যেভাবে ৫০০
ক্লাব ফুটবলে গোলের প্রায় সব রেকর্ডই তার দখলে। এবার সেই লিওনেল মেসি উঠে গেলেন আরেক উচ্চতায়। বার্সেলোনার জার্সি গায়ে ৫০০ গোলের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন মেসি।
ইমামুল হাবিব বাপ্পি
গত মার্চে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) প্রেসিডেন্ট থমাস বিচ ঘোষণা দেন, বিশ্বব্যাপি উদ্বাস্তু সঙ্কটের চিত্র স্বরূপ আইওসি ৫ থেকে ১০ জন রিফিউজি প্রতিযোগীকে রিও অলিম্পিকে সুযোগ করে দেবে। অলিম্পিক পতাকাই হবে তাদের বহনকারী পতাকা। অলিম্পিকের সংগীতই হবে তাদের জাতীয় সংগীত। এই দলের নাম হবে ‘উদ্বাস্তু অলিম্পিক অ্যাথলেট দল’। তাদের কান্ট্রি কোড হবে ‘আরওএ’। পরবর্তীতে এটি সংস্করণ করে করা হয় ‘আরওটি’। এই দল এখন রিও মাতাচ্ছেন বাকি অ্যাথলেটদের মতই।
অলিম্পিকে স্বতন্ত্র কোন দলের অংশগ্রহণ অবশ্য এটি নতুন নয়। বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ব গঠনই যেখানে অলিম্পিকের প্রধান সেøাগাণ সেখানে মানবসৃষ্ট কোন কারণে প্রতিযোগিরা অংশ নিতে পারবে না তা কি হয়। যে কারণে রাজনৈতিক বা আন্তর্জাতিক সঙ্কট থাকা সত্বেও বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগিরা কোন না কোন আন্তর্জাতিক সংগঠনের অধীনে অংশ নিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ক্রীড়াজজ্ঞে। ১৯৯২ সালে বার্সেলোনা অলিম্পিকে প্রথম স্বতন্ত্র দল হিসেবে অংশ নেয় যুগোসেøাভিয়া ও মেসিডোনিয়ার প্রতিযোগিরা। যুগোসেøাভিয়া ভেঙে পরবর্তীতে গঠিত সার্বিয়া ও মন্টিনোগ্রোর প্রতিযোগিরা সেবার অংশ নেয় জাতিসংঘের অধীনে। দলের নাম ছিল ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট অলিম্পিক পারটিসিপেন্টস অ্যাট দ্যা অলিম্পিক গেমস’। একটি রৌপ্যসহ মোট তিনটি পদক পেয়েছিল সেই দল। তিনটিই শুটিং থেকে। এছাড়া ২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিক ও ২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিকেও ছিল ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট অলিম্পিক অ্যাথলেটস’ নামে স্বতন্ত্র দু’টি দল। বলা যায় সেই আলোকে এবারো একটা দল অংশ নিচ্ছে।
