হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
কামরুল হাসান দর্পণ
১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এরশাদ সরকারের পতনের পর যখন সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় নির্বাচন হয়, তখন অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসবে। বিএনপি ক্ষমতায় আসবে, এমন চিন্তা দলটির সাধারণ সমর্থক এমনকি নেতা-কর্মীরাও ভাবেননি। তাদের ধারণা ছিল, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে, আর বিএনপি বৃহৎ বিরোধী দল হিসেবে সংসদে বসবে। এর মূল কারণ হচ্ছে, মাত্র নয়-দশ বছরের বিএনপি, যার ইউনিয়ন-উপজেলা কমিটি দূরে থাক, অনেক জেলা কমিটিই ঠিকমতো ছিল না। এমনকি জাতীয় নির্বাচনের মতো একটি নির্বাচনে দক্ষ, যোগ্য এবং পোড় খাওয়া প্রার্থী দেয়ার সক্ষমতাও ছিল না। ফলে ভঙ্গুর সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে দলটি ক্ষমতায় আসবে তা কেউ ভুলেও চিন্তা করেনি। এ বাস্তবতা মেনে নিয়েই দলটির নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা বিএনপি বিরোধী দলে বসবেÑ এমন মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছিল। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বহু বছরের পুরনো দল, যার আন্দোলন-সংগ্রামের ব্যাপক অভিজ্ঞতা ছিল। দেশব্যাপী সুদৃঢ় সাংগঠনিক শক্তি ছিল। দলে নেতা-কর্মীর ছিল ছড়াছড়ি। এসব হিসাব-নিকাশের ধারাবাহিকতায় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে অবধারিতভাবেই দলটি ক্ষমতায় আসবে, এটাই ছিল স্বাভাবিক চিন্তা। দলটির নেতা-কর্মীদের মনেও এমন আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ় মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। এমনকি নির্বাচনের আগে কীভাবে সরকার গঠিত হবে এবং কারা মন্ত্রিসভায় থাকবেন, এমন একটি ছায়া মন্ত্রিসভা গঠনের কথাও শোনা যায়। আওয়ামী লীগ যখন তিনশ আসনে প্রার্থীর জোয়ারে ভাসছিল, তখন বিএনপিকে তন্ন তন্ন করে প্রার্থী খুঁজতে হয়। প্রার্থী দিতে হবে বলে এমনসব প্রার্থী দেয়া হয়, যাদের অনেকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বলতে কিছু ছিল না। অনিবার্যভাবেই ধরে নেয়া হয়, নির্বাচনে বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগ জিতে আসবে এবং সরকার গঠন করবে। এ নিয়ে কারো মধ্যেই দ্বিধা-সংশয় ছিল না। নির্বাচন শেষে দেখা গেল, সবার ধারণা একেবারে তিনশ ষাট ডিগ্রি ঘুরে গেছে। নিঃসংশয় ও নিশ্চিত ধারণা ওলট-পালট করে বিএনপি নির্বাচনে জিতে যায়। এ এক বিস্ময় জাগানিয়া ঘটনা। ফলাফলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা অনেক নেতা বিএনপির নবিস প্রার্থীদের কাছে হেরে গেছে। এ কথাও তখন শোনা যায়, বিএনপির কলাগাছের কাছে আওয়ামী লীগের বটবৃক্ষ পরাজিত হয়েছে। নিশ্চিত বিজয় যখন হারে পরিণত হয়, তখন এর চেয়ে দুঃখ ও কষ্টের আর কিছু হতে পারে না। এই দুঃখ ও কষ্ট অনেক সময় ক্ষোভ ও ক্ষুব্ধতা সৃষ্টি করে। নির্বাচনের ফলাফলের পর আওয়ামী লীগের বক্তব্য-বিবৃতিতেও এই ক্ষুব্ধতা পরিলক্ষিত হয়। বিএনপির উদ্দেশে বলা হয়, একদিনও শান্তিতে থাকতে দেব না। আবার যে হারের আগে হেরে বসে থাকে এবং তার কল্পনাকে ছাড়িয়ে জিতে যায়, তখন তার মধ্যে আত্মম্ভরিতা ভর করাও অস্বাভাবিক নয়। বিএনপির মধ্যেও তা দেখা দেয়। তবে এ নির্বাচন একটি ইতিহাস সৃষ্টি করে এবং রাজনীতির গতিপ্রকৃতিই বদলে দেয়। দীর্ঘকাল ধরে আওয়ামী লীগের যে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিল, তাদের হটিয়ে বিএনপি হয়ে উঠে প্রধান প্রতিপক্ষ এবং দেশে দুটি ধারার রাজনীতির সূচনা হয়। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ঘুরেফিরে দুটি দলই ক্ষমতায় আসে। এর মাধ্যমে ভোটের হিসাব-নিকাশে আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি দ্রুত এগোতে থাকে। কখনো কখনো আওয়ামী লীগকে পেছনেও ফেলে দেয়। আওয়ামী লীগের তুলনায় অনেক নবীন একটি দল এভাবে পেছনে ফেলে দেবে, সমান সমান হবে বা সামান্য পিছিয়ে থেকে ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলবে, এটা রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা কল্পনাও করেননি। বলা বাহুল্য, এসব হিসাব-নিকাশ পুরোপুরি গড়ে দেয় দেশের জনগণ। বাস্তবতা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ও তার সমর্থকরা বিএনপিকে সেনা ছাউনিতে জন্ম নেয়া দল বলে যতই অপবাদ দিক না কেন, আওয়ামী লীগের কাছাকাছি বা সমান সংখ্যক ভোটার দলটিকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়নি। তারা বিএনপির জন্ম প্রক্রিয়া বিবেচনায় না নিয়ে কর্ম প্রক্রিয়াকে মূল্যায়ন করে দলটিকে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবেই দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
দুই.
এটা মানতেই হবে বিএনপি নামক দলটি এখন অনেক পরিণত এবং এর বিস্তৃতি তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। দলটির অনেক নবিস নেতাও জাতীয় পর্যায়ে চলে এসেছেন। বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবীদের প্লাটফর্ম একেকটি স্তম্ভ হয়ে সুদৃঢ় ভিত্তি দিয়েছে। দলের বিভিন্ন কমিটিতে ঠাঁই পাওয়ার জন্য নেতা-কর্মীর অভাব নেই। কমিটিতে জায়গা না পেয়ে বঞ্চিতদের ক্ষোভ ও হতাশার চিত্র নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই যে গত শনিবার বিএনপির ৫০২ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে, এ নিয়ে কিছু নেতা-কর্মীর মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা দেখা গেছে। এই চিত্র দলটির সুদৃঢ় অবস্থানকেই নির্দেশ করছে। দলে নেতা-কর্মীদের জায়গা দিতে নীতিনির্ধারকদের যথেষ্ট চাপ ও তাপ সহ্য করতে হয়েছে। এর মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হয়, প্রায় ৯ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা এবং শত দমন-পীড়ন ও নিঃশেষ করার প্রক্রিয়ার মধ্যেও দলটির প্রতি নেতা-কর্মীদের দরদ এতটুকু কমেনি। ক্ষমতার স্বাদ পেতে দল ত্যাগ করে ক্ষমতাসীন দলে ভেড়েননি। দলের প্রতি নেতা-কর্মীদের এই আনুগত্য ও টান নিশ্চিতভাবেই বিএনপির চলার পথে অনন্য প্রেরণা। যে দলে অনেক নেতার জায়গা দেয়া সম্ভব হয় না, সে দলকে কি বিনাশ করা যায়? এবারের কমিটিতে অনেক ত্যাগী নেতা বাদ পড়েছেন এবং অনেক নবিস জায়গা পেয়েছেন বলে পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। টেলিভিশনের টকশোগুলোতেও ধারাবাহিকভাবে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কোনো দলের কমিটি নিয়ে এত আলোচনা ও সমালোচনা আগে দেখা যায়নি। এ থেকে একটা বিষয় প্রতীয়মান হয়, বিএনপি নামক দলটিকে নিয়ে তার প্রতিপক্ষ এবং সমালোচকদের সুতীব্র আগ্রহ রয়েছে। ক্ষমতাসীন দল ও তার অনুগ্রহভাজনরা যতই তুচ্ছ্য-তাচ্ছিল্য করুক না কেন, মনেপ্রাণে যতই বিএনপির ধ্বংস কামনা এবং প্রক্রিয়া অবলম্বন করুক না কেন, তারা ভালো করেই জানে দলটিকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। বিএনপিই তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ। দেশের গণতন্ত্রের ভিতকে সুদৃঢ় করতে যে ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ অপরিহার্য, এক্ষেত্রে যে বিএনপির বিকল্প নেই, অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের তা মানতে হচ্ছে। প্রতিপক্ষ, কিছু মিডিয়া এবং টকশোজীবী বিএনপির কমিটি কেন এত বড় হলো এ নিয়ে বেশ হাস্যরস ও কটাক্ষ করেছেন। বড় কমিটি করে যেন বিএনপি মহা ভুল করে ফেলেছে। তারা এটা বুঝতে চান না, কত বড় কমিটি হবে তা একটি দলের নিজস্ব পলিসিগত ব্যাপার। আর কমিটি সব সময় ছোট বা একই রকম থাকবে, সম্প্রসারিত করা যাবে না, এমন কথা কি হলফ করে বলা যায়? সময়ের সাথে সাথে তো সবকিছু বদলায়, এটা মানতে অসুবিধা কোথায়? বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর জনসংখ্যা কত ছিল এবং জাতীয় বাজেটের আকার কী ছিল, এখন কত, এ বিষয়টির দিকে দৃষ্টি দিলেই তো বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। এখন যদি বাংলাদেশের বাজেট সেই সময়ের বাজেটের মধ্যেই পড়ে থাকে, তবে কি যুক্তিযুক্ত হবে? আমরা যদি সংবিধানের কথা বিবেচনা করি, সেখানেও তো সময়ের প্রয়োজনে সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন, পরিবর্তন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করা হয়েছে। মূল বিষয় হচ্ছে, সময় এবং প্রয়োজন। কাজেই বিএনপির কমিটি কেন এমন ‘ঢাউস’ হলো এ নিয়ে সমালোচনা যারা করেন, তারা হয় সময়কে ধারণ করেন না, না হয় প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। বিএনপির কমিটিতে নবীনদের ঠাঁই পাওয়া নিয়েও সমালোচনা রয়েছে। তার প্রতিপক্ষের কেউ কেউ বলছেন, এদের দিয়ে বিএনপি তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে না। তারা এটা বলতে চান না, বিএনপির এবারের কমিটি নবীনের তারুণ্য এবং প্রবীণের বুদ্ধির একটা সম্মিলন ঘটানো হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, যেসব তরুণ কমিটিতে যুক্ত হয়েছে, দলের নীতি ও আদর্শের প্রতি তাদের প্রগাঢ় আত্মিক টান রয়েছে। যদি না থাকত, তবে ক্ষমতার স্বাদ পেতে তারা ক্ষমতাসীন দলে চলে যেতে পারত। হ্যাঁ, যারা ত্যাগী তাদের অগ্রাধিকার পাওয়া এবং মূল্যায়ন হওয়া উচিত। এ কথাও মানতে হবে, বিশাল একটি দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মীর মধ্য থেকে কমিটি করতে গিয়ে কিছু ভুল-ত্রুটি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। অনেক ত্যাগী নেতাও বাদ পড়তে পারেন। ভালো ছাত্র যে সব সময় পরীক্ষায় ভালো করবে, এমন গ্যারান্টি দেয়া যায় না। তবে ভালো ফলাফল করে সে দ্রুত ফিরে আসতে পারে। যারা বাদ পড়েছেন, তারা যে ফিরে আসবেন না, এমন কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না। আবার এটাও যদি ধরা হয়, যারা বাদ পড়েন, তাদের বাদ পড়া জায়েজ করার জন্য নামের আগে ‘ত্যাগী’ শব্দটি জুড়ে দিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়, তবে তা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কমিটি ঘোষণার পর কিছু পত্র-পত্রিকা এমনভাবে সংবাদ পরিবেশন করেছে যেন বিএনপি থেকে অসংখ্য ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা বাদ পড়ে গেছেন। একেবারে সর্বনাশ হয়ে গেছে। সংবাদগুলোর শিরোনাম যতটা না বড় করা হয়েছে, পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে তত বড় ঘটনা ঘটেনি। যে দুয়েক জনের পদত্যাগের কথা বলা হয়েছে বা কাক্সিক্ষত পদ পাননি বলে ক্ষুব্ধতা ও হতাশার কথা বলা হয়েছে, বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রামে প্রত্যাশানুযায়ী তাদের ভূমিকা খুব একটা উল্লেখযোগ্য ছিল বলে দলটির সমর্থক ও নেতা-কর্মীরা মনে করেন না।
তিন.
