Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০২৪, ১৮ আষাঢ় ১৪৩১, ২৫ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

মহানন্দার পাথরেই ঘুরছে জীবনের চাকা

আবু তাহের আনসারী, পঞ্চগড় থেকে : | প্রকাশের সময় : ২৫ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০১ এএম

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার মহানন্দা নদীতে নুঁড়ি পাথর সংগ্রহ করে লাখো মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। গঙ্গার একমাত্র উপনদী বাংলাদেশের মহানন্দা। নেপালের দক্ষিণ-পশ্চিমাস্থ হিমালয় পাহাড় থেকে সৃষ্টি হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে কার্শিয়াং ও শিলিগুড়ি অতিক্রম করে ভারতের ফুলবাড়ি দিয়ে বাংলাবান্ধার ঝাড়–য়াপাড়া সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশ শূন্য রেখায় এসে প্রবাহিত হয়েছে। বাংলাবান্ধার ঝাড়–য়াপাড়া সীমান্ত থেকে তেঁতুলিয়া সদরের পুরাতন বাজার পর্যন্ত আকাঁবাকাঁ পথে প্রায় ৪০ কিলোমিটার প্রবাহিত নদীটি ভারত-বাংলাদেশ সীমারেখা চিহ্নিত করে আবার ভারতে প্রবেশ করেছে। উইলিয়ম হান্টারের জরিপ (১৮৭৬) থেকে জানা যায় মহানন্দা এক সময় একটি প্রশস্ত এবং গভীর নদী ছিল। যার বুকে চলাচল করত বড় বড় মালবাহী নৌকা। মহানন্দা নদীর সীমান্তের এপারে বংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলা আর অন্যপারে ভারতের দার্জিলিং জেলার শিলিগুঁড়ি ও চটেরহাট থানা। এই মহানন্দা নদী যেনো বাংলাদেশ-ভারত মানচিত্রকে দ্বিখন্ডিত করেছে। মহানন্দা নদীতে ভোর বেলা যখন সূর্যের লাল রশ্মি ঝলঝল করে সোনালী আলোর ঝিলিক পড়ে। তখন জেলেদের ন্যায় ট্রাক্টরের টিউব, নেট, কোঁদাল আর বালু কাটার যন্ত্র নিয়ে হাজারো শ্রমিক ছুটে চলে মহানন্দায় পাথর সংগ্রহে। 

