Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্ত্রীসহ ৬ জনের মৃত্যুদন্ড

দেশ কাঁপানো বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা মামলার রায়

জাকির হোসেন ও তালুকদার মো. কামাল, বরগুনা থেকে | প্রকাশের সময় : ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ২:০১ পিএম | আপডেট : ১২:১৮ এএম, ১ অক্টোবর, ২০২০

বহুল আলোচিত বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ছয়জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। একই মামলায় চারজনকে খালাস প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া দন্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন আদালত। গতকাল দুপুরে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান। মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ভ‚বন চন্দ্র হালদার এসব তথ্য জানান। এদিকে, রায়ের পর্যবেক্ষণে হত্যাকান্ডে মিন্নিকে মাস্টারমাইন্ড উল্লেখ করে আদালত বলেছেন, এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে তাদের অনুসরণ করে অন্য যুবকরাও ধ্বংসের পথে যাবে। এছাড়া এ রায়ে অন্য আলোচিত মামলার বিচারে গতি আনবে বলে তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। তিনি বলেন, এ রায় নিঃসন্দেহে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্তরা হলেন- মো. রাকিবুল হাসান ওরফে রিফাত ফরাজী (২৩), আল কাইয়ুম ওরফে রাব্বি আকন (২১), মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), রেজোয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় (২২), মো. হাসান (১৯) ও আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি (১৯)। এছাড়া এ মামলায় চার আসামিকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে। খালাসপ্রাপ্তরা হলেন- মো. মুসা (২২), রাফিউল ইসলাম রাব্বি (২০), মো. সাগর (১৯) ও কামরুল হাসান সায়মুন (২১)।

হত্যাকান্ডের ১ বছর ৩ মাস ৪ দিন পর গতকাল ঘোষিত এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ভ‚বন চন্দ্র হালদার বলেন, রায়ে আমরা খুশি,তবে রায়ের পূর্ণ কপি পাওয়ার পরে যদি মনে করি খালাসের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা দরকার, তবে আমরা পরবর্তীতে পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।
আসামি পক্ষে মিন্নির আইনজীবী বলেন, মামলা হলে রায় হবে। রায় মেনে নিতে হবে, তবে আমরা রায়ে সংক্ষুদ্ধ। আমরা সাজাপ্রাপ্তদের পরিবারকে পরামর্শ দেবো, দ্রুত সই মহর তুলে উচ্চ আদালতে যেন আপিল করেন। রায়ের পর বিকেল তিনটার দিকে ফাঁসির আদেশপ্রাপ্ত পুরুষ ৫ জনকে প্রিজনভ্যানে করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগে মিন্নিকে পৃথকভাবে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।

বরগুনায় আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলার ৩৫ মিনিট ধরে চলা রায় ঘোষণার সময় কাঠগড়ায় রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিসহ সব আসামি উপস্থিত ছিলেন। এসময় নিজের মৃত্যুদন্ডের ঘোষণা শুনেও বিচলিত হননি মিন্নি। তাকে এ সময় আতঙ্কিত বা কাঁদতে দেখা যায়নি।রায় শেষে এমন তথ্য দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এম. মজিবুল হক কিসলু। তিনি বলেন, বিচারক যখন রায় ঘোষণা করেন, রায়ে ফাঁসির আদেশের কথা শুনেও মিন্নি বিচলিত হননি। তাছাড়া চোখের পানিও ঝরতে দেখিনি। আমি ভেবেছিলাম, ফাঁসির আদেশের কথা শুনে মিন্নি অসুস্থ হবেন বা জ্ঞান হারাবেন, কিন্ত তা দেখা যায়নি। তাকে সুস্থ স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল।এ রায়কে যুগান্তকারী উল্লেখ করে তিনি বলেন, মিন্নি যে সত্যিকারের অপরাধী এবং এ হত্যাকান্ডের মূল হোতা, তা এ রায়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হলো।

