Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইত্যাদি ভালো আর আলোর প্রতিচ্ছবি

দর্শকের দৃষ্টিতে এবারের ইত্যাদি

আবু সাঈদ: | প্রকাশের সময় : ২ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

করোনার কারণে কয়েক মাস বিরতির পর আবারও দর্শকের সামনে হাজির হলেন সবার প্রিয় হানিফ সংকেত। দীর্ঘদিন পর হলেও এটিই ছিলো করোনাকালে কয়েক হাজার দর্শক নিয়ে অনুষ্ঠিত দেশের প্রথম অনুষ্ঠান। আর এই অনুষ্ঠানে হানিফ সংকেত তুলে ধরলেন তাঁর চিরচেনা নিজস্ব শৈল্পিক ধাঁচের মনোমুগ্ধকর ‘ইত্যাদি’। গত বৃহস্পতিবার বিটিভি ও বিটিভি ওয়ার্ল্ডে প্রচারিত প্রাণোচ্ছ্বল এ-আয়োজনটি মঞ্চস্থ হয়েছে রাজশাহীর সারদার পুলিশ একাডেমিতে। যাপিত জীবনের অসঙ্গতি নিয়ে কয়েকটি নাট্যাংশ, নাচ ও গান ছাড়াও হৃদয়গ্রাহী নানা প্রতিবেদনে মমতামাখা এক আবহের সৃষ্টি হয় এবারের ইত্যাদিতে। প্রতিবারের মতো এবারও নিভৃতচারী আলোকিত মানুষের পাশে ছিলো শিকড় সন্ধানী ইত্যাদি। এবারের শুরুটাও ছিল দুর্দান্ত। করোনার কারণে ‘দূরত্বকে গুরুত্ব’ দেয়ার কথা বলে ছন্দবদ্ধ নান্দনিক উপস্থাপনার পরশ বুলিয়ে দেন হানিফ সংকেত। তারপর একে একে উঠে আসে নানা আয়োজন। করোনায় সুপরিচিত স্যানিটাইজার ব্যবহারের কথা আমরা সকলে জানি। সেটা হলো হ্যান্ড স্যানিটাইজার। কিন্তু ‘ইত্যাদি’তে তুলে ধরা হলো ‘ব্রেইন স্যানিটাইজারের’ কথা। আমাদের ব্রেইন থেকে ঝগড়াসহ বিভিন্ন কুচিন্তার জীবাণু মেরে ফেলতেই এ ধরনের তির্যক অথচ বাস্তবধর্মী এক প্রতিষেধকের কথা তুলে ধরা হয়েছে একটি নাট্যাংশে। প্রতিষেধক হিসেবে অভিভাবকের গুরুত্বের বিষয়টিও এড়িয়ে যায়নি। করোনা নিয়ে আরেকটি নাট্যাংশে বার্তা দেয়া হয়েছে, ওষুধে রোগ সারলেও বদভ্যাস সারে না। এই বদভ্যাস বদলানোর দায়িত্ব অভিভাবকেরই। মাত্রাতিরিক্ত অনলাইন-আসক্তি মারাত্মক শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি করে বলেও নাট্যাংশটিতে তুলে ধরা হয়েছে। করোনা মহামারীতেও যারা এটিকে পুঁজি করে প্রতারণা করেছেন, তাদের চরমভাবে কটাক্ষ করা হয়েছে একটি নাট্যাংশে। ‘চোর, চরিত্রহীন, মিথ্যাবাদী, প্রতারক, লম্পট ও খারাপ’ লোকদের বিভিন্ন টক শোতে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়েও তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। মামা-ভাগ্নে পর্বে তাই দেখানো হলো ‘ক্লিন ইমেজ সেন্টার’। সেই সেন্টারের কাজ হলো, টকশোতে আসা লোকদের ইমেজের ব্যাপারে টিভি চ্যানেলগুলোকে তথ্য দেয়া। ‘নিজের ইমেজ আগে ক্লিন করা জরুরি’- ভাগ্নেকে দেয়া মামার এ-উপদেশের মাহাত্মও সুদূরপ্রসারী। এর মাধ্যমে সততা ও সৎ থাকার ওপরে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সৎ থাকলে দায়িত্ব যত কঠিনই হোক, তা পালন করা সম্ভব-এমন মহান বার্তা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে দর্শক পর্বে। মানুষ ও প্রকৃতি নিয়ে মমতামাখা কয়েকটি প্রতিবেদন হৃদয় ছুঁয়ে যায়। রাজশাহীর পদ্মার পারের সীমান্তবর্তী খিদিরপুর চর। ভাঙ্গনের কবলে পড়ে মাত্র দেড় দশকে এর আয়তন কমে হয়েছে একশত ভাগের এক ভাগ। শতভাগ বাল্যবিবাহ, ভাঙনে তীব্র হাহাকার, পুরো চর বিলীনের আশঙ্কা, আশার পদ্মার সর্বনাশা হয়ে ওঠা বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার এক শিশুসদনের কথা উঠে এসেছে আরেক প্রতিবেদনে। এই শিশু সদনটি প্রতিষ্ঠা করেছেন মো. শামসুদ্দিন সরকার। একসময় তার ১৭ বিঘা জমি ও বসতবাড়ি বিক্রি ছাড়াও তার স্ত্রীকে ভিক্ষে করতে হয়েছে এই শিশুসদনটির জন্য। অন্যকে আশ্রয় দিতে গিয়ে নিজেই আশ্রয়হীন হয়ে ওঠা এই বৃদ্ধও একসময় সপরিবারে এই