পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
ভাসানচর। সাধারণ কোন দ্বীপ নয়। এ যেন সাগরের বুকে এক টুকরো শহর। মাত্র ত্রিশ বছর আগেও যে দ্বীপের ওপর দিয়ে জাহাজসহ বিভিন্ন ধরনের জলযান চলাচল করেছে, সেই দ্বীপ এখন বাসযোগ্য। শুধু কোনরকমে বসবাস নয়- সুউচ্চ বেড়িবাঁধে সুরক্ষিত দ্বীপটিতে জাহাজ ভেড়াবার জেটি, সুুবিন্যন্ত সড়ক, সারিসারি ঘর, নান্দনিক নকশার দালান, পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার, চাষাবাদের উপযোগী ভূমি আর রাতে আলোর ঝলকানি-কি নেই সেখানে। এ যেন পরিকল্পিত এক জনপদ। ভাসানচর নাম শুনলে ধু ধু বালুচরের যে ছবি মনে ভাসে, তার সঙ্গে এর মিল নেই। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে এই চরটি।
নোয়াখালীর হাতিয়া থানাধীন চর ঈশ্বর ইউনিয়নের অধীন প্রায় ১৩ হাজার একর আয়তনের এই দ্বীপ এখন মানুষের বসবাসের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে সাময়িকভাবে স্থানান্তরের জন্য এই ভাসানচরকে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। এক লাখ রোহিঙ্গার থাকা আর রান্নার ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, পানি আর পয়ঃনিষ্কাশন, খেলার মাঠ আর ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের সঙ্গে জীবিকা নির্বাহের সুযোগও সেখানে তৈরি করা হয়েছে।
ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিচালক কমডোর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ১২০টি ক্লাস্টার গ্রাম নিয়ে তৈরি ভাসান চর এক লাখ মানুষের আবাসনের জন্য প্রস্তুুত। রোহিঙ্গার সাময়িক আশ্রয়ের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা ভাসানচরে করা হয়েছে। ঢেউ ও জোয়ারের ধাক্কা থেকে তীর রক্ষার জন্য শোর প্রটেকশন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একটু ভালোভাবে থাকার জন্য যে সুযোগ সুবিধাগুলো এখানে রাখা হয়েছে, সেগুলো কক্সবাজারের ক্যাম্পে নেই। আমরা অপেক্ষায় আছি, রোহিঙ্গারা এখানে আসবে এবং থাকবে।
গতকাল সরেজমিনে ভাসারচর ঘুরে মনে হয়েছে, সাগরের মাঝখানে এক টুকরো সবুজ দ্বীপ, তারই মাঝে লাল রঙের ছাউনি দেওয়া চতুর্ভুজ আকৃতির সারি সারি টানা ঘর আর সাদা রংয়ের বহুতল ভবন মিলিয়ে পরিকল্পিত এক জনপদ। নৌকায় চট্টগ্রামের মূল ভূখন্ড থেকে ভাসানচর যেতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা। আর নোয়াখালী থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপটিতে বিদ্যুৎ ও সোলার প্যানেল, বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট এবং মোবাইল ফোনের টাওয়ারসহ ভবনগুলো যে কাউকে অবাক করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। বাড়িগুলো মাটির চার ফুট উপরে কংক্রিটের ব্লক দিয়ে তৈরি। পুরো আবাসন সাইটটির নিরাপত্তায় রয়েছে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বন্যা সুরক্ষা বাঁধ। এখানে প্রতিটি কক্ষে চার জনের একটি পরিবার থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রকল্প কর্মকর্তা বলছেন, প্রতিটি ভবনের ১৬টি কক্ষে ১৬টি পরিবার থাকতে পারবে।
জাতিসংঘের আদর্শ হিসাব অনুযায়ী মাথাপিছু ৩৭ বর্গফুট জায়গার কথা থাকলেও এখানে তারচেয়ে বেশি জায়গা রয়েছে। প্রকল্পে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য দুটি খেলার মাঠও প্রস্তুুত। প্রতিটি ক্লাস্টার হাউসেও খেলার জন্য অতিরিক্ত জায়গা রয়েছে। সেখানে নামাজ, দাফন এবং বাজারের জন্যও জায়গা রাখা হয়েছে। এখানে নির্মিত ভবনের কক্ষগুলোতে স্টিলের বিছানা এবং সিলিং ফ্যান রয়েছে। প্রতিটি ক্লাস্টারে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য জলাধার