আদালতের পর্যবেক্ষণ : রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, রিফাত শরীফ হত্যাকান্ডের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন মিন্নি। তারই পরিকল্পনায় রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। রায়ে পর্যবেক্ষণে বিচারক মো. আছাদুজ্জামান বলেছেন, রিফাত হত্যা মামলার আসামিদের নির্মম বর্বরতা ও নির্মমতা মধ্যযুগীয় কায়দায়কেও হার মানিয়েছে। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে তাদের অনুসরণ করে অন্য যুবকরাও ধ্বংসের পথে যাবে। এসব আসামি সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। রায় ঘোষণার সময় বিচারক বলেন, পাঁচজনের সহযোগী হিসেবে রিফাত শরীফ হত্যায় অংশ নিয়েছেন স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। একই সঙ্গে তারা ছয়জন রিফাতের মৃত্যু নিশ্চিত করেছেন। এজন্য কলেজগেটের সামনে সময়ক্ষেপণ করেন মিন্নি। রিফাতকে যখন মারার জন্য আসামিরা নিয়ে যাচ্ছিল তখন স্বাভাবিক ছিলেন মিন্নি। এতেই প্রমাণিত হয়, মিন্নি হত্যা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। তারই পরিকল্পনায় এ হত্যাকান্ড ঘটেছে। এজন্য তাকেও ফাঁসি দেয়া হয়েছে। এসব তথ্য জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মজিবুল হক কিসলু।

আইনজীবী আরো বলেন, মামলায় বিচারক তার পর্যবেক্ষণে স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন, আয়শার পরিকল্পনায় এবং তার কারণেই এ হত্যাকান্ড সংগঠিত হয়েছে। এতে বলা বলা হয়েছে, হত্যার আগে আয়শা মামলার মূল আসামি নয়ন বন্ডের সঙ্গে এক মাসে ৪৪ বার এবং নয়ন বন্ড আয়শার সঙ্গে ১৬ বার ফোনে কথা বলেছেন। এ ছাড়া অসংখ্যবার খুদে বার্তা চালাচালি করেছেন।

মিন্নি কারাগারে : বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে গ্রেফতার দেখিয়েছে পুলিশ। বর্তমানে পুলিশ হেফাজতে মিন্নি। হত্যা মামলায় রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ছয়জনের ফাঁসির আদেশের পরই মিন্নিকে হেফাজতে নেয় পুলিশ। বিষয়টি জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বরগুনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর মোস্তাফিজুর রহমান বাবু। তিনি বলেন, রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ছয়জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। রায় ঘোষণার পরপরই মিন্নিকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়। ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত সবাইকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

আদালতে নিরাপত্তা : বহুল আলোচিত বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা মামলার রায় ঘিরে বরগুনার আদালত প্রাঙ্গণ ও আশপাশের এলাকায় সকাল থেকে কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টনী গড়ে তুলেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অতিক্রম করে আদালতে প্রবেশ করতে হচ্ছে বিচারপ্রার্থীসহ সাংবাদিকদের। পাশাপাশি জেলাজুড়ে সতর্ক অবস্থানে ছিল পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
সকালে সরেজমিনে দেখা গেছে, আদালত প্রাঙ্গণ, প্রবেশপথ ও আশপাশের এলাকায় কড়া পুলিশি পাহারা বসানো হয়েছে। এরই মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের কয়েকজন আইনজীবীও হাজির হয়েছেন আদালতে। আদালতের ভেতরে সাদা পোশাক ও ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা টহল দিচ্ছেন। রায় ঘিরে বরগুনার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সজাগ দৃষ্টি রাখছে পুলিশ। জেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পুলিশের নিরাপত্তা চৌকি বসানো হয়েছে। এছাড়া র‌্যাব সদস্যদের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশও টহল দিচ্ছে বরগুনায়। তবে যাদের ঘিরে মামলার রায় সেই আসামিদের মধ্যে সবার আগে আদালতে হাজির হয়েছেন নিহত রিফাতের স্ত্রী ও এ মামলার অন্যতম আসামি আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। জামিনে থাকা মিন্নি সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে তার বাবার সঙ্গে মোটরসাইকেলে চড়ে আদালতে হাজির হন। একই সঙ্গে আদালত প্রাঙ্গণে হাজির হয়েছেন মিন্নির কয়েকজন স্বজনও।
যেভাবে সাক্ষী থেকে আসামি : রিফাত শরীফকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা ঘটনার ভিডিও প্রকাশের পর দেশজুড়ে বিষয়টি বেশ আলোড়িত হয়। এরপর এই হত্যা মামলাকে ঘিরে এ আলোচনাকে আরও জোরালো করেছে নিহত রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা ওরফে মিন্নি সাক্ষী থেকে আসামি হওয়ার ঘটনা। গত বছরের ২৬ জুন সকালে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে স্ত্রী আয়শার সামনে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা ঘটনার পর ২৭ জুন এ ঘটনায় রিফাতের বাবা আবদুল হালিম শরীফ ১২ জনের নাম উল্লেখ করে বরগুনা থানায় হত্যা মামলা করেন। এতে প্রধান সাক্ষী করা হয় আয়শাকে। মামলার প্রধান আসামি সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড ওই বছরের ২ জুলাই পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। নয়ন বন্ড নিহত হওয়ার পরপরই বদলে যেতে থাকে মামলার দৃশ্যপট। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এই হত্যায় আয়শাকে দায়ী করে বিভিন্নভাবে প্রচার শুরু হয়। মামলার ১৮ দিন পর ১৩ জুলাই এ হত্যাকান্ডে আয়শা জড়িত, এমন দাবি করে সংবাদ সম্মেলন করেন আয়শার শ্বশুর আবদুল হালিম শরীফ।