রিও অলিম্পিকের এই দলে আছেন মোট ১০ জন অ্যাথলেট। এই দলের ৫ জনই দক্ষিণ সুদানের। দুইজন করে আছেন সিরিয়া ও কঙ্গোর, একজন প্রতিযোগী ইথিওপিয়ার। দক্ষিণ সুদানের সবার ইভেন্ট হল অ্যাথলেটিক্স। তাদের মূল ইভেন্ট অবশ্য এখনো শুরু হয়নি (১২ আগস্ট’১৬ পর্যন্ত)। সিরিয়ার দুই সদস্যের একজন করে ছেলে ও মেয়ে, দুইজনই সাঁতারু। দু’জনই বাদ পড়েছেন হিট থেকেই। কঙ্গোর জুডোকু পিপল মিসেন্গা বাদ পড়েন রাউন্ড ১৬ থেকে। আরেক জুডোকি ইয়োলান্দি মাবিকার অভিযান শেষ হয় রাউন্ড ৩২-এ।
তবে তাদের সাফল্য বিচার তো অলিম্পিক মেডেল জয়ের মাধ্যমে নয়। তারা এসেছে বিশ্বের লক্ষ-কোটি উদ্বাস্তুদের প্রতিনিধি হিসেবে। এর মাধ্যমে তারা একটি বার্তাই দিতে চায় বিশ্ববাসীকে ‘তারাও মানুষ’। তাদেরও ছিল আমাদেরই মত ঘর-বাড়ি, জনপদ সবই। ঠিক এমনটাই বলছিলেন সেই দলের একজন সিরিয়ার সাঁতারু ইউসরা মারদিনি। কিভাবে তিনি আজ এই দলে এলেন? বাকি সবাই-ই বা এই দলে অন্তর্ভুক্তি হলেন কিভাবে। কারো সাথেই হয়তো কারো বাস্তব জীবনের ভয়ঙ্কর সেই সব অভিজ্ঞতার মিল নেই। কারো জীবনের ঘটনা হয়তো অন্যকেও হার মানায়। আমরা একজন ইউসরা মারদিনির সেইসব কঠিন বাস্তবতার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরব।
ইউসরা মারদিনির বয়স মাত্র ১৮। এই বয়সে অন্যদের মত সেও কখনো হাতে স্মার্টফোন আবার কখনো একমুখ হাসি নিয়ে মেতে থাকত বন্ধুদের সাথে আড্ডায়। বাবা-মায়ের পরিবারে বাকি দুই বোনের সাথে সেও মেতে থাকত খুনটুসিতে। সবার মত তারও ছিল স্বপ্ন। বাবা সাঁতারু দলের কোচ হওয়ায় সেই স্বপ্ন ছড়িয়ে পড়ে মারদিনির মধ্যেও। সে স্বপ্ন দেখতে থাকে, একদিন সে নামকরা সাঁতারু হবে। এজন্য এক জিমন্যাসটিক্সেও ভর্তিও হয় সে।
এ পর্যন্ত সবই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এর পরই তার প্রিয় মাতৃভূমি সিরিয়ায় শুরু হয় যুদ্ধের দামামা। সর্বত্র সংঘাতের নির্মমতা, মুহূর্মূহু বোমার শব্দ, রক্ত আর মৃত্যুতে আলিঙ্গনের পরিচিত ভয়ানক দৃশ্য।
ইউসরা মারদিনির জীননের গল্পটাও তাই আর স্বাভাবিক থাকেনি। যে পুলে সে সাঁতার কাটত সেটি ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল বোমার আঘাতে। সেই আঘাত থেকে রেহায় পেল না তার বাড়িও। বিশ্বস্ত আপন ঘর একসময় পরিণত হল ধ্বংসস্তুপে। মারদিনিরা শারীরিকভাবে অক্ষতই ছিলেন। তবে সামনের দিনগুলো ছিল অন্ধকারময়। এরপরও সময় থেমে থাকে না। এক গড়িয়ে হল দুই, দুই হল তিন, তিনও একসময় পার হয়ে কাটল চার-চারটি বছর। আর কত? তারা বেঁচে ছিল ঠিকই, কিন্তু তাকে বেঁচে থাকা বলে কি?