রয়েছে, যা বিকল্প পানির উৎস হিসেব ব্যবহার করা যাবে। জনপদের প্রতি ১২০টি প্লটের জন্য আলাদা ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। যা এক হাজার মানুষ এবং ২০০ গবাদি পশুর জন্য তৈরি। প্রকল্প কর্মকর্তারা বলেছেন, সৌর-চালিত স্ট্রিট লাইট ও সার্বক্ষণিক সিসিটিভির মাধ্যমে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা ভাসানচরের এই আবাসন প্রকল্প এক লাখ রোহিঙ্গাকে জায়গা দিতে প্রস্তুত এবং এতে করে উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর ওপর চাপ কমবে। এই দ্বীপে এখন ৪৩ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা।
এছাড়াও রয়েছে চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক, দুটি ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল, দুটি স্কুল ও তিনটি মসজিদ বাসিন্দাদের প্রয়োজন মেটাতে যথেষ্ট হবে বলে আশা করা হচ্ছে। খাবার ও অন্যান্য পণ্য সংরক্ষণের জন্য চারটি গুদামের পাশাপাশি বাজার রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা। এ ছাড়াও, দ্বীপে দুটি বড় হ্রদ রয়েছে। বাংলাদেশের উপক‚লীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় উপযোগী লেবু, নারকেল ও কেওড়াসহ বিভিন্ন গাছ প্রচুর পরিমাণে লাগানো হয়েছে এই দ্বীপে। এছাড়াও সরকারি কর্মকর্তা, জাতিসংঘ প্রতিনিধি, আরআরআরসি প্রতিনিধি, রেডক্রস, আন্তর্জাতিক এনজিও প্রতিনিধি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্যও আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে সেখানে।
জানা যায়, গত কয়েক দশকে মিয়ানমারে দমন-নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়ে ছিল কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ২০১৭ সালের অগাস্টে রাখাইনের গ্রামে গ্রামে ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ শুরু করলে বাংলাদেশ সীমান্তে আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। এই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে গড়ে উঠেছে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির। জাতিসংঘের নেতৃত্বে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের এই নাগরিকদের জরুরি চাহিদাগুলো পূরণ করার চেষ্টা করে আসছে।
সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, কক্সবাজারের ওই ক্যাম্পগুলোতে মোটামুটি সাড়ে ছয় হাজার একর জমিতে এখন আট লাখ ৬০ হাজারের মত রোহিঙ্গার বসবাস। প্রতি বর্গকিলোমিটারে কোনো কোনো অংশে ৩০-৪০ হাজার মানুষকেও থাকতে হচ্ছে সেখানে। এই ঘনবসতির মধ্যে তাদের যেমন মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে, তেমনি স্থানীয়ভাবে নানা সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে রোহিঙ্গাদের নিয়ে। সে কারণে তাদের একটি অংশকে অন্যত্র স্থানান্তরের পরিকল্পনা নেয় সরকার। সেজন্য বেছে নেওয়া হয় হাতিয়ার কাছে মেঘনা মোহনায় ভাসানচরকে। বর্তমানে ভাসানচরে ৩০৬ জন রোহিঙ্গা আছেন, যাদের চলতি বছরের শুরুতে বাংলাদেশের জলসীমা থেকে উদ্ধার করে ওই দ্বীপে নিয়ে রাখা হয়।
কক্সবাজারের ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের এই আশ্রয়ন প্রকল্পের সুযোগ সুবিধাগুলো দেখাতে কিছুদিন আগে ৪০ জনের একটি দলকে ওই দ্বীপ ঘুরিয়ে দেখানো হয়। ফিরে গিয়ে তারা জানান, সব কিছু দেখে তাদের ভালো লেগেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আপত্তিতে স্থানান্তরের বিষয়টি এখনও থমকে আছে।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন স¤প্রতি সাংবদিকদের বলেন, ইউএনএইচসিআর এবং এনজিওগুলোর পক্ষ থেকে সরকারের ওপর চাপ রয়েছে যেন রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পাঠানো না হয়। তবে জাতিসংঘ ও সহায়তা সংস্থাগুলোর যুক্তি, এই দ্বীপটি বিচ্ছিন্ন, বন্যার ঝুঁকিপূর্ণ এবং ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে এখানে রোহিঙ্গাদের বসবাস ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে।
