বিএনপির মানববন্ধন আজ, পাল্টা কর্মসূচি আওয়ামী লীগ
সারা দেশের মহানগর ও জেলা পর্যায়ে আজ মানববন্ধন করবে বিএনপি ও তার মিত্ররা। আর এ
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পশ্চিম লামা পাড়ায় মামুন নামে এক যুবককে হত্যার পর লাশ শীতলক্ষ্যায় ফেলে দেয়ার ৬ বছর পর সেই যুবক জীবিত ফিরে আসার ঘটনায় আদালত মামলার দুই তদন্ত কর্মকর্তাসহ তিনজনকে তলব করেছে। তারা হলেন, মামলার প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা ফতুল্লা মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এস আই) মো: মিজানুর রহমান, দ্বিতীয় তদন্তকারী কর্মকর্তা নারায়ণগঞ্জ সিআইডির উপ-পরিদর্শক (এসআই) জিয়া উদ্দিন উজ্জল ও মামলার তদারক কর্মকর্তা নারায়ণগঞ্জ সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার হারুনুর রশিদ। আগামী ৭ কার্য দিবসের মধ্যে আদালতে হাজির হয়ে তাদের লিখিত ব্যাখা দেয়ার জন্য আদেশ দিয়েছেন আদালত। বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আফতাবুজ্জামানের আদালত এই আদেশ দেন।
শুক্রবার (২ অক্টোবর) রাতে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নারায়ণগঞ্জ কোর্ট ইন্সপেক্টর আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, বুধবার মামলাটির ধার্য তারিখ ছিল। ওই দিন হত্যাকান্ডের শিকার যুবক তার আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে হাজির হয়। তখন বাদী-বিবাদীর আইনজীবীর বক্তব্য এবং হত্যাকান্ডের শিকার যুবকের জীবিত ফিরে আসার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর আদালত মামলার দুই তদন্ত কর্মকর্তা ও মামলার তদারককারীকে আদালতে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে আদেশ দিয়েছেন।
নারায়ণগঞ্জ সিআইডি’র সুপার নাসির উদ্দিনও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ঘটনার সূত্রপাত : তাসলিমা আক্তারের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব থানার শাখার পাড়া এলাকায়। তার বাবার নাম রহমত উল্লাহ। একই এলাকার প্রতিবেশী আবুল কালামের ছেলে মামুন তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু তাসলিমা রাজি হয়নি। ক্ষুব্দ হয় মামুন। শুধু কি তাই মামুনের বাবা-মা, ভাই-বোনও ক্ষুব্দ হয় তাসলিমার উপর।
তাসলিমা জানান, মামুন আমাকে প্রেমের অফার দেয়। তার অফার রাখি নাই দেখে সে বাড়িতে অনেক গ্যাঞ্জাম করে। বাড়িতে লোক পাঠায়। তারপর গ্রামের মেম্বার-চেয়ারমানের কাছে নালিশ করা হয়। তারপরও তারা তাদের ছেলেকে সামলায়ে রাখতে পারে নাই। তখন সে রাস্তা-ঘাটে আমাকে অনেক ডিস্টার্ব করতো।
তাসলিমা আরও জানান, এক পর্যায়ে মামুন ও তার পরিবারের ভয়ে আমি আমার ভাই রফিকের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার লামাপাড়া এলাকায় আমার খালা আমেনা বেগমের কাছে চলে আসি। কিন্তু তারা আমার পিছু ছাড়েনি। আমাকে ক্ষতি করার জন্য উঠে-পড়ে লাগে। কয়েকদিন পর আমি আবার গ্রামের বাড়ি চলে যাই। বাড়ি যাওয়ার পর পারিবারিকভাবে সাইফুল ইসলামের সাথে আমার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের তিনমাস পর আমার নাকের একটা অপারেশন হয়। ডাক্তারের কাছ থেকে আসার সময় মামুনের মা-ভাই-বোন আমাকে রাস্তায় একা পেয়ে অনেক টর্চার করে। এসময় আমি গর্ভবর্তী ছিলাম। আমাকে টেনে হেছড়ে ওদের বাড়ির ভেতর নিয়ে যায়। সেখানেও অনেক টর্চার করে। ওই ঘটনায় আমরা কোন বিচার পাই নাই।
তাসলিমা জানান, মামুন তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অভিমান করে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু মামুনের বাবা আবুল কালাম আমিসহ আমার বাবা রহমত উল্রাহ, ভাই রফিক, খালাতো ভাই সোহেল ও সাগর এবং আমার মামা সাত্তার মোল্লাকে আসামী করে মামলা দায়ের করে। আর এই মামলায় আমি ও আমার ভাই এক বছর করে জেল খাটি। বাকীরা সবাই এক মাস করে জেল খাটে।