এরপর মামলার তদন্ত নাটকীয় মোড় নেয়। ১৬ জুলাই আয়শাকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে বাড়ি থেকে বরগুনা পুলিশ লাইনসে ডেকে নিয়ে গ্রেফতার করা হয়। তবে আয়শার বাবা মোজ্জামেল হোসেন শুরু থেকেই আয়শার গ্রেফতার এবং এ মামলায় তাকে আসামি করার ঘটনাকে প্রভাবশালী মহলের কারসাজি বলে দাবি করে আসছেন। এরপর নি¤œ আদালতে কয়েক দফা জামিন আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর উচ্চ আদালতে আয়শার পক্ষে জামিন আবেদন করেন উচ্চ আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আইখান পান্না। গত বছরের ২৯ আগস্ট বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আয়শাকে জামিন দেন। জামিন আদেশে বলা হয়, আয়শা তার বাবার জিম্মায় থাকবেন এবং গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না। এর ব্যত্যয় হলে জামিন বাতিল হবে। ওই বছরের ১ সেপ্টেম্বর জামিন স্থগিত চেয়ে আবেদন করেছিল রাষ্ট্রপক্ষ। আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর চেম্বার বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ‘নো অর্ডার’ দেন। এতে আয়শার জামিনের আদেশ বহাল থাকে। রায় ঘোষণার আগপর্যন্ত তার জামিন বহাল ছিল।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বরগুনা থানার তৎকালীন পরিদর্শক মো. হুমায়ুন কবির গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর ২৪ জনকে অভিযুক্ত করে প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্তবয়স্ক দুই ভাগে বিভক্ত করে আদালতে পৃথক দুটি অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ জন এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ জনকে আসামি করা হয়। প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির মধ্যে আয়শাকে এ মামলায় ৭ নম্বর আসামি করা হয়। এরপর প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিচার শুরু হয় জেলা ও দায়রা আদালতে। অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ আসামির বিচারকাজ চলছে শিশু আদালতে।

৩২ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রে ১৩ পৃষ্ঠায় আয়শার অপরাধের বয়ান ছিল। অভিযোগপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাকি ১৮ পৃষ্টায় অন্য আসামিদের অপরাধের বর্ণনা থাকলেও সেখানেও আয়শার ভূমিকার বর্ণনা করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে আয়শার অপরাধ বর্ণনায় বলা হয়েছে, ঘটনার পর আয়শা রক্তাক্ত রিফাত শরীফকে হাসপাতালে না নিয়ে নিজের ভ্যানিটি ব্যাগ ও জুতা খোঁজায় ব্যস্ত ছিলেন। অভিযোগপত্রে নয়ন বন্ড ও তার বাহিনী ০০৭এর নানা অপরাধ ও মাদক বাণিজ্যের উল্লেখ থাকলেও হত্যাকান্ডের কারণ হিসেবে আয়শাকে নিয়ে নয়ন বন্ড ও নিহত রিফাত শরীফের দ্ব›দ্বকে উল্লেখ করা হয়েছে। আর রিফাত শরীফ হত্যার পরিকল্পনায় আয়শা জড়িত ছিলেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