আশির দশকের আগ থেকে মহানন্দা নদীতে শ্রমিকদের পূর্ব পুরুষদের ন্যায় পাথর সংগ্রহ করলেও পাথরের কোন কমতি নেই। সেই সময় মহানন্দা নদীতে পাহাড়ি পানির ঢলের খর স্রোত খুব বেশি ছিল। কিন্তু পাথর শ্রমিকের সংখ্যা খুব কম ছিল। তখন শ্রমিকেরা মহানন্দা নদীতে ৫/৬টি কলাগাছের ভেলা তৈরি ঢাঁকি কোঁদাল আর নেট নিয়ে সাঁতরিয়ে নদীর বালুচর ঘেঁষে পাথর সংগ্রহ করত। প্রায় ঘন্টা চারেক পর উক্ত ভেলায় ৮/১০টি ঢাঁকি বোঝাই পাথর নিয়ে ঘাটে ফিরে আসত। অবশ্য এ সময় নদীর পানি আর খরস্রোত বেশি হওয়ায় অনেক সময় পানির স্রোতে ভেলা উল্টে সব কিছু ভেসে শ্রমিকদের সর্বনাশ হত। আর এমন অবস্থায় পড়লে শ্রমিকদের সেই দিনে রুটিরুজি বন্ধ হয়ে যেতো। পুনরায় নতুন করে পাথর তোলার সামগ্রী কিনে নদীতে যেতে হতো।
মহানন্দা একটি আন্তঃসীমান্ত নদী হওয়া সত্তে¡ও নব্বই দশকের পর ভারতের ফুলবাড়ি নামক স্থানে একতরফা বাঁধ নির্মাণ করে মহানন্দা নদীর পানির গতিপথ পরিবর্তন করে। ফলে মহানন্দা নদীর খোরস্রোত যেনো ভাটা পড়ে। নদীর বুকে জেগে উঠে ধূ ধূ বালুর চর। তখন থেকে মহানন্দায় পাথর শ্রমিকদের ভেলা ভাসানো চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।
এ সময়ে ভারতের বিএসএফ পাথর তোলায় বাঁধা দেয় এবং বিএসএফ’র বাঁধা উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদীতে পাথর তুলতে গিয়ে ঝাড়–য়াপড়া, সন্ন্যাসীপাড়া ও দক্ষিণ-উত্তর কাশিমগঞ্জ গ্রামের বেশ ক’জন পাথর শ্রমিক বিএসএফ’র গুলিতে নির্মমভাবে প্রাণ হারান। তখন মাঝে মধ্যে মহানন্দা নদীতে পাথর তোলা বন্ধ থাকত। এনিয়ে দু’দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী পতাকা বৈঠক করে বিরোধ নিস্পত্তি করত এবং মহানন্দা নদীতে পাথর তোলা ব্যবস্থা করত। পরবর্তীতে বিংশ শতাব্দীতে ভারত সীমান্তে কাটা তাঁরের বেড়া নির্মাণ করার পরও পাথর শ্রমিকদের উপর সীমান্ত বাহিনীর নির্যাতন চালাত। বর্তমানে মহানন্দা নদীতে বর্ষাকালের গাড়ীর টিউব পানিতে ভাসিয়ে এবং শুস্ক মৌসুমে শ্রমিকেরা দু’টি ঢাঁকির ভার সাজিয়ে বালুর চর বেয়ে পাথর সংগ্রহ করে। বর্তমানেও পাথর সংগ্রহে এই ধারাবাহিকতা বজায় আছে।
সর্দারপাড়া গ্রামের পাথর শ্রমিক জাহাঙ্গীর, বারঘরিয়া গ্রামের আশরাফুল এবং সাহেবজোত গ্রামের হবিবর রহমান বলেন, মহানন্দা নদীর পাথর তোলে আমাদের পূর্ব পুরুষরা জীবিকা নির্বাহ করে পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। আমরাও এই নদীতে পাথর তুলে পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে আছি। আমাদের ছেলে-মেয়েরাও পড়াশোনার ফাঁকে নদীতে পাথর তোলার কাজ করে।
বর্তমানে এ উপজেলার বাসিন্দারা ছাড়াও জেলার বিভিন্ন এলাকার গরীব দুঃখী লোকজন এই এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে নদীতে পাথর তোলার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। শ্রমিকরা জানায় ভারতের বিএসএফ’ এখন পাথর তুলতে বাঁধা দেয় না। বরং তাদের অফিসার আসলে বলে হিন্দি ভাষায় বলে ‘গিল্টি তোলা মাত কর-ওপারে ভাঁগ যাও’ আমরা তখন নিরাপদে চলে আসি। তাদের অফিসার চলে গেলে পুনরায় পাথর সংগ্রহ করি।
শ্রমিকরা জানায়, মহানন্দা নদীর কনকনে ঠান্ডা পানিতে পাথর তোলার কারণে তাদের শরীরে চর্ম রোগ, এলার্জি, বাতব্যথা ইত্যাদি রোগ হয়। বাজারে পল্লী চিকিৎসকদের কাছে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থ হয়ে পুনরায় নদীতে কাজ করে। এভাবে তাদের জীবন ও জীবিকা মহানন্দা নদীর পাথর তুলে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।
পাথর ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম জানান, একজন শ্রমিক দিনে ৫/৬ ঘণ্টা পাথর সংগ্রহ করে ৮শ’ থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেন। শ্রমিকদের কাছে প্রতি ঘনফুট (এক সেফটি) পাথর বর্তমানে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা দরে কেনা হয়। আমরা নেটিং, ছাটাই-বাছাই ও শুটিং করে প্রতি সেফটি পাথর ৬৫ থেকে ৭০ টাকা দরে বিক্রি করি। তবে শ্রমিক ছাড়াও ট্রাক মালিক, চালক, ব্যবসায়ী পাথরের উপর নির্ভর করে জীবন জীবিকা চালিয়ে বেকারত্ব জীবন থেকে রেহাই পেয়েছে। এ পাথর উত্তোলন করতে না পারলে এ এলাকায় দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তো ও শিক্ষা অনেকটা পিছিয়ে পড়তো এখানকার মানুষ।



 

Show all comments
  • আবু তাহের আনসারী ২৫ অক্টোবর, ২০২০, ১:২৮ পিএম says : 0
    নিউজটা যুগোপযুগী হয়েছে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জীবনের-চাকা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