তিনি আরও বলেন, জেলে থাকাবস্থায় আমাদের উপর অনেক নির্যাতন নিপীড়ন করা হয়। আমাকে গর্ভাবস্থায় জেল খাটতে হয়েছে। দফায় দফায় রিমান্ডে নিয়ে জবানবন্দী আদায়ের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু আমরা জবানবন্দী দেয়নি। কারণ আমরা এই ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত না। এরই মধ্যে মামুন (৩০ সেপ্টেম্বর) আদালতে হাজির হয়েছে।
৬ বছর পর ফিরে আসা মামুন জানায়, বাবা-মা তাকে কাজ কর্ম করতে বলে। তাই বাবা-মার সাথে অভিমান করে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। সে জানায়, রাজশাহী ও নাটোরের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে ছোট-খাটো কাজ কর্ম করেছি। রেস্টুরেন্টেও কাজ করেছি। ৬ বছর পরিবারের সাথে কোন যোগাযোগ করিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তাসলিমাদের বিরুদ্ধে আমার বাবা মামলা করেছে এবং মামলায় তারা জেলে ছিল এটা আমি জানতাম না। তাছাড়া মামলা কেনো করেছে তাও আমি জানি না। গত ২২ সেপ্টেম্বর আমি বাড়িতে আসি। এবং মায়ের কাছে জানতে পারি মামলার কথা। পরে বাবার মামলার আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করে মাকে নিয়ে আদালতে আসি।
আদালত সূত্র মতে, ২০১৪ সালের ১০ মে মামুন অপহরণ হয়েছে অভিযোগ এনে দুই বছর পর ২০১৬ সালের ৯ মে ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা করেন মামুনের বাবা আবুল কালাম। ওই মামলায় ৬ জনকে বিবাদী করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে মামুনকে অপহরণের পর গুমের অভিযোগ করা হয়েছিল। বিবাদীরা হলো তাসলিমা, রকমত, রফিক, সাগর, সাত্তার, সোহেল। মামলার পর পুলিশ অভিযুক্ত ৬জনকেই গ্রেপ্তার করে। তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। অভিযোগ রয়েছে রিমান্ডে থাকা সময়ে গ্রেপ্তারকৃত ৬ জনকে মারধর করা হয়। এবং ৬জনকেই ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদানের জন্য আদালতে পাঠানো হয়। কিন্তু তাদের কেউ আদালতে জবানবন্দী দেয়নি।
এদিকে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন, ফতুল্লা মডেল থানার এস আই মিজানুর রহমান। তিনি আদালতে আসামীদের রিমান্ড চাওয়ার সময়ে আর্জিতে উল্লেখ করেন, ‘খালাতো বোন তাসলিমা ২০১৪ সালের ১০ মে মামুনকে ডেকে নিয়ে কৌশলে অপহরণ করে বিষাক্ত শরবত পান করিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যায় ফেলে দিয়ে গুম করেছে।’ পরবর্তীতে মামলাটি তদন্ত করে জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের এস আই মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। তদন্তের এক পর্যায়ে মামলাটি পুলিশের অপরাধ বিভাগ সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়। সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ ২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর মামলার চার্জশীট আদালতে দাখিল করেন। এতে তিনি মামলার এজাহারভুক্ত ৬জনকেই অভিযুক্ত করেন। সাক্ষী করা হয়েছিল ২১ জনকে। চার্জশীটে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৪ সালের ১০ মে খালাতো বোন তাসলিমাকে দিয়ে কৌশলে মামুনকে বাড়ি ডেকে আনা হয়। পরবর্তীতে মামনুকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় তাসলিমা। কিন্তু বিয়েতে রাজী না হওয়াতে বিবাদী ৬ জন মিলে মামুনকে কোমল পানির সঙ্গে চেতনানাশক দ্রব্য খাইয়ে অচেতন করে সিএনজি চালিত অটো রিকশা করে অপহরণ করে অজ্ঞাতস্থানে নিয়ে যায়। তবে কোথায় কিভাবে কি অবস্থায় রাখা হয়েছে সেটা জানা যায়নি।’
