ্গি আজারবাইজানের সবচেয়ে বড় সমস্যা, তাদের দখল হয়ে থাকা জায়গা এবং সেটি নিয়ে অমীমাংসিত দ্বন্দ্বকে প্রভাবিত করবে। যদিও এই পরিস্থিতি নিয়ে আলিয়েভ আগেও অনেকবার তার হতাশা প্রকাশ করেছেন।

তাহলে আর্মেনিয়ান নেতারা কেন এই গুরুতর ভুল গণনা করেছিলেন? বেশ কয়েকটি কারণ মাথায় আসে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বিশ্ব দ্রুত পরিবর্তিত হয়েছে, বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে পরিবর্তনের প্রভাব নির্ণয় করার জন্য যথেষ্ট সুক্ষ এবং বিশ্লেষণী দক্ষতার প্রয়োজন। আর্মেনিয়ান নেতারা তার পরিবর্তে নিজেদের উপরে বেশি আন্তঃবিশ্বাসী ছিলেন এবং তাদের নিজস্ব প্রচারকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তবুও, এটি তাদের ব্যর্থতার মাত্রা সম্মন্ধে ধারণা দেয় না, যা কেবল আর্মেনিয়ান ঘরোয়া রাজনীতির গভীর বিশ্লেষণ দ্বারা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।

এটা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে যে প্রধানমন্ত্রী নিকোল পশিনিয়ান - ২০১৮ সালে রাজপথে বিক্ষোভের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার আগে যার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় ঘাটতি ছিল - তিনি তার দেশ ও অঞ্চলের ভূরাজনীতি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে আর্মেনিয়ার পূর্ববর্তী নেতৃত্বের দ্বারাও তিনি ক্রমাগত চাপের মধ্যে ছিলেন, যার ফলস্বরূপ কারাবাখের নেতৃত্বের সাথে জোটবদ্ধ থাকা এবং মস্কোর সাথে সুবিধাজনক সম্পর্ক বজায় রাখা তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটি একটি অত্যন্ত অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, যার মধ্যে পশিনিয়ান তার শক্তি আরও সুদৃঢ় করার জন্য ক্রমবর্ধমান কট্টর জাতীয়তাবাদী অবস্থান গ্রহণ করে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, তার একীভূতকরণের আহ্বান সম্ভবত কারাবাখের নেতৃত্বকে লক্ষ্য করে হয়েছিল এবং সেখানে আর্মেনিয়ানদের মধ্যেও জনপ্রিয়তা বাড়ানো তার লক্ষ্যে ছিল। তবে বাকুতে তার কথায় যে প্রভাব পড়বে, সে বিষয়ে চূড়ান্তভাবে মূল্যায়ন করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন।

এটি এখন পরিষ্কার যে, আর্মেনিয়া কেবল স্থায়ীভাবে শান্তি বজায় রাখলেই নিরাপদ থাকতে পারবে। পশিনিয়ান ইতিমধ্যে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তার ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়েছে এবং তার পদত্যাগের আহ্বান আরও বাড়ছে। আরও গভীরভাবে, পশিনিয়ান থাকুক বা না থাকুক, আর্মেনিয়া এই বিভ্রান্তি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে কিনা এবং শান্তির জন্য গুরুতর কোন পদক্ষেপ নেবে কিনা তা এখনও দেখার বিষয়। সূত্র: ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