Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সিলেট মেট্রোপুলিশে গণবদলির আশঙ্কা!

আকবরকে পালাতে সহায়তাকারী অভিযোগে এক এসআই বরখাস্ত ৩ দিনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা ওসিদের সম্পত্তির হিসাবে দাখিল ও প্রকাশের দাবি

ফয়সাল আমীন | প্রকাশের সময় : ২২ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০১ এএম

রায়হান হত্যা ঘটনায় ঝড় উঠছে সিলেট মেট্রো পুলিশে। বিরাজ করছে গণবদলির আশঙ্কা। অপরদিকে, আকবর পলায়নে সহযোগী শনাক্তে পুলিশ হেডকোয়াটার্স গঠিত ৩ সদস্যের প্রতিনিধি টিম এখন সিলেটে। এর মধ্যে রায়হান হত্যার প্রধান হোতা এস আই আকবরকে পালাতে সহায়তা ও তথ্য গোপনের অপরাধে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বন্দর বাজার ফাঁড়ির আরেক পুলিশ কমর্কর্তাকে। এছাড়া ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম শেষে নতুন করে ৩ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করছে রায়হান পরিবার। সিলেট ও কক্সবাজরের সব থানার ওসিদের বিষয়-সম্পত্তির হিসেব দাখিল ও গণমাধ্যমে প্রকাশের দাবি তুলেছে দুর্নীতি মুক্তকরণ বাংলাদেশ ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটি। এদিকে, রায়হান হত্যার প্রতিবাদে এখন উত্তাল সিলেটে রাজপথ।

গণবদলির আশঙ্কা সিলেট মেট্রো পুলিশে : রায়হান হত্যা ঘটনার মধ্যে দিয়ে আরেক দফা ঝড় বইছে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশে। প্রথম দফায় এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণে আসামি গ্রেফতারের ব্যর্থতা সামলে নিলেও রায়হান হত্যা ঘটনা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে সিলেট মেট্রো পুলিশে। ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে জনমনে।

ইতোমধ্যে মেট্রোপলিটন পুলিশে উপ-কমিশনার (ডিসি-উত্তর) আজবাহার আলী শেখের আলিশান অফিস নিয়ে তথ্য বেরিয়েছে গণমাধ্যমে। দাবি উঠেছে পুলিশ বাহিনীতে সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে এই টাকার উৎস খুঁজে বের করা প্রয়োজন। ডিসি উত্তরের নিয়ন্ত্রণেই ছিল নগরীর বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়ি। সেই ফাঁড়ির বরখাস্তকৃত এস আই আকবর এখন লাপাত্তা। বের হয়েছে আকবরের ফাঁড়ি কেন্দ্রিক অনিয়ম দুর্নীতির কাহিনী। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় ১ বছর ধরে এখানকার দায়িত্বে আকবর। আকবরের গতিবিধি কার্যকলাপ অবশ্যই তদারকির দায়িত্বে ছিলেন পুলিশে উপ-কমিশনার (ডিসি-উত্তর) আজবাহার আলী শেখ। বন্দরবাজার হলো নগরীর প্রাণ। অপরাধ ও অপরাধী নিয়ন্ত্রণের চেয়ে চাষ করেই বিত্ত বৈভবের মালিক হয়েছেন এস আই আকবর। কিন্তু এসব কর্মের দায় কেবল এস আই আকরের ঘাড়েই কি একা উঠবে।
সচেতন মহল জানান, অন্যায় অবৈধ আয়ের ভাগবাটোয়ার টপ-টু-বটম পর্যন্তই বিস্তৃত। উপর খোশ তো নিচের কর্তাও ভালো থাকেন নিজ পদস্থ জায়গায়। আকবরও তেমন ছিলেন বন্দর বাজার ফাঁড়িতে। সিলেটের সীমান্ত দিয়ে অবৈধ ভাবে কসমেটিকস, সুপারি, মাদক, মোবাইল ফোনের বড় বড় চালান পৌঁছে নগরীর বন্দরবাজার ফাঁড়ি ছুঁয়ে। এছাড়া ফুটপাতে দখল ও অবৈধ ব্যবসা, হোটেল, মাদক, পতিতা ব্যবসা, জুয়াসহ সব ধরনের অপরাধের নিরাপদ রোড বন্দরবাজার এলাকা। আইন প্রয়োগের বদলে আইনের আশ্রয়-প্রশয়ে এ অপরাধগুলোর ব্যাপকতা বাড়িয়ে রাখা হয় কেবল অবৈধ অর্থ আদায়ের জন্য।