পরে পাওয়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, আয়শাই রক্তাক্ত রিফাত শরীফকে রিকশায় করে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। বরগুনা জেনারেল হাসপতালের সামনে লাগানো সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা ওই ভিডিওতে দেখা যায়, গত ২৬ জুন সকাল ১০টা ২১ মিনিটে আয়শা একাই একটি ব্যাটারিচালিত রিকশায় করে রক্তাক্ত ও অচেতন রিফাতকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে নিয়ে যান। সেখানে দাঁড়ানো এক যুবক রিফাত শরীফকে বহন করা রিকশার দিকে দৌড়ে আসেন। রিফাতের অবস্থা দেখে তিনি হাসপাতালের ভেতরে গিয়ে একটি স্ট্রেচার নিয়ে রিকশার পাশে আসেন। এ সময় সেখানে উপস্থিত অনেকেই এগিয়ে আসেন। এরপর রিকশা থেকে নামিয়ে অচেতন রিফাত শরীফকে স্ট্রেচারে করে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। এরপর আয়শা হাসপাতালের সামনে উপস্থিত একজনের ফোন নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলেন। এরপর তিনি হাসপাতালের ভেতরে যান। কিছু সময় পর আয়শার বাবা মোজাম্মেল হোসেন ও চাচা আবু সালেহ হাসপাতালে যান। সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে হাসপাতালের সামনে একটি অ্যাম্বুলেন্স আসে। এ সময় সেখানে রিফাত শরীফের বন্ধু মঞ্জুরুল আলম ওরফে জন ও তাঁর কয়েকজন বন্ধু হাসপাতালের সামনে আসেন। মঞ্জুরুল বেশ কিছু সময় ফোনে কথা বলেন। ১০টা ৪৪ মিনিটে অক্সিজেন ও ২টি স্যালাইন লাগানো অবস্থায় রিফাত শরীফকে স্ট্রেচারে করে ওই অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়। ১০টা ৪৯ মিনিটে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের প্রাঙ্গণ ত্যাগ করে অ্যাম্বুলেন্সটি।

জেলা পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, মিন্নিকে রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। যার মধ্যে প্রথমত মিন্নি তার স্বামী রিফাত হত্যার ঘটনায় সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। তাছাড়া মামলায় এজাহারভুক্ত দুই নম্বর আসামি রিফাত ফরাজী, তার ভাই তিন নম্বর আসামি রিশান ফরাজী, ছয় নম্বর আসামি রাব্বি আকন এবং ১২ নম্বর আসামি টিকটক হৃদয় আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মিন্নির সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন।

তিনি আরও জানান, রিফাত হত্যায় নয়ন বন্ডের সঙ্গে পরিকল্পনায় ছিলেন মিন্নি। ২৬ জুন ঘটনার দুই দিন আগে রিফাত শরীফ হেলাল নামে তার এক বন্ধুর মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেন। হেলাল রিফাত শরীফের বন্ধু হলেও নয়ন বন্ডের খুব ঘনিষ্ঠ। তাই ছিনিয়ে নেয়া মোবাইল ফোন উদ্ধারের জন্য নয়ন বন্ড দ্বারস্থ হয় মিন্নির।
নয়ন বন্ডের অনুরোধে হত্যাকান্ডের দুই দিন আগে রাতে সেই ফোন রিফাত শরীফের কাছ থেকে উদ্ধার করেন মিন্নি। কিন্তু এ ফোন উদ্ধার করতে গিয়ে রিফাত শরীফের মারধরের শিকার হন তিনি। পরে হত্যাকান্ডের আগের দিন নয়নের সঙ্গে দেখা করে মিন্নি সেই ফোন তার হাতে তুলে দেন। এ সময় মিন্নি তার স্বামী রিফাত শরীফের হাতে যে মারধরের শিকার হয়েছেন তার প্রতিশোধ নিতে বলেন নয়নকে। এরপর ওইদিন বিকেলে বরগুনা কলেজ মাঠের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে নয়ন বন্ড ও তার বাহিনীর সঙ্গে রিফাত শরীফকে মারধরের বিষয়ে সভা করেন মিন্নি। এছাড়া রিফাত শরীফ হত্যাকান্ডের আগে এবং পরে নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নির একাধিকবার মোবাইল ফোনে কথা হয়েছে।

ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, হামলার আগ মুহূর্তে রিফাত শরীফের সঙ্গে মিন্নি কলেজ থেকে বের হলেও পরিকল্পনা অনুযায়ী কলেজের সামনে তাকে মারধরের কোনো প্রস্তুতি দেখতে না পেয়ে সময়ক্ষেপণ করেন। এর জন্য মিন্নি রিফাত শরীফের বাধা উপেক্ষা করে আবার কলেজে প্রবেশ করেন। এর কিছুক্ষণ পরই নয়ন বন্ড বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য একত্রিত হয়ে রিফাত শরীফকে আটক করে মারধর করতে করতে কলেজের সামনের রাস্তা দিয়ে পূর্ব দিকে নিয়ে যায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী রিফাতকে মারধর করা হচ্ছে দেখে স্বাভাবিকভাবে হাঁটছিলেন মিন্নি। তবে পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে নয়ন বন্ড রিফাত শরীফকে মারধর শুরু করলে মিন্নি তখনই এগিয়ে আসেন।