সদনে বসবাস শুরু করেন। সব মিলিয়ে ২৩৫ সদস্যের বিশাল এই পরিবারের অবিরাম আনন্দে থাকার দৃশ্য দেখে আবেগতাড়িত হয়ে ওঠে দর্শক। হৃদয় ছুঁয়ে যায় এক অনাবিল ভালোলাগায়। এতিমখানার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার জন্য ইত্যাদি তাদের হাতে তুলে দেয় দুই লাখ টাকার চেক। হৃদয়ছোঁয়া আরও দুটি প্রতিবেদন দেখা যায় ধানমন্ডি লেক ও প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী শকুনকে নিয়ে। ধানমন্ডি লেকের সৌন্দর্য ও গুরুত্বের পাশাপাশি এর বর্তমান বেহাল দশার চিত্রও তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। প্রতিবেদন প্রস্তুত করার সময় ‘ইত্যাদি’র পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হলে মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী সরেজমিন পরিদর্শনে আসেন। সাথে ছিলেন হানিফ সংকেত। লেকটির নানা সমস্যা মন্ত্রীর সামনে তুলে ধরা হলে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা এই লেকটি নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দেন মাননীয় মন্ত্রী। শুধু তাই নয়, ইত্যাদি প্রচারের পরদিন থেকেই শুরু হয়ে যায় পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম। শকুন নিয়ে প্রতিবেদনটি ছিল একেবারেই ব্যতিক্রমী। আমরা শকুনকে যেভাবেই দেখে থাকি না কেন, এটি আসলে ‘শুভ পাখি’। হানিফ সংকেত এটিকে আখ্যায়িত করেছেন ‘প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী’ হিসেবে। কিন্তু প্রকৃতির এই পচ্ছিন্নতকর্মী আজ বিলীনের পথে। ভয়ংকর একটি তথ্য হলো, পুরো পৃথিবীতে ৯৯.৯০ শতাংশ শকুনই বিলুপ্ত। ভারতীয় উপমহাদেশে শকুন ছিল ৪ কোটি, এখন সেই সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। বর্তমানে বাংলাদেশে এ সংখ্যা ২৬০-এরও নিচে। শকুনের সাথে চরম ব্যাঙ্গাত্মকভাবে তুলনা করা হয়েছে ঘুষখোর মানুষকে। বলা হয়েছে, ‘আমাদের সমাজে শকুনের মতোই বর্জ্যভুক প্রাণী রয়েছে, যার নাম ঘুষখোর। তবে শকুন বর্জ্য খেয়ে পরিবেশ পরিষ্কার করে, আর ঘুষ নামক বর্জ্য খেয়ে ঘুষখোর নামক প্রাণীরা সমাজকে কলুষিত করে।’ কলুষিত এমন মানুষের চরিত্রের পাশাপাশি মানবিক ও পরোপকারী মানুষের এক চিত্র উঠে এসেছে এবারের ইত্যাদিতে। বগুড়ার সোনাতলার জাহিদুল ইসলাম। ৪০ বছর ধরে মানুষের পারাপারের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য তিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। সবার সহযোগিতা নিয়ে নিজ উদ্যোগে নির্মাণ করেছেন প্রায় ৫০০ বাঁশের সাঁকো। জাহিদুল ইসলামের এই মহৎ কাজকে আরো গতিশীল করার জন্য তাকে দেয়া হয় একটি মটর সাইকেল। এছাড়াও পাশ্চাত্য সভ্যতার সূতিকাগার গ্রিস নিয়েও ছিল তথ্যবহুল এক প্রতিবেদন। মাত্র ১১ জনের বাজার কমিটি করার উদ্যোগ নিতে গিয়ে সবার ‘পদ চাওয়ার মারাত্মক ব্যাধি’ নিয়ে করা নাট্যাংশটিও ছিল বেশ উপভোগ্য। ‘হুজুগে ও সুযোগে’ অসুস্থ সংস্কৃতির চর্চার দিকে কটাক্ষপূর্ণ ইঙ্গিত ও নানি-নাতি পর্বটিও প্রশংসার দাবি রাখে। সবশেষে কণ্ঠসম্রাট এন্ড্রু কিশোরের প্রতি হানিফ সংকেতের বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে দর্শকদের চোখের কোন ভিজে উঠে। সব মিলিয়ে বলা যায়, এবারের ‘ইত্যাদি’ ছিল প্রকৃতি, মানুষ ও জীবন নিয়ে এক ‘মমতামাখা ও হৃদয়গ্রাহী ইত্যাদি’। বরাবরের মতো এবারও যেখানে মানুষ খুঁজে পেয়েছে ভালো আর আলোর প্রতিচ্ছবি। ধন্যবাদ ‘ইত্যাদি’। ধন্যবাদ হানিফ সংকেত।
লেখক: ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, রংপুর।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