হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মোহাম্মদ আবদুল গফুর
বাংলায় একটা বহুল প্রচলিত কথা আছে- চিরদিন কাহারো সমভাবে যায় না। এ কথাটা যেমন কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে সত্য, তেমনি সত্য একটি জনগোষ্ঠী বা জাতি সম্পর্কে। আজ আমরা বাংলাদেশ নামের যে স্বাধীন রাষ্ট্রের গর্বিত নাগরিক, সে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের দিকে তাকালেও একই সত্যের প্রমাণ মেলে।
আমরা সকলেই জানি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বশেষ পর্যায়ে আমাদের একটি সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়, যা ইতিহাসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নামে অভিহিত হয়ে আছে। এই মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশী দেশ ভারত আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের মিত্রশক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন ব্যক্তিবর্গ জানেন, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যায় যেমন কাটে একটি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে, তেমনি এই স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বপ্রথম পর্বও কেটেছিল সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে।
পলাশী রণাঙ্গনে ১৭৫৭ সালে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়বরণের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা হারাই এবং এদেশে সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার থেকে আসা ইংরেজদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। পলাশীতে আমাদের স্বাধীনতা সূর্য অস্ত যাওয়ার পর স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার লক্ষ্যে প্রধানত মুসলমানরা একশ বছর ধরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যায়। এসব সংগ্রামের মধ্যে রয়েছে মজনু শাহের নেতৃত্বাধীন ফকীর আন্দোলন, রংপুরের নুরুলদিন ত্রিপুরার, শমসের গাজী, সন্দীপের আবু তোরাব লক্ষীপুরের নওযাব আলী প্রমুখ কৃষক নেতার বিদ্রোহ, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লাখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রাম, হাজী শরীয়ত উল্লাহদুদু মিয়ার ফারায়েজী আন্দোলন, মহিশুরের হায়দার আলীটিপু সুলতানের সংগ্রাম, বালাকোট খ্যাত সৈয়দ আহমদ বেরলভীর জেহাদ আন্দোলন এবং সর্বশেষে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ।
প্রতিবেশী বৃহৎ সম্প্রদায় হিন্দুদের অসহযোগিতার কারণে অবশ্য এসব সশস্ত্র সংগ্রামের সবগুলোই ব্যর্থ হয়। হিন্দু জমিদার, ব্যবসায়ী ও বুদ্ধিজীবীরা ১৮৫৭ সালের ২২ মে বিদ্রোহীদের বিপক্ষে ইংরেজ সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন জানান। ২৫ মে বর্ধমানের জমিদার মহারাজা মাহাতাব চাঁদ ২৫০০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তির স্বাক্ষরযুক্ত একটি স্মারকলিপি মারফত সরকারের প্রতি তাদের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। সর্বশেষ সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতায় হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা উল্লাসে ফেটে পড়েন। সাহিত্য স¤্রাট বঙ্কিম চন্দ্র সংবাদ ভাস্কর-এ লিখলেনÑ ‘পাঠক সকল জয় জয় বলিয়া নৃত্য কর, হিন্দু প্রজা সকল দেবালয়ে সকলের পূজা দেও, আমাদের রাজ্যেশ্বর শত্রুজয়ী হইলেন।’ আর কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখলেনÑ
চিরকাল হয় যেন ব্রিটিশের জয়।
ব্রিটিশের রাজলক্ষ্মী স্থির যেন রয় ॥
এমন সুখের রাজ্য আর নাহি হয়।
শাস্ত্রমতে এই রাজ্য রামরাজ্য কয় ॥
সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার পর মুসলমানদের ওপর ইংরেজ শাসকদের নির্যাতনের স্টিমরোলার নতুনভাবে নেমে আসে। এ পরিস্থিতিতে মুসলমানদের ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য উত্তর ভারতের স্যার সৈয়দ আহমদ খান, বাংলার নবাব আবদুল লতিফ প্রমুখ তদানীন্তন মুসলিম নেতৃবৃন্দ সাময়িকভাবে হলেও বৃটিশ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করে হিন্দুদের মতো আধুনিক শিক্ষার ক্ষেত্রে মুসলমানদের এগিয়ে নেয়ার প্রয়াস পান। এই সহযোগিতা যুগের শেষ নেতা নবাব সলিমুল্লাহর আমলে ১৯০৫ সালে প্রধানত প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে তদানীন্তন বাংলা বিহ্যার উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত বিশাল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি বিভক্ত করে ঢাকা রাজধানীসহ ‘পূর্ব বঙ্গ ও আসাম’ নামের একটি নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করা হলে পূর্ববঙ্গে অবস্থিত জমিদারিতে কলকাতা প্রবাসী হিন্দু জমিদারদের প্রভাব হ্রাস পাওয়ার ভয়ে এবং ঘটনাক্রমে নতুন প্রদেশটি মুসলিমপ্রধান হওয়ায় তারা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বিরাট আন্দোলন সৃষ্টি করে বসেন।