প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে শত শত লোকের সামনে রিফাত শরীফকে (২৫) কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরে রিফাতকে কুপিয়ে হত্যার একটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়।



 

Show all comments
  • মোঃ দুলাল মিয়া ১ অক্টোবর, ২০২০, ১:৫৫ এএম says : 0
    মিন্নিকে আমি বিয়ে করবে মনে করছিলাম আর হলো না। ????
    Total Reply(0) Reply
  • Fariha Sultana Liza ১ অক্টোবর, ২০২০, ৪:১৮ এএম says : 0
    মিন্নি, তুমি নও মোটেও গিন্নি... তোমার জন্য দুটো ছেলের জীবন হয়ে গেছে শিন্নি, তুমি এমন এক নারী...যার মাঝে শয়তান কারি কারি
    Total Reply(0) Reply
  • Nusrat Fariha ১ অক্টোবর, ২০২০, ৪:১৮ এএম says : 0
    অসংখ্য ধন্যবাদ উচ্চ আদালত ও বিচার ব্যবস্থাকে, দ্রুত সময়ে মামলা নিষ্পত্তি করে রায় প্রদান করার জন্য। বিচার ব্যবস্থার সকল পর্যায়ে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করলে জনগণ আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থাশীল হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Adhora Rahman ১ অক্টোবর, ২০২০, ৪:১৯ এএম says : 0
    ৷ বাংলাদেশে এটা একটা যুগান্তকারী রায়। এ পর্যন্ত কোন মেয়ের মামলায় ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয় নাই। এখন দেখা যাক এটা কার্যকর হয় কি না। তবে আমার মতে অবশ্যই কার্যকর হওয়া উচিত। অপরাধী কে লিঙ্গভেদে দেখার সুযোগ নেই । মেয়ে বলে সাজা কমানো উচিতই না। সে তো ক্রাইম মেয়ে বলে কম করে নাই। ক্রাইম তো ঠিকি করেছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Syed Sawpon ১ অক্টোবর, ২০২০, ৪:১৯ এএম says : 0
    উচ্ছ আদালত যেন রায়ের অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায়, এই রায় বাস্তবায়ন করে এদেশের যুব সমাজকে একটা বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে একাধিক প্রেম ও পরকীয়া কি ভয়াবহতা ডেকে আনে!!
    Total Reply(0) Reply
  • HumaYun Kabir Biddut ১ অক্টোবর, ২০২০, ৪:২০ এএম says : 0
    সমাজে মিন্নি টাইপের খলনায়িকাদের জন্য এই রায় একটা মাইলফলক হয়ে থাকবে আশা করি।দ্রুত রায় কার্যকর করার আহবান জানাই।
    Total Reply(0) Reply
  • Ashish Pal ১ অক্টোবর, ২০২০, ৪:২১ এএম says : 0
    ধন্যবাদ সুষ্ট বিচার ব্যাবস্থা কে। এই রায়ের মধ্য দিয়ে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা হাজারো অমানুষ দের জন্য এটি একটি শিক্ষা...!!! বিচার ব্যবস্থার এখন পরিবর্তন হয়েছে সাবধান মিন্নির মতো অন্যান্য গিন্নিরা।
    Total Reply(0) Reply
  • AK Hira ১ অক্টোবর, ২০২০, ৪:২১ এএম says : 0
    একেই বলে ন্যায় বিচার। মিন্নিকে রক্ষা করতে গিয়ে কিছু কিছু মিডিয়া অনেক দালালী করেও ব্যর্থ হয়েছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Rian Adnan ১ অক্টোবর, ২০২০, ৪:২১ এএম says : 0
    যাক, বিচার বিভাগ আস্তে আস্তে জনগণের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে!!!! এভাবেই চলতে থাক। অপরাধী সাজা পাক। অপরাধ নিপাত যাক।।
    Total Reply(0) Reply
  • Fariya Islam ১ অক্টোবর, ২০২০, ৪:২২ এএম says : 0
    সব অন্যায়কারীর রায় এমন প্রাসঙ্গিক হলে ভালো হতো। সবার ক্ষেত্রে এমন সঠিক রায় দেওয়া যায় না -এটাই আমাদের ব্যর্থতা।
    Total Reply(0) Reply
  • Al Mamun Shamim ১ অক্টোবর, ২০২০, ৪:২২ এএম says : 0
    দ্রুত ৭ দিনের মধ্যে কার্যকর করার আইন করা হোক। আর আইন ধনী-গরীব সবার জন্য সমান, এটাও বাস্তবায়ন জরুরী। আইনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা উচিত।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মৃত্যুদণ্ড


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