বিএনপির ঘোষিত কমিটি নিয়ে ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। দলটির নেতারা মনে করছেন, বিএনপির এ কমিটি রাজনৈতিকভাবে কার্যকর হবে না। তারা বলেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো রাজনৈতিক দল এই প্রথম এত বড় কমিটি ঘোষণা করেছে। সেনাকুঞ্জে বেড়ে ওঠা দলটির মধ্যে কোনো সাংগঠনিক চর্চা না থাকায় এরকম হাস্যকর কমিটি করা হয়েছে। বিএনপির প্রধান প্রতিপক্ষের কাছ থেকে এ ধরনের প্রতিক্রিয়া আসা স্বাভাবিক। এটা রাজনীতিরই অংশ। যে কোনো প্রতিযোগিতামূলক খেলায় জেতার জন্য বা এগিয়ে যাওয়ার জন্য স্বাভাবিকভাবেই একপক্ষ আরেক পক্ষকে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে বা খেলার ধরন পাল্টে হারাতে চাইবে। এটা দোষণীয় কিছু নয়। দোষণীয় সেটাই, যখন খেলাটা আর খেলাসুলভ না হয়ে হানাহানির পর্যায়ে চলে যায়। তবে খেলোয়াড়রা যদি কৌশলী হয়, তারা প্রতিপক্ষের অখেলোয়াড়সুলভ আচরণকে ঠান্ডা মাথায় কৌশলে মোকাবেলা করেই খেলা এগিয়ে নিয়ে যায়। আবার প্রতিপক্ষের কাছ থেকে যদি বিদ্রুপাত্মক সমালোচনা আসে, তবে বুঝতে হবে দল সঠিক পথেই আছে। বলা আবশ্যক, বিগত কয়েক বছরে রাজনীতিতে বিএনপির কৌশলগত যেমন বেশ কিছু ভুল ছিল, তেমনি তাকে ভুলের ফাঁদে পা বাড়াতে প্রতিপক্ষও প্ররোচিত করতে সক্ষম হয়েছিল। এর ফলে বিএনপিকে অপরাধী সাব্যস্ত করে দমন-পীড়নেরও সুযোগ পায়। প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক কৌশলের কাছে বিএনপি মার খায়। প্রতিপক্ষ তার অপরাধ এত বড় করে উপস্থাপন করে যে, নেতা-কর্মীদের পিটিয়ে, হামলা-মামলা দিয়ে ঘরবন্দি বা ঘরছাড়া করতে সক্ষম হয়। এমন এক পরিস্থিতিতে দলটির ঘুরে দাঁড়ানোই কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ে। বিরূপ পরিবেশেই কনভেনশন করে এবং নতুন কমিটি ঘোষণা করে। বলা বাহুল্য, নতুন কমিটি নিয়ে চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ হবে, প্রতিপক্ষ তিরস্কার করবেÑ এটা স্বাভাবিক। বড় কথা হচ্ছে, দলটি তো বিচ্ছিন্ন অবস্থা থেকে একটি কাঠামোতে দাঁড়াল। এখন দেখার বিষয়, এ কমিটি কীভাবে কাজ করে এবং প্রতিপক্ষের বিদ্রƒপ ও সমালোচনার কতটা জবাব দেয়। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে কতটা ত্যাগী মনোভাব দেখায়। কমিটি ঘোষণার সময়ই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘অত্যন্ত ভাইব্রেন্ট ও ডায়নামিক’ একটি কমিটি হয়েছে। যেসব কোয়ালিটি একটি সংগঠনের জন্য প্রয়োজন, প্রত্যেকটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। দলের মহাসচিব হিসেবে এমন আশাবাদ ও প্রশংসা করা স্বাভাবিক। এটা কমিটিতে স্থান পাওয়াদের জন্য একটি মেসেজও বটে। মহাসচিবের এই আশার প্রতিফলন ঘটানোই নতুন কমিটির দায়িত্ব। তবে এ কথা অস্বীকার করা যাবে না, বিএনপিকে সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের অপতৎপরতা প্রতিপক্ষের তরফ থেকে বরাবরই ছিল। বিএনপি যাতে সংগঠিত হতে না পারে এবং বিশৃঙ্খল অবস্থায়ই থাকে, এমন ষড়যন্ত্রের কথা নিশ্চয়ই দলটির