বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.) যখন শাষন ক্ষমতায় তখন প্রতিবছর হজ্জের সময় তিনি তার রাষ্ট্রের গভর্নর ও সিনিয়র কর্মকর্তাদের ডেকে পাঠাতেন। হজ্জের সময় সমবেত জনতার সামনে তিনি উন্মুক্ত আদালত বসাতেন। রাষ্ট্রের যে কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ তুলতে পারতো। সাথে সাথে তিনি জনগণের সামনে এর প্রতিকার করতেন। কাউকে বরখাস্ত করতেন। কাউকে শাস্তি দিতেন। অনেককে জনগণের ওপরকৃত নির্যাতনের বদলা ভুক্তভোগীদের হাতে পাইয়ে দিতেন।
একবার গভর্নরদের বৈঠকে কয়েকজনের বিরুদ্ধে অসদাচরণের বিচার করলেন তিনি। তার ন্যায় বিচার ও জনগণের প্রতি সযত্ম দৃষ্টি দেখে গভর্নর ও কর্মকর্তারা ভয়ে তটস্থ। জনগণকে সেবা থেকে বঞ্চিত করা, তাদের প্রতি জুলুম, নিজে কোনো সুবিধা ভোগ করা, অফিস বিংবা বাসভবনে জনগণ বা ফরিয়াদী ব্যক্তির সহজে পৌঁছার ক্ষেত্রে কোনোরূপ বাধার সৃষ্টি, নিরাপত্তার নামে জনগণ থেকে দূরে থাকা, এসব নিয়ে বিচার বসত।
এ বৈঠকে বাহরাইনের গভর্নর হযরত আবু হুরায়রা (রা.) ছিলেন। এ মহান সাহাবীর বিষয়ে কারও কোনো অভিযোগের প্রশ্নই ছিল না। এরপরও খলিফা হযরত ওমর (রা.) তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, নিয়োগের আগে তো তুমি খুব কায়ক্লিষ্ট ছিলে। পদ পাওয়ার পর এ ক’দিনেই কেমন যেন হৃষ্টপুষ্ট হয়ে গেছো, ব্যাপার কি? মনে খুব শান্তি? না খুব সুখে আছো? বাহরাইনের সব জনসাধারণ কি তোমার মতোই?
জবাব দিতে গিয়ে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) রীতিমতো কাঁপছিলেন। বিনয়ের সাথে বললেন, না আমিরুল মোমিনীন, আপনি যা ভাবছেন তেমন কিছু নয়। আমি নিশ্চিন্ত নই, সুখেই নেই। আপনার নীতি অনুসরণ করে রাতদিন জনগণের জন্য কাজ করছি। আমার স্বাস্থ্যগত সামান্য যে পরিবর্তন, তার কারণ দু’টি। একে তো আমার বয়স হচ্ছে, সামান্য ভারী হচ্ছি। আর বাহরাইন তুলনামূলক স্বাস্থকর এলাকা। আবহাওয়া পরিবর্তনে ও বয়স বৃদ্ধির ফলে আমাকে হয়তো আগের তুলনায় হৃষ্টপুষ্ট দেখাচ্ছে। আমি কোনো অনিয়ম করিনি। হযরত ওমর (রা.) তার কৈফিয়ত গ্রহণ করলেন।
আরেকবার তিনি শুধু খবর পেয়েছিলেন যে, মিশরের গভর্নর তার বাড়িতে নিরাপত্তারক্ষী বসিয়েছেন। দরবার ঘরের সামনে ফটক নির্মাণ করেছেন। কোনো ব্যাখ্যা তলব না করেই রাজধানী মদিনা থেকে তার বিশেষ বার্তাবাহক প্রেরণ করেন। বলে দেন, প্রথম গিয়েই নিরাপত্তারক্ষীদের হটিয়ে দেবে এবং ফটকটি জ্বালিয়ে দেবে। এরপর কৈফিয়ত তলব করবে গভর্নরের কাছে। জনগণকে কেন ভয় পাও। এমন পরিবেশ কেনো তৈরি করছো না যে, তারাই তোমাকে পাহারা দেয়। নিজের সেবাগ্রহীতা মানুষ থেকে আত্মরক্ষার জন্য কেন নিরাপত্তারক্ষী বসাতে হয়। সৈন্যরা তো সীমান্ত রক্ষা জিহাদের জন্য। গভর্নরকে পাহারা দেয়ার জন্য নয়। বিচারপ্রার্থী ও সমস্যাগ্রস্ত মানুষ যখন প্রয়োজন তখন তোমার কাছে আসবে, তাহলে তোমার কর্মস্থলে বাধার ফটক কেন? বার্তাবাহককে বললেন, উপযুক্ত কৈফিয়ত দিতে পারলে সে বহাল থাকবে। না হলে তাৎক্ষণিকভাবে তাকে বরখাস্ত করে বিকল্প গভর্নর নিয়োগ দিয়ে দেয়া তোমার দায়িত্ব।
গভর্নরসহ সকল কর্মকর্তা রাষ্ট্রনায়ক হযরত ওমরের কঠোর তদারকিতে থাকতেন। একবার নবী করিম (সা.)-কে তার প্রশাসনের জনৈক কর্মকর্তা বলেছিলেন, এসব সম্পদ জনগণের দেয়া যাকাত ও সাধারণ দানের। আর সামান্য কিছু দেখিয়ে বললেন, আর এগুলো জনগণ আমাকে উপহার দিয়েছে। নবী করিম (সা.) তখন বললেন, তুমি আমার নিয়োগ থেকে অবসর নিয়ে সেখানে গিয়ে দেখ, কেউ তোমাকে কিছু দেয় কি না? এসব তোমার নয়, তোমার পদের। এসবও রাষ্ট্রের কোষাগারে জমা দাও। এ ঘটনা থেকে দায়িত্বশীলদের উপহার রাষ্ট্রের তহবিলে যাওয়ার নিয়ম চালু হয়।
একবার এমন এক কর্মকর্তাকে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে তার আগের অবস্থায় রাস্তায় বলেছিলেন নবী করিম (সা.)। আল্লাহার রাসূল (সা.)-এর এবং তার নীতি ও আদর্শের ওপর পরিচালিত রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আল্লাহর ভয় ছিল অনিয়ম ও দুর্নীতি থেকে বাঁচার মূল চাবিকাঠি। শাসকগণের কঠোর তদারকি, জনগণের স্পষ্ট পক্ষপাতিত্ব এবং কর্মকর্তাদের অন্তরে আল্লাহর ভয় তৈরির পাশাপাশি জনসম্মুখে কঠোর জবাবদিