পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
বোনের বিয়ের সময় যৌতুকের টাকা সুদের ওপর চেক বন্ধক দিয়ে ৮০ হাজার টাকা কর্জ নেন বগুড়ার কলেজ শিক্ষক রওশন আরা। বিপরীতে ১১ লাখ টাকা পরিশোধ করলেও শেষ হয়নি তার ৮০ হাজার টাকা। একটি চেকে ১২ লাখ টাকা আরেকটি চেকে ১৬ লাখ টাকা বসিয়ে এনআই অ্যাক্টে একতরফা রায় করিয়ে নেন কথিত চেকের বাহক। এ চেকের মামলায় গ্রাহকের স্বহস্তে নাম, ঠিকানা ও টাকার পরিমাণ লেখা না থাকলেও একতরফাভাবে অ্যাকাউন্ট মালিকের বিরুদ্ধে রায় হয়। জেলে যেতে হয় রওশন আরাকে।
ছেলের ইঞ্জিয়ারিং ভর্তির জন্য ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা ধার নেন এক পিতা। বিপরীতে স্বাক্ষর করা একটি ব্ল্যাংক চেক বন্ধক রাখেন। যথাসময়ে এ টাকার সুদ দিতে না পারায় স্বাক্ষরকৃত চেকে ১৮ লাখ টাকা বসিয়ে চেকটি ‘বাউন্স’ করায় কথিত পাওনাদার। পরে গোপনে মামলা ঠুকে দেন তিনি। চেক ইস্যুকারীকে ‘পলাতক’ দেখিয়ে একতরফাভাবে রায় হয়ে যায়। আকস্মিক এ খবর জানতে পেরে স্ট্রোক করেন চেক ইস্যুকারী। শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচানো যায়নি।
বগুড়ার এক মানবাধিকার কর্মী আঞ্জু আরা শাহজাদী। একটি হত্যা মামলার তদবির করায় ক্ষিপ্ত আসামিপক্ষ তাকে হুমকি দেয়।এক পর্যায়ে বাড়ি-ঘর লুট করে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র নিয়ে যায়। এর মধ্যে ছিলো চেক বই ও স্বাক্ষর করা অব্যবহৃত কয়েকটি ব্ল্যাংক চেক। বাড়িঘর লুট হওয়ার ঘটনায় আদালতে ২০১৫ সালে মামলা হয়। সমন জারি হয়। আসামিরা জামিনে বেরিয়েই ২০১৬ সালে বাদী শাহজাদী আঞ্জু আরার বিরুদ্ধে ঠুকে দেয় এন আই অ্যাক্টে পৃথক দুটি মামলা। চার বছরের আইনি লড়াইয়ে হেরে যান যান শাহজাদী। তার বাড়ি লুণ্ঠনের মামলার বিচার না হলেও লুণ্ঠিত চেকের মামলায় এখন তিনি জেলের ঘানি টানছেন বলে জানা গেছে।
নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রমেন্ট অ্যাক্টে (এনআই অ্যাক্ট) দায়েরকৃত চেক ডিজঅনার মামলার এমন হাজারো কাহিনীর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত দেয়া সম্ভব। ন্যায়ানুগ পাওনাদার না হওয়া সত্তে¡ও যেনতেন প্রকারে স্বাক্ষরিত একটি চেক হাতিয়ে মামলায় ফাঁসানোর ঘটনা ঘটছে অহরই। একতরফা রায়ও ঘোষিত হচ্ছে বহু। বলা হয়ে থাকে, ফৌজদারি আইনে এনআই অ্যাক্টে দায়েরকৃত চেক ডিজঅনার মামলাই একমাত্র মামলা যেটির বিচার হচ্ছে তদন্ত ছাড়াই। আদান-প্রদানের নেপথ্য ঘটনা উদঘাটন না করে শুধুমাত্র চেকে স্বাক্ষরে দায়ে শাস্তি হয়ে যাচ্ছে অবধারিতভাবে।
এ কারণে ভুক্তভোগী এবং আইনজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলেন, ব্যাংকের নীতিমালায় চেক সম্পর্কিত সংশ্লিষ্ট সংশোধনী হওয়ার জরুরি। বিশেষতঃ গ্রাহকের স্বহস্তে লেখা নাম, টাকার পরিমাণ স্বহস্তে লিখিত চেক হাত বদলে আইনগতভাবে কার্যকর করা। নয়তো হাত বদল হওয়া চেকের কোনো মামলা আদালতের গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ, বৈধ পাওনাদারকে চেক প্রদান ছাড়াও নানাভাবে এক ব্যক্তির চেক অন্য ব্যক্তির হস্তগত করতে পারেন। চেক চুরি যেতে পারে। ছিনতাই কিংবা হারিয়ে যেতে পারে। লুন্ঠনও হতে পারে।
এসব চেক হস্তগত করে ইচ্ছেমতো অংক বসিয়ে দায়ের হতে পারে এনআই অ্যাক্টের মামলা। সে ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনে চেকের বৈধ প্রাপক, বৈধ ইস্যুকারী ইত্যাদি বিষয়গুলো আদালতের বিবেচনায় আনার সুযোগ ছিলো না। কিন্তু গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের দেয়া একটি রায় বদলে দিয়েছে চেকের মামলার এমন হিসেব-নিকেশ। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে এ দেন আপিল বিভাগীয় বেঞ্চ।
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল নিষ্পত্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় যে,এখন থেকে এনআই অ্যাক্টে দায়েরকৃত চেক ডিজ অনার মামলায় চেকের ‘বৈধ বিনিময়’ প্রমাণ করতে হবে। প্রমাণে ব্যর্থ হলে আসামিকে কোনো সাজা দেয়া যাবে না।
