বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
দূত হত্যা ইসলামে নিষিদ্ধ এবং এর শাস্তিও কঠিন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে সর্বপ্রথম একজন কাফের শাসকের হাতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর একজন কাসেদ (দূত) হত্যার ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে রাসূলুল্লাহ (সা.) মূতা অভিযান পরিচালনায় বাধ্য হয়েছিলেন। ঘটনার বিবরণটি সকল সীরাতে বর্ণিত হয়েছে। সংক্ষেপে তা এই:
মূতা সিরিয়া এলাকার বাল্কা ভূখন্ডের প্রথম দিকে অবস্থিত। আরব ও সিরিয়ার সীমান্ত এলাকায় যে সব আরব সর্দার শাসনকর্তা ছিল তাদের একজনের নাম শোরাহবিল ইবনে আমর। সে ছিল উক্ত এলাকার বাল্কার প্রধান এবং রোমের কায়সারের অধীনে। এ আরবি বংশ দীর্ঘকাল থেকে খ্রিষ্টান এবং সিরিয়ার সীমান্ত স্থানসমূহের শাসনকর্তা ছিল।
রাসূলুল্লাহ (সা.) তৎকালীন বিশ্বের রাজন্যবর্গের নামে পত্র প্রেরণের ধারাবাহিকতায় হারেস ইবনে উমায়র ইজদি (রা.)-কে একখানা পত্র দিয়ে সিরিয়া অথবা বসরায় প্রেরণ করেছিলেন। তাকে শোরাহবিল ইবনে আমর আল গাস্সানি হত্যা করে। হুজুর (সা.) কোনো দূতকে হত্যা করতেন না। এর পূর্বে তার কোনো দূতকে হত্যা করা হয়নি। এটি ছিল প্রথম মুসলিম দূত হত্যা। তাই ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে দারুণভাবে ব্যথিত ও মর্মাহত করে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) ‘কেসাস’ বা প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য তিন হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী প্রস্তুত করে সিরিয়ার দিকে রওয়ানা করেন। মদীনা হতে দূরবর্তী এ পরদেশে প্রেরিত তিন হাজার সৈন্যের বাহিনীর প্রধান করেন তিনি জায়দ ইবনে হারেসা (রা.)-কে এবং আগাম বলে দেন, জায়দ ইবনে হারেসা (রা.) শহীদ হলে জাফর ইবনে আবি তালেব (রা.) সেনাপতির দায়িত্ব পালন করবে এবং জাফর শহীদ হলে আবদুল্লাহ ইবনে বাওয়াহা (রা.) সেনাপতি হবে।
তিনি সাথে সাথে এ কথাও বলে দেন যে, হারেস ইবনে উমায়র (দূত)-কে যেখানে (মূতা) শহীদ করা হয়েছে, সেখানে যেন তারা সহানুভূতি প্রদর্শনের জন্য গমন করে। তিনি আরো বলে দেন, ‘প্রথমে তাদের ইসলামের দাওয়াত দেবে, তারা দাওয়াত কবুল করলে যুদ্ধ করার প্রয়োজন নেই।’ রাসূলুল্লাহ (সা.) খোদ ‘সানিয়াতুল বিদা’ পর্যন্ত সৈন্যদের সাথে গমন করেন।
এ খবর জানার পর শোরাহবিল এক লক্ষ সৈন্য প্রস্তুত করে। অপরদিকে রোমের কায়সার ও আরবের এক লাখ সৈন্য বাল্কা নামক স্থানে তাবু স্থাপন করে। মুসলিম বাহিনী যখন ‘মাআন’ নামক স্থানে উপনীত হয়, তখন শত্রু বাহিনীর বিপুল সংখ্যার কথা জানতে পারে। প্রথমে এ খবর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট পৌঁছানোর বিষয় আলোচিত হলেও শেষ পর্যন্ত হজরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.)-এর শাহাদাতের প্রেরণা দায়ক বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে মুসলিম বাহিনী অগ্রসর হয়ে বাল্কা সীমান্তে পৌঁছে। তখন তারা দেখতে পায় ‘মাশারেফ’ নামক স্থানে কায়সারের বাহিনী সমবেত হয়েছে। মুসলিম বাহিনী ‘মূতা’-এর দিকে অগ্রসর হয় এবং এ স্থানে যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
হজরত জায়দ (রা.), হজরত জাফর (রা.) এবং হজরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.) পর পর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে শাহাদত বরণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনায় যুদ্ধ পরিস্থিতি তথা ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করে বর্ণনা করছিলেন (মোজেযা হিসেবে)। হজরত খালেদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.)-এর নেতৃত্বে যুদ্ধ চলছিল। অবশেষে এ ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনী বিশাল শত্রুবাহিনীকে পরাজিত করে বিজয়ী বেশে ফিরে আসতে সক্ষম হয়।
এ বিজয় সম্পর্কে বিভিন্ন মত থাকলেও ইবনে হিশাম জোহরী হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন যে, ‘আমাদের এটাই মনে হয় যে, হজরত খালেদ (রা.) যখন সেনাপতি হন, তখন আল্লাহতাআলা মুসলমানদের বিজয় দান করেন।’ ইবনে ইসহাক বলেন, ‘যখন মুসলিম বাহিনী এ যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তন করে মদীনায় পৌঁছে, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং মুসলমানগণ তাদেরকে এগিয়ে আনার জন্য রাস্তায় বের হয়ে আসেন। মুসলমানগণ এ বাহিনীর লোকদের প্রতি মৃত্তিকা নিক্ষেপ করে বলতে থাকেন, ‘হে ফেরারী (পলায়ন) দল! তোমরা আল্লাহর রাস্তা হতে ফেরার (পলায়ন) করে এসেছ।’ তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলছিলেন, ‘না, এরা কাররার- ইনশাল্লাহ আবার যাবে।’
এ যুদ্ধে শত্রুপক্ষের কত লোক মারা যায় সে সংখ্যা জানা না গেলেও মুসলিম বাহিনীর সর্বোচ্চ দশ বারোজনের বেশি হবে না। এ যুদ্ধ সংঘটিত হয় হিজরি ৮ম সালের জমাদিউল আউয়াল মাসে। এ যুদ্ধের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রধান হচ্ছে, দূত হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ, যা বিশাল শত্রæবাহিনীর মধ্যে ভীতি ও আতঙ্কের সঞ্চার করেছিল।
মূতা যুদ্ধের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে: ১। শত্রুপক্ষের বিশাল বাহিনীর মোকাবিলায় মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা ছিল মাত্র তিন হাজার। ২। রণাঙ্গন ছিল মদীনা হতে অনেক দূরে। ৩। মুসলিম বাহিনীর নগণ্য সংখ্যক সৈন্যদের মধ্যে মাত্র ১০/১২ জন শাহাদত বরণ করেন এবং বাকি সবাই নিরাপদে ফিরে আসেন। ৪। মুসলিম বাহিনী যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে সেই স্থান পরিদর্শন করে, যেখানে মুসলিম দূতকে হত্যা করা হয়েছিল। ৫। এই যুদ্ধে শহীদ সেনাপতিগণ ইসলামের ঝান্ডা সমুন্নত রাখেন। ৬। হজরত জাফর (রা.) ‘তাইয়ার’ ও ‘জুলজানাহাইন’ উপাধিতে ভূষিত হন। ৭। হজরত খালেদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.)-কে তার অসাধারণ বীরত্বের জন্য ‘সাইফুল্লাহ’ অর্থাৎ-আল্লাহর তরবারি উপাধি প্রদান করা হয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।