আসামী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এমদাদ হোসেন সোহেল জানান, মামলায় বাদী আবুল কালাম উল্লেখ করেন তাসলিমা আক্তারের সাথে তার ছেলে মামুনের প্রেম ছিল। তাসলিমা ফতুল্লার লামাপাড়া এলাকায় তার খালা আমেনা বেগমের বাসায় থেকে স্থানীয় একটি গার্মেন্ট এ কাজ করে। প্রেমের সূত্র ধরে ২০১৪ সালের ১০ মে তাসলিমা মামুন কে ডেকে ফতুল্লা লামাপাড়ায় তার খালা আমেনার বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে নেওয়ার পর তাকে আটকে রেখে হত্যা করে লাশ বস্তাবন্দি করে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেয়। এই ঘটনায় মামুনের বাবা আবুল কালাম দুই বছর পর ২০১৬ সালের ২৩ মে ফতুল্লা মডেল থানায় ৬ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করে। মামলায় আসামিরা হলো তাসলিমা, তার বাবা রহমত উল্লাহ, ভাই রফিক, মামাতো দুইভাই সাগর ও সোহেল এবং মামা সাত্তার মোল্লা।
তিনি আরও জানান, মামলার তদন্ত সংস্থা আসামীদের একাধিকবার রিমান্ডে নিয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেস্টা করে। কিন্তু নির্যাতনের মুখেও তারা স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হয়নি। পরে ৬ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়। এরমধ্যে এক মাস জেল খাটার পর ৪ জনকে জামিন করাই। আর ১ বছর ২ মাস জেল খাটার পর তাসলিমা ও ১ বছর ৩ মাস জেল খাটার পর তার ভাই রফিকের জামিন করাই উচ্চ আদালত থেকে।
তিনি আরও জানান, দীর্ঘ ৪ বছর পর মামলাটির বিচার নিষ্পত্তির জন্য সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট প্রথম আদালতে আসে। এই মামলাতে আসামীদের জামিন নেওয়ার জন্য আমি আদালতে উপস্থিত হই। পরে গিয়ে দেখি যাকে অপহরণ ও গুম করার অভিযোগে মামলাটি হয়েছে সেই ভিক্টিম আদালতে সশরীরে উপস্থিত হয়েছেন।
অ্যাডভাকেট এমদাদ হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সিআইডি পুলিশ সঠিক তদন্ত না করে আসামীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা চার্জশিট দিয়েছে। নিরপরাধ মানুষগুলোকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করেছে। নিরপরাধ মানুষগুলো জেল খেটেছে। তারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আমি আদালতে প্রয়োজনে রিট করবো তাদের ক্ষতিপুরনের জন্য। একই সঙ্গে মিথ্যা বানোয়াট মামলার দায়ের করার কারণে মামলার বাদীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করছি। আর মামলার তদন্ত সংস্থার বিষয়ে আদালত বলবেন।
বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাড: মো. শেখ ফরিদ জানান, আমার মক্কেল কাউকে আসামী করে মামলা করেননি। একটি অজ্ঞাতনামা মামলা করেছিলেন। কিন্তু পরে তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামী হিসেবে তাদের নাম যোগ করেন। মামলাটি বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন ছিল। এরই মধ্যে ভিকটিম ফিরে আসেন এবং আমরা তাকে নিয়ে আদালতে হাজির। আদালত ভিকটিমকে আমার জিম্মায় দিয়েছেন।
এ ঘটনায় সিআইডির নারায়ণগঞ্জ শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার নাছির উদ্দিন আহমেদ ফতুল্লা থানা পুলিশকেই দায়ী করেন। তিনি দাবি করেন, পুলিশের পাঠানো জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করেই সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা চার্জশিট দিয়েছে। তবে সিআইডির তদন্তে কারো গাফিলতি থাকলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিতসহ ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান তিনি।
সিআইডির এই কর্মকর্তা আরো দাবি করেন, পরিবারের যোগসাজশেই পুলিশের কাছে তথ্য গোপন করে মামুনকে আত্মগোপনে রাখা হয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।