মামলার সংশ্লিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মাসুদ বলেন, ২০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের মধ্য দিয়ে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত এলো। চেকের বৈধ বিনিময় প্রমাণে ব্যর্থ হলে এ সংক্রান্ত মামলায় কোনো ব্যক্তিকে সাজা দেয়া যাবে না। অর্থ্যাৎ চেক ডিজঅনার মামলায় কনসিডারেশন বা চেক প্রাপ্তির বৈধ কারণ প্রমাণ করা বাধ্যতামূলক। ফলে যেনতেন প্রকারে চেক হস্তগত করে মামলা দায়ের এবং নিরীহ মানুষকে জেল-জরিমানা করার প্রবণতা কমে আসবে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন,এ রায় কার্যকর হলে বদলে যেতে পারে চেক ডিজঅনারের বহু মামলার।
আইনমন্ত্রণালয়স সূত্র জানায়, ১৮৮১ সালে প্রণীত হয় ‘নোগোশিয়েবল ইনস্ট্রমেন্ট অ্যাক্ট’ বা এনআই অ্যাক্ট। মূল এই আইনটি ১৯৯৪ সাল, ২০০০ এবং সর্বশেষ ২০০৬ সালে সংশোধন হয়। তবে এসব সংশোধন আইনের মৌলিক কাঠামোয় পরিবর্তন আনেনি। ১৯৯৪ সালের সংশোধনীতে নোটারি পাবলিকের বিষয়টি বাদ দিয়ে চেক বাউন্সের বিধানগুলো প্রতিস্থাপন করা হয়। নোটারি পাবলিক নিয়োগের বিধানসংবলিত আইনটির ১৭ নম্বর ধারাটি প্রতিস্থাপন করা হয় চেক ধারাগুলোর মাধ্যমে। প্রতিস্থাপিত ১৩৮ ধারায় বলা হয়েছে, অর্থ না থাকা বা অন্য কোনো কারণে চেক বাউন্স বিষয়ে মামলা হলে চেকদাতার (আসামির) এক বছর কারাদন্ড ও চেকের অঙ্কের দ্বিগুণ পরিমাণ পর্যন্ত অর্থ জরিমানা হবে। ২০০০ সালের সংশোধনীতে চেকে উল্লিখিত অর্থের তিনগুণ পর্যন্ত অর্থদন্ডের বিধান যুক্ত করা হয়। ২০০৬ সালে সংশোধন করে বলা হয়, আপিল করতে হলে জরিমানার অর্ধেক টাকা জমা দিয়ে আপিল করতে হবে।
সুপ্রিমকোর্ট বারের আইনজীবী আকবর আমীন বলেন, সংশোধনীগুলো আইন এবং প্রায়োগিক বাস্তবতার গভীর গবেষণালব্ধ নয়। দেশের সাম্প্রতিক আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন নেই এতে। আইনটির বাস্তবসম্মত সংশোধন প্রয়োজন। যেমন ধরুন, বিচারকালে চেকে শুধু অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের স্বীয় স্বাক্ষরটির সঠিকতা যাচাই করা হয়। এখানে স্বাক্ষরের পাশাপাশি অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের স্বহস্তে লেখা বৈধ প্রাপকের নাম, টাকার পরিমাণ উল্লেখ বাধ্যতামূলক করার দরকার।
এছাড়া চেক ব্যবহার ও বিনিময়ের বিধিমালা থাকা দরকার। না হলে বৈধ পাওনাদারকে চেক প্রদান ছাড়াও নানাভাবে এক ব্যক্তির চেক অন্য ব্যক্তির হস্তগত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। স্বাক্ষরকৃত চেক চুরি, ছিনতাই কিংবা ডাকাতি হতে পারে। হারিয়ে যেতে পারে। হস্তগত এসব চেকে ইচ্ছেমতো অংক বসিয়ে এনআই অ্যাক্টে মামলা ঠুকে দেয়া যেতে পারে। কিন্তু বিদ্যমান আইনে চেকের বৈধ প্রাপক, বৈধ ইস্যুকারী ইত্যাদি বিষয়গুলো আদালতের বিবেচনায় আনার সুযোগ নেই।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মহাপরিচালক হিসেবে অবসরে যাওয়া সিনিয়র জেলা জজ মো. মাইদুল ইসলামের মতে, ১৮৮১ সালের এনআই অ্যাক্টের ১৩৮ ধারাটি বহুল প্রয়োগ দেখা যায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে। ঋণ আদায় করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ গ্রহিতা কিংবা গ্রাহকের সঙ্গে বড় ধরনের প্রতারণা করছে। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায় দীর্ঘদিন ধরে চলা চেক ডিজঅনার মামলার বিচারে অনেক পরিবর্তন আনবে বলে মনে হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের একেকটি রায়ই অনুসরণযোগ্য আইন।
এদিকে জাতীয় আইন কমিশন সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বরে নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্টের বেশ কিছু সংশোধনী আইন মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠায় আইন কমিশন। নিরীহ, নিরপরাধ মানুষের হয়রানি রোধে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে সংশোধনীর সুপারশটি পাঠানো হয়। ৩ বছর হতে চললেও সেই সংশোধনী উদ্যোগের অগ্রগতি নেই। তবে সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়ে আইনটি সংশোধনে সহায়ক হবে বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।