ফাঁড়ির ইনচার্জ আকবর ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করেই কাড়ি কাড়ি অর্থ লুটেছেন বন্দর বাজার এলাকা ঘিরে। একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, প্রতিদিন ২৫ হাজার টাকা দিতে হতো ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে। টাকার লোভে অস্থির এ কর্মকর্তার নিকট টাকাই ছিল সব। কিভাবে কোথায় থেকে আসছে এ অর্থ তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন পরোয়া করতেন না তিনি। এছাড়া সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে পুলিশ ফাঁড়িতে আসার জন্যে কনস্টেবল, এ এস আই ও এস আইরা থাকেন তৎপর। একজন এস আই একই ফাঁড়িতে একাধিকবার দায়িত্ব পালন করেছেন অনেকে এমনও নজির আছে। আবার একই এস আই ঘুরে ফিরে একাধিক পুলিশ ফাঁড়িরও দায়িত্বে রয়েছেন। অথচ এসএমপিতে অসংখ্য এস আই রয়েছেন-যাদের ভাগ্যে কখনো ‘আই সি’ শব্দটি লাগেনি। সূত্র মতে, পোস্টিং বাণিজ্যের পদায়ন হওয়া কর্মকর্তারা নগদে দিয়ে আসা অর্থ তুলতে তৎপর হয়ে উঠেন। এসব কর্মকর্তার কারণে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতি ঘটে। অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, সহসা বদলি হতে পারেন প্রায় ৪ বছর ধরে থেকে সিলেট মেট্রো পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়া। এছাড়া গণবদলির আশঙ্কাও রয়েছে। কিন্তু এ গণবদলির চেয়ে শুদ্ধি অভিযান জরুরী মনে করছেন অনেকে।

সূত্র জানায়, পুলিশ সদর দফতরে বদলির একটি তালিকাও পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তদারকিতে আইন রক্ষা বা অপব্যবহার করে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্য। কিন্তু সেই কর্তাদের নির্দেশ বা চাহিদা না মেটালে রক্ষা নেই। কিন্তু বিষয়টি প্রকাশ হয়ে গেলে ক্ষতি কেবল নিচের পর্যায়েই হয়। তিনি বলেন, আইনের পোষাকে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে বাকীরা সাবধান হয়ে যেত। সুশাসনের জন্যে নাগরিক (সুজন)’র সিলেট সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নিয়োগে কিছুটা পরিবর্তন আসলেও পোস্টিং বাণিজ্য এখনো রমরমা। সিলেটের বর্তমান অবস্থা আরো ভয়াবহ। এখানে সিন্ডিকেট করে পোস্টিং বাণিজ্য হয়। কঠোর পদক্ষেপ না নিলে এসব থামবে না।

পুলিশের তদন্ত টিম সিলেটে : রায়হান হত্যা ঘটনার প্রধান হোতা এস আই আকবরকে পালাতে সহযোগী শনাক্তে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত টিম সিলেটে অবস্থান করছেন। গত মঙ্গলবার রাতে রায়হানের নগরীর আখালিয়া এলাকার নেহারিপাড়ায় বাড়িতে যান এ টিমের সদস্যরা। পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (এআইজি) মোহাম্মদ আয়ুবের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটির সদস্যরা কথা বলেন রায়হান পরিবারের সাথে।
সেখান থেকে বেরিয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান এ আই জি মোহাম্মদ আয়ুব বলেন, এস আই আকবরের পালিয়ে যাওয়ার সাথে আর কোনো পুলিশ সদস্য জড়িতের তদন্ত করতে আমরা এখানে এসেছি। দুই-একদিনের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে বলে জানান তিনি।

পালাতে সহায়তার অভিযোগে বরখাস্ত হলেন এস আই হাসান : এস আই আকবরকে পালাতে সহায়তা ও তথ্য গোপনের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন বন্দর বাজার ফাঁড়ির এক পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি থানাধীন বন্দরবাজার ফাঁড়ির টু আইসি এস আই হাসান উদ্দিন। মহানগর পুলিশের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল বুধবার বিকেলে জানানো হয়, রায়হান হত্যার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক ইনচার্জ (সাময়িক বরখাস্ত) এস আই আকবর হোসেন ভ‚ঁইয়াাকে ফাঁড়ি হতে পালাতে সহায়তা ও তথ্য গোপনের অপরাধে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির (টু আইসি) এস আই হাসান উদ্দিনকে চাকরি হতে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।