মারদিনি একজন ফুটবলারকে জানত, যে মারা গিয়েছিল বোমার আঘাতে। চোখের সামনে ছেলেটির স্বপ্নকে চুর হতে দেখেছে সে। সে সিদ্ধান্ত নিল ‘এভাবে আর চালিয়ে যাওয়া সম্ভব না।’ তার সামনে পথ ছিল দু’টিÑ স্বপ্নকে কুরবানি করে জন্মভূমিতে থেকে যাওয়া, অথবা স্বপ্নকে সম্বল করে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমানো। মারদিনে বেছে নেন দ্বিতীয়টি। এরপর শুরু হয় দুঃসাহসী এক অভিযান। জীবন আর মরণের দড়ি টানাটানি খেলায় শেষ পর্যন্ত জয়ী হন মারদিনি। জীবনকে টিকিয়ে রাখাার সেই লড়াইয়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে মারদিনি বলেন, “পথিমধ্যে যে কোন সময়-ই আমি মরতে পারতাম। কিন্তু আমি তো আগেই মারা পড়েছিলাম আমার মাতৃভূমিতে। তাই, এ ছাড়া আমার কি-ই বা করার ছিল।”
দিনটা ছিল ২০১৫ সালের ১২ আগস্ট। সিরিয়ান গৃহযুদ্ধের বয়স ততদিনে পেরিয়েছে প্রায় সাড়ে চার বছর। অন্যান্য দেশত্যাগীদের (রিফিউজি) মত সেও সিদ্ধান্ত নিল দেশ ছাড়ার। সাথে ছিল তার বড় বোন ও তাদের দুই চাচাতো বোন। তাদের বাবা তাদের পথ অনুসরণ করছিল জিপিএসের মাধ্যমে। তাদের এই ভ্রমণ বাকি সব ভ্রমণের মত ছিল না। লেসবস দ্বীপ থেকে তারা যে ইঞ্জিন নৌকায় করে সমুদ্র যাত্রা শুরু করে তার ধারণক্ষমতা ছিল ২০জন। কিন্তু তাদের দলে লোকসংখ্যা ছিল তার চেয়েও ৬-৭ জন বেশি। সমুদ্র যাত্রার আধাঘন্টা পর হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল নৌকার ইঞ্জিন। এমতাবস্থায় লোকসংখ্যা কমানো না হলে নৌকা যে কোন সময় ডুবে যাবে। মারদিনি বলেন, “আমি জানতাম এটা লজ্জার হবে যদি আমি সমুদ্রে না নামি কারণ আমি একজন সাঁতারু।” কয়েকজনের সাথে তারা দুই বোনও সমুদ্রে ঝাপ দিল। নৌকায় দড়ি লাগিয়ে গভীর সমুদ্রে সাঁতার কাটতে থাকল তারা। এভাবে তারা সাঁতার কেটে নৌকা টানতে লাগল তীরের দিকে। এই কাজে তাদের সাথে ছিল আরো তিন নারী। প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা জীবন-মরণ এই যুদ্ধের পর তারা দেখা পায় তীরের। তখনকার কিছু স্মৃতি মারদিনির মুখেই শোনা যাক, “প্রত্যেকের শরীরের রং ধুসর হয়ে গিয়েছিল। এটা এমন ছিল যেন চোখের সামনেই নিজের জীবনকে শেষ হতে দেওয়া। আমি ও আমার বোন এক হাত দিয়ে নৌকা ধরে রেখে বাকি হাত ও পা ব্যবহার করে চিত সাঁতার দিচ্ছিলাম। শেষ এক দেড় ঘন্টা আমি আর পারছিলাম না। পানিও ছিল তীব্র ঠা-া। সুতরাং আমি ওপরে উঠলাম।” এরপর এসময় তারা কাঙ্খিত তীরের দেখা পায়। সেখানে পৌঁছেই মাটিতে শুয়ে পড়ে সে, সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে।