যে হিন্দু নেতৃবৃন্দ সব সময় ইংরেজ শাসকদের প্রতি সমর্থন দিয়ে এসেছেন তাদের এ আকস্মিক রুদ্রমূর্তি দেখে ইংরেজ সরকার ভড়কে যায় এবং মাত্র ছয় বছরের মাথায় ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করে তাদের পুরনো মিত্রদের মনোরঞ্জনের প্রয়াস পায়। এদিকে নতুন প্রদেশ সৃষ্টি হওয়ায় দীর্ঘ অবহেলিত পূর্ববঙ্গের উন্নয়নের ন্যূনতম সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় নবাব সলিমুল্লাহ বঙ্গভঙ্গের প্রতি বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষিত হওয়ায় তিনি ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ হন। সরকার তাঁর ক্ষোভ প্রশমনার্থে তাঁর অন্যতম দাবি ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা দেয়।
এতেও হিন্দু নেতৃবৃন্দের আপত্তি। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তাদের যুক্তি (কুযুক্তি?) ছিল বঙ্গভঙ্গের দ্বারা নাকি বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদের মতো পাপ হবে। এবার তাদের যুক্তি হলো, ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তার দ্বারা বাঙালি সংস্কৃতি দ্বিখ-িত হয়ে যাবে। তবে তাদের আরেকটা বক্তব্য থেকে তাদের আসল মনোভাব প্রকাশ পেয়ে গেল বড় কদর্যভাবে। তারা বলল, পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ মানুষ অশিক্ষিত মুসলমান চাষাভূষা, তাই তাদের উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দরকার নেই। অর্থাৎ পূর্ববঙ্গের মানুষ অশিক্ষিত চাষাভূষা তারা তা-ই থাক, তাদের শিক্ষা বা উচ্চশিক্ষা কোনোটারই প্রয়োজন নেই। আর বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদের যে যুক্তি তারা দিয়েছিল তাও যে ছিল ভুয়া তাও প্রমাণ হয়ে গেল অল্প কয়েক বছর পরই। বৃটিশ শাসনের অবসানে ১৯৪৭ সালে যখন ভারত ও পাকিস্তানের বাইরে একটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে বৃহত্তর সার্বভৌম বাংলা গঠনের উদ্যোগ নেন সোহরাওয়ার্দী, হাশিম, শরৎচন্দ্র প্রমুখ নেতৃবৃন্দ তার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদের মতো পাপ করতে উন্মত্ত হয়ে উঠে তারা বলেন, ভারত ভাগ না হলেও বাংলা ভাগ হতেই হবে। নইলে নাকি বাঙালি হিন্দুরা চিরতরে বাঙালি মুসলমানদের গোলাম হয়ে যাবে। সেদিন মুসলমান বাঙালিদের চেয়ে হিন্দু অবাঙালিদের নেতৃত্ব তাদের কাছে অধিক প্রিয় হয়ে উঠেছিল।
আসলে এটাই বাস্তবতা। এই কঠোর বাস্তবতার স্বীকৃতি মেলে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পদে পদে। উপমহাদেশের সুদীর্ঘ ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বের দিকে তাকালে দেখা যায়, উপমহাদেশের শত শত বছরব্যাপী মুসলিম শাসনামলে কখনো সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ ওঠেনি। এমন কি যে আওরঙ্গজেব সর্বাপেক্ষা ইসলামী আদর্শপন্থি মোগল শাসক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন, তার দরবারেও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে হিন্দু অমাত্য অধিষ্ঠিত ছিলেন। একই ভাবে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলাহর দরবারেও জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ, মোহন লাল প্রমুখ প্রচুর সংখ্যক হিন্দু অমাত্য ছিলেন।
উপমহাদেশে প্রথম সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বীজ বপন করে ইংরেজরা। পলাশী যুদ্ধের আগেই তারা একদিকে মুসলিমবিদ্বেষী মারাঠাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে, অন্যদিকে সিরাজ দরবারের জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ প্রমুখ হিন্দু অমাত্যদের সাথে গোপন যোগাযোগ স্থাপন করে সিরাজুদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে দেয়। স্বাধীনচেতা নবাব সিরাজুদ্দৌলাহকে সরিয়ে অন্য কোনো ক্ষমতালোভী দুর্বলচেতা মুসলিম নেতাকে নবাব করার ব্যাপারে ক্লাইভ ও হিন্দু চক্রান্তকারীরা একমত হয়। এ ব্যাপারে জগৎশেঠদের পছন্দ ছিল দুর্বলচেতা ক্ষমতালোভী মুসলিম অমাত্য ইয়ার লুৎফে খান। কিন্তু সুচতুর ক্লাইভ তাদের বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হন যে, শুধু সিরাজের পরিবর্তে কোনো মুসলমানকে নবাব করলেই চলবে না, তাকে সিরাজের আত্মীয় হতে হবে। যাতে করে বাইরের লোকেরা একে পারিবারিক কোন্দলের বেশি কিছু মনে না করে। সেই নিরিখেই তারা মীর জাফরের ব্যাপারে একমত হন।