নেতা-কর্মীদের অজানা নয়। এসব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করা এখন নতুন কমিটির দায়িত্ব। কমিটি কতটা ঐক্যবদ্ধ রূপ দেখাতে পারে, তাই চ্যালেঞ্জের বিষয়। আমি পদ পেয়ে গেলাম, আমার আর কোনো দায়িত্ব নেইÑ এমন আত্মতৃপ্তি ও মনোভাব পোষণ করার অর্থই হচ্ছে, আকাক্সক্ষা সফল হতে দেয়া। নতুন নেতৃত্বকে এ বিষয়টি মনেপ্রাণে উপলব্ধি করতে হবে। বিএনপি সমর্থক ও সাধারণ মানুষ অন্তত এটুকু আশা করে, যে অসংগঠিত অবস্থা থেকে দলটি সংগঠিত হয়েছে, তাতে গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রাম কিছুটা হলেও বেগবান হবে। যদি বিগত দিনগুলোর মতো এমন হয়, প্রতিপক্ষের ভয়ে ঘর থেকে বের না হওয়া, পুলিশের হামলা-মামলা, জেল-জুলুম থেকে বাঁচার জন্য রাস্তা থেকে পালানো, তবে রাজনীতি করার কোনো অর্থ হয় না। রাজনীতি করতে হলে জেল-জুলুম এমনকি আহত-নিহত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েই করতে হবে। রাজনীতি করব অথচ এসবের মুখোমুখি হব না, বাংলাদেশে এমন ধারার রাজনীতির ইতিহাস নেই। এই ইতিহাস মাথায় রেখেই বিএনপির নতুন নেতৃত্বকে এগিয়ে যেতে হবে।
চার.
বিএনপির নতুন নেতৃত্বকে এ কথা মনে রাখতে হবে, তাদের দলটিকে প্রতিপক্ষ ‘নন্দঘোষ’ বা ‘কেষ্টা বেটা’য় পরিণত করেছে। যত অঘটন ঘটুক না কেন সব দোষ তার ওপরই বর্তায়। প্রতিপক্ষ তো বটেই তার অনুকূলের অধিকাংশ মিডিয়া এবং বুদ্ধিজীবীদের প্রধান টার্গেটেও বিএনপি। তারা পারলে এখনই বিএনপিকে দুমড়ে-মুচড়ে নিঃশেষ করে দেয়। অনেক সময় বিএনপির মূল প্রতিপক্ষের প্রতি অভিমান করে এমন কথাও আড়েঠাড়ে বলে, কেন বিএনপিকে বিতাড়িত করা হচ্ছে না। কেন মুসলিম লীগের মতো নামকাওয়াস্তে দলে পরিণত করতে পারছে না। আবার অনেক টকশোজীবী আছেন, যাদের মূল টার্গেটই থাকে বিএনপির সমালোচনা করা। কারণ বিএনপিকে তুলাধোনা ও সমালোচনা করলে তাদের রোষানলে পড়তে হবে না। বরং সরকারের সমালোচনা করলে টকশো থেকে বাদ পড়াসহ নানা হয়রানির শিকার হতে হবে। টকশো থেকে দৈনিক আয়ও বন্ধ হয়ে যাবে। বিএনপি হচ্ছে, তাদের সমালোচনা ও কটাক্ষ করার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। অনেকটা তীরন্দাজের ‘ডার্ট বোর্ড’ বা তীর ছোঁড়ার বোর্ডের মতো যে বোর্ডে তীর ছুঁড়লে তার প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না বা বোর্ড ‘হিট ব্যাক’ করতে পারে না। রাজনীতি ও কথাজীবীদের এমন এক ‘হোস্টাইল’ পরিবেশের মধ্যেই বিএনপি রয়েছে। বিএনপির নতুন নেতৃত্বকে এ পরিস্থিতি বুঝতে হবে এবং বুঝে তাদের এগিয়ে যেতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে, দেশ ও জাতি এবং উন্মুক্ত গণতন্ত্রের প্রয়োজনে তাদের ভূমিকা পালন করতে হবে। শুধু পদ-পদবির আনন্দে আত্মহারা হলে চলবে না। এই পদ-পদবির মর্যাদা ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে দলের আদর্শ ও কর্মসূচি নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে যেতে হবে। তাদের লক্ষ্য পূরণে মানুষকে কনভিন্স করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।