৩ দিনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা : রায়হান হত্যায় জড়িত এস আই আকবরসহ সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতারে ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম শেষে আরেক দফা কর্মসূচি ঘোষনা করেছে এলাকাবাসী। গত মঙ্গলবার রাতে এক বৈঠকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা দেন স্থানীয় আখালিয়াস্থ নেহারা পাড়াবাসী। ৩ দিনের কর্মসূচি হলো- আজ বৃহস্পতিবার পরিবার ও এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, শুক্রবার বাদ জুমা মসজিদে মসজিদে রায়হানের জন্য দোয়া মাহফিল ও শনিবার বিকেল ৪টায় এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে মদিনা মার্কেট পয়েন্টে এক মানববন্ধন।

বিষয়টি নিশ্চিত করে রায়হানের আত্মীয় মো. শওকত হোসেন বলেন, ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটামের শেষের পর কঠোর কর্মসূচির কথা থাকলেও সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে আপাতত কর্মসূচি থেকে সরে আসা হয়েছে। তবে এরপরেও যদি জড়িতদের গ্রেফতারে প্রশাসন ব্যর্থ হয় তাহলে কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা করা হবে। এলাকাবাসীর পক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রিয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ বলেন, জড়িতদের গ্রেফতারে আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। বিচার পাওয়ার আন্দোলনে সকলকে থাকতে হবে ঐক্যবদ্ধ।

ওসিদের সম্পত্তির হিসাব দাখিল ও গণমাধ্যমে প্রকাশের দাবি : শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান, রায়হান হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার, সিলেট ও কক্সবাজার থানার ওসিদের বিষয় সম্পত্তির হিসাব সরকারের নিকট দাখিল এবং তা গণমাধ্যমে প্রকাশ ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে গত মঙ্গলবার বিকেল ৩টায় সিলেট নগরীর কোর্ট পয়েন্টে এক প্রতিবাদ সভা করেছে দুর্নীতি মুক্তকরণ বাংলাদেশ ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটি।
কেন্দ্রীয় সভাপতি অ্যাডভোকেট নাছির উদ্দিনের সভাপতিত্বে এতে প্রধান বক্তা ছিলেন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মকসুদ হোসেন। এ সময় নগরীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা থেকে ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে মিছিল সহকারে নেতাকর্মীরা প্রতিবাদ সভায় যোগদান করেন।

সভায় বক্তারা বলেন, পুলিশ হেফাজতে রায়হানের নির্মম হত্যার ঘটনায় সিলেটবাসীর ন্যায় গোটা দেশবাসী বিক্ষুব্ধ। এই নিষ্ঠুর ঘটনার দায় সরকার ও প্রশাসন এড়াতে পারে না। জনরোষ ঠেকাতে অবিলম্বে রায়হান হত্যাকারী আকবরসহ তার আশ্রয়-প্রশয়দাতাদের শাস্তি দেখতে চায় দেশবাসী। পাশাপাশি সিলেট ও কক্সবাজারের থানার সকল ওসিদের বিষয় সম্পত্তির হিসাব সরকারের নিকট দাখিল ও গণমাধ্যমে তা প্রচার করার জোর দাবিও জানান নেতৃবৃন্দ।

দুর্নীতি মুক্তকরণ বাংলাদেশ ফোরাম কেন্দ্রীয় সদস্য মানবাধিকার কর্মী সৈয়দ আকরাম আল সাহানের পরিচালনায় সভায় বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় সিনিয়র সহ-সভাপতি ইকবাল হোসেন চৌধুরী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, মামুন রশীদ এডভোকেট, বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন আহমদ, মাওলানা আব্দুল মালিক চৌধুরী, মৌলভীবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক, চিনুরঞ্জন তালুকদার, দক্ষিণ সুরমা শাখার সভাপতি আব্দুল ওয়াহিদ, সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালাম চৌধুরী সুহেল, সংবাদকর্মী মশাহিদ আহমদ, ইসলামী ঐক্যজোট সিলেট জেলা সভাপতি মাওলানা আসলাম রহমানী প্রমূখ।
রায়হান হত্যার প্রতিবাদে মুখর রাজপথ : রায়হান হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে সিলেটের রাজপথে চলছে আন্দোলন। নগরী ও জেলার বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে ধর্ষকদের দ্রুত বিচার ও হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবি জানাচ্ছে প্রতিবাদী জনতা। প্রতিদিন নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে একাধিক মানববন্ধন কর্মসূচী পালন হচ্ছে। একই সাথে সামজিক, রাজনৈতিক, ব্যবসায়ী, আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার লোকও শরীক হচ্ছে প্রতিবাদ কর্মসূিচতে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রায়হান হত্যা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