প্রস্তাব পেয়ে মীর জাফর তো বেজায় খুশি। তিনি ক্লাইভের পরামর্শ মোতাবেক যা যা প্রয়োজন সবকিছু করতে রাজি হয়ে গেলেন। এভাবেই পলাশী বিপর্যয়ের ভিত্তি নির্মিত হয়ে গেলে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীতে নাটকের শেষ পর্বটুকু অভিনীত হয় মাত্র। পলাশীর পর বাংলার নতুন নবাব হন মীর জাফর। কিন্তু তিনি অচিরেই বুঝতে পারেন, তিনি নামকাওয়াস্তে নবাব মাত্র। মূল ক্ষমতা চলে গেছে ইংরেজ ও তাদের সহযোগী জগৎশেঠদের হাতে। পলাশীর পর স্বাভাবিকভাবেই নব্য শাসক ইংরেজদের নীতি হয়ে দাঁড়াল প্রশাসন, প্রতিরক্ষা, জমিদারি, আয়মাদারী, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রভৃতি প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র থেকে বেছে বেছে মুসলমানদের উৎখাত করে সেসব স্থানে ইংরেজ অনুগত হিন্দুদের বসানো। পলাশী বিপর্যয়ের অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই ১৭৯৩ সালে বাংলার পুরনো ভূমিব্যবস্থা বদলিয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামের ভূমিব্যবস্থার মাধ্যমে ইংরেজ অনুগত এমন এক নব্য জমিদার গোষ্ঠী সৃষ্টি করা হয় যার সিংহভাগই ছিল হিন্দু। এভাবে একশ বছরের কম সময়ের মধ্যে এককালের স্বচ্ছল মুসলমান সম্প্রদায়কে একটি নিঃস্ব জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হয়। অন্য পক্ষে মুসলমানরাও সাতসমুদ্র তের নদীর ওপার থেকে আসা বিদেশি ইংরেজদের শাসন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না। পলাশীর পর প্রথম একশ বছর তো তারা স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার লক্ষ্যে সশস্ত্র সংগ্রামই চালিয়ে যায়। এই একশ বছরের শেষ যুদ্ধ ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পর আত্মরক্ষার লক্ষে নব্য শাসকদের সঙ্গে সহযোগিতার পাশাপাশি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের যে সংগ্রাম এগিয়ে নেয়া হয় তারই একপর্যায়ে ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবে উপমহাদেশের মুসলিম অধ্যুষিত পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে একাধিক স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবী স্থান পায়।
লাহোর প্রস্তাবে কোথাও ‘পাকিস্তান’ শব্দের উল্লেখ ছিল না। তবুও পরদিন সব হিন্দু পত্রিকায় এই খবর পরিবেশিত হয় ‘পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত’ বলে। মুসলিম লীগও তার এ সম্পর্কিত আন্দোলনকে পাকিস্তান আন্দোলন হিসেবেই ধরে নেয়। ১৯৪৬ সালে সমগ্র ভারতবর্ষে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তার মূল ইস্যুই ছিল মুসলিম জনগণ পাকিস্তান দাবি সমর্থন করে কিনা। কারণ কংগ্রেসের বক্তব্য ছিল, ভারতের হিন্দু-মুসলমান সবাই ভারতকে একটি অখন্ড রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম জনগণ বিপুলভাবে পাকিস্তান দাবির প্রতি সমর্থন জানায়। ১৯৪৬ সালে দিল্লিতে মুসলিম লেজিসলেটারদের যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তাতে বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ডেলিগেশনের নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী সম্মেলনে মূল প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবের পক্ষে বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি একপর্যায়ে বলেন, লোকে আমাকে প্রশ্ন করে, পাকিস্তানই আপনার শেষ দাবি কিনা। এ প্রশ্নের আমি কোনো জবাব দেব না। তবে এ কথা আমি অবশ্যই বলব, এ মুহূর্তে পাকিস্তানই আমার প্রধান দাবি। অর্থাৎ তিনি লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়নের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নাকচ করে দিলেন না।
এই পটভূমিতেই ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পর প্রথমে ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতি আন্দোলনের মাধ্যমে দেশে লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক যে স্বাধিকার চেতনা সৃষ্টি হয় ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তার পক্ষে একচেটিয়া গন রায় প্রদত্ত হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পশু বলে টিক্কা বাহিনী সে স্বাধিকার চেতনা ধ্বংস করে নিতে উদ্যত হলে বাংলার জনগণ জীবন পণ করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েম করে।