ইতোমধ্যে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা একটি প্রযুক্তিগত মূল্যায়ন চেয়ে সরকারের কাছে রেফারেন্সের শর্তাদি জমা দিয়েছে এবং এখনো উত্তর পাওয়ার অপেক্ষায় আছে। সংস্থাটি আরও বলেছে, রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের বিষয়টি হতে হবে স্বেচ্ছায়। তবে ভাসানচর আবাসন প্রকল্প পরিদর্শনে যাওয়া রোহিঙ্গা নেতারা বলেছিলেন যে সেখানকার সুযোগ-সুবিধায় তারা সন্তুষ্ট এবং টেকনাফ ও উখিয়া শিবিরে তাদের বর্তমান যে জীবনযাত্রা, তার চেয়ে অনেক ভালো হবে সেখানে।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিচালক কমডোর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী বন্যার ঝুঁকিপূর্ণ এবং ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের বিষয়ে দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ভাসানচর দ্বীপকে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় বাঁধের উচ্চতা ঠিক করা হয়েছে ১৭৬ বছরের সাইক্লোন ডাটা স্টাডি করে। একই সঙ্গে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বঙ্গোপসাগরের ১০ হাজার বছরের সাইক্লোনের সিনথেটিক ডাটা। তিনি আরো বলেন, এ পর্যন্ত কোনো ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র ভাসানচর অতিক্রম করেনি। সমীক্ষা অনুযায়ী, ভাসানচরের সবচেয়ে কাছ দিয়ে একটি ঘূর্ণিঝড় অতিক্রম করেছিল ১৯৯৭ সালে। সেটিও ছিল ভাসানচর থেকে ৩৬ নটিক্যাল মাইল (প্রায় ৬৬.৭ কিলোমিটার) দূরে। তিনি বলেন, ভাসানচরের বাঁধের ৯ ফুটের কাজ হয়েছে। আরো ১৯ ফুটের কাজ চলছে।
জানা গেছে, এই ৯ ফুট বাঁধ দিয়েই সা¤প্রতিক সময়ের আম্ফান, বুলবুল ও ফণীর মতো সামুদ্রিক ঝড় খুব ভালোভাবে সামাল দেওয়া গেছে। এ তিনটি সাইক্লোনে বাঁধের বাইরের দিকে তিন থেকে চার ফুট পানি ছিল মাত্র। এমনকি ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের সময় অনেক জেলে ভাসানচরে আশ্রয় নিয়েছিল। গত বছর এবং চলতি বছরও বর্ষায় চট্টগ্রাম শহরে পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু ভাসানচরের ভেতরে কোথাও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়নি। ১৮টি সুইস গেটের মাধ্যমে ভাসানচর থেকে পানি নিষ্কাশন করা হয়েছে।
ভাসানচরে সমুদ্রের ঢেউ সরাসরি আসে এমন আড়াই কিলোমিটার এলাকাও সুরক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে বাঁধ থেকে আরো প্রায় আধা কিলোমিটার সামনে সাগরে সেই ঢেউকে দুর্বল করে দেওয়া হয়। এতে আর তীর ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। তবে নির্যাতিত কয়েকজন সাধারণ রোহিঙ্গা দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আমরা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছি। বাংলাদেশের মানবিক সরকার আমাদের আশ্রয় দিয়েছে। আমরা ভাসানচর যেতে রাজি।
এদিকে ভাসানচরের মুদি দোকানদার মো. জসিম উদ্দিন দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, প্রায় দুই বছর আগে তিনি এবং আরও শতাধিক ছোট ব্যবসায়ী এই দ্বীপে আসেন। তিনি বলেন, এটা দ্বীপ না। এটা একটা শহর। রোহিঙ্গারা যদি এখানে আসে, তাহলে এটা একটা বড় শহরে পরিণত হবে। আমরা তাদের আসার জন্য অপেক্ষায় আছি। কারণ, তারা এলে আমাদের ব্যবসা আরও বেড়ে যাবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।