স্থল যাত্রাটাও তাদের জন্য সহজ ছিল না। গ্রিসে পৌঁছানোর পর ক্ষুধার্থ ও পিপাসার্থ শিবির যখন একটা খাবার রেস্টুরেন্ট দেখল তখন প্রথমদিকে তাদের কাছে খাবার বিক্রি করতে চায়নি দোকানিরা।“আমরা খাবার কিনে নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু তারা দিলো না। তারা ভাবছিল আমরা বোধহয় চুরি করব। অনেকেই ভাবছিল রিফিউজিদের কোন বাড়ি নেই, তাদের কিছুই নেই। তারা ভাবছিল আমরা শুষ্ক মরুর আদিবাসী। কিন্তু না, আমাদের সব ছিল, যেমনটি তোমাদের আছে।” বলেন মারদিনি।
একসময় তারা তাদের কাছে পানি ও খাবার বিক্রি করে। এমনকি একজনের কাছ থেকে একটা জুতা ও একটা ট্রাউজারও পান মারদিনি। তাদের লক্ষ্য জার্মানি তখনও এক হাজার মাইলের পথ। গ্রিস থেকে তারা মেসিডোনিয়া, সার্বিয়া, হাঙ্গেরি এবং অস্ট্রিয়া পাড়ি দিল পায়ে হেটে! এরপর তারা এগুতে থাকল বার্লিনের দিকে। ২৫ দিনের দুঃসহ সেই যাত্রার পর তারা পৌঁছালো বার্লিনে। সে বুঝল, আশা নামের বস্তুটা এখনো শেষ হয়ে যায়নি।
জার্মানিতে মারদিনির প্রথম আশ্রয় হয় একটা উদ্বাস্তু শিবিরে। সেখানে পৌঁছে সে প্রথমেই শুরু করে নিকটস্থ সাঁতার পুলের সন্ধান। একজন মিশরীয় দোভাষির সহায়তায় বার্লিনের সবচেয়ে পুরাতন সুইমিং ক্লাব ওয়াসারফ্রুয়েন্ডে স্পানাদুর খোঁজও পেয়ে যান তিনি। তার সাঁতার কৌশল দেখে সেখানকার কোচ অবাক হয়ে যায়। ফলে ক্লাবটিতে সুযোগ পেয়ে যান মারদিনি। কোচ ভ্যান স্প্যানারক্রেবস তাকে টোকিও অলিম্পিক ২০২০ এর জন্য প্রস্তুত করতে থাকে। কিন্তু গত মার্চে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি) ঘোষণা দেয় এবারের রিও অলিম্পিকে উদ্বাস্তু নামে একটা দল অংশ নেবে। যা ছিল সমস্ত বিশ্বের রিফিউজিদের জন্য এক আশার বাণী।
মারদিনি দ্রুতই বুঝতে পারল তাকে নিয়ে চারিদিকে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেছে। ইউরোপ, আমেরিকা, জাপানের মত বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকরা তার কাছে ফোন করতে লাগল। এক সময় আইওসি’র সংক্ষিপ্ত ৪৩ জনের তালিকায় যখন মারদিনির নাম আসল তখন কোচ স্প্যানারক্রেবস তার কাছ থেকে ফোন কেড়ে নিলেন। মনোযোগ দিতে বলেন অনুশীলনে। গত এপ্রিলে ৪০০ মিটারে মারদিনি সময় নেন ৫ মিনিট ২১.৩ সেকেন্ড, যা কোন সিরিয়ান নারী সাঁতারুদের মধ্যে দ্রুততমের রেকর্ড।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়াযজ্ঞের এই প্রতিযেগিতায় সে বিজয়ী হতে পারেনি। কিন্তু জীবন নামের প্রতিযোগিতায় বিজয়ীর যে সাক্ষর তিনি রেখেছেন তা সমস্ত মানবকূলের জন্যই হয়ে থাকল অনুপ্রেরণার। তার মতে, “তুমি যতটুকু ভাবো তার চাইতেও তুমি অনেক বেশি শক্তিশালী।” এবার ব্যর্থ হলেও তার স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়নি। কি তার স্বúœ? তার স্বপ্নের কথা তার মুখেই শুনি, ‘আমি সবার জন্য অনুকরণীয় হতে চাই। এটা আমার নিজের সাহায্যের জন্য নয়, মনের গভীর থেকে আমি এটা চাই সমস্ত উদ্বাস্তুদের সাহায্য করার জন্যে।’
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।