১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আমাদের ২১৪ বছরের সুদীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের দিকে তাকালে এটা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এ সংগ্রামের প্রথম একশ বছর এবং শেষের নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রাম চললেও মধ্যবর্তী সময়ে এ সংগ্রাম চলেছে নিয়মতান্ত্রিক পথে। অপর পক্ষে এ সংগ্রামের প্রথম একশ নব্বই বছর সমগ্র ভারতবর্ষের মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধভাবে এ সংগ্রাম চালনা করতে হয়েছে। শুধু সর্বশেষ ২৪ বছর এ সংগ্রামে অংশ নেয় সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সমগ্র জনগোষ্ঠী। আমাদের এ সুদীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বশেষ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে অবশ্য প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত আমাদের সাহায্য করে। সে সময় আমাদের অন্তবর্তীকালীন মুজিবনগর সরকারকে ভারত তার নিজের জমিনে পেয়ে যে সাত দফা চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করে সেগুলো ছিল নি¤œরূপ :
(এক) মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কমান্ডের অধীনে থাকবে।
(দুই) স্বাধীন বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না।
(তিন) বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেখানে ভারতীয় বাহিনী থাকবে।
(চার) বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য থেকে একটি বাহিনী গঠন করা হবে।
(পাঁচ) মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি এমন সকল সরকারি কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হবে। প্রয়োজনে ভারতীয় কর্মকর্তা দ্বারা শূন্য স্থান পূরণ করা হবে।
(ছয়) বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অবাধ সীমান্ত বাণিজ্য চলবে।
(সাত) বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা নেয়া হবে।
এই অসম চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হওয়ার পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম অসুস্থ হয়ে পড়েন।
[দ্রষ্টব্য : বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে র এবং সিআইয়ের ভূমিকা : মাসুদুল হক।]
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমগ্র ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে এটা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম ১০০ বছরের সশস্ত্র সংগ্রামে প্রধানত উপমহাদেশের মুসলমানরাই অংশগ্রহণ করে। আবার ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ২৪ বছর নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামে ও প্রধানত বাঙালি মুসলমানরা সংগ্রামে নেতৃত্বদান করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে তাদের পাশাপাশি কিছু সংখ্যক ভারতীয় সেনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও সে সময় আমাদের মুজিবনগর সরকারকে ভারত তাদের জমিনে পেয়ে যে সাত দফা চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করে তাতে মনে হয় একটি স্বাধীন শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার চেয়ে বাংলাদেশকে ভারতের একটি আশ্রিত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতেই ভারতের আগ্রহ ছিল অধিক।
সেই নিরিখে বলা যায়, ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের কয়েদখানা থেকে যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পথে দিল্লিতে যাত্রাবিরতিতে প্রথম সুযোগেই বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনী প্রত্যাহারের জন্য চাপ না দিতেন তাহলে বাংলাদেশ প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশ স্বাধীন হতে পারত কিনা সন্দেহ। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এ সুদীর্ঘ ইতিহাসে যার যতটুকু অবদান ততটুকুই স্বীকৃতি দেয়া প্রয়োজন। সে হিসেবেই বলা চলে, কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের কোনো স্থায়ী মিত্র বা শত্রুদেশ হতে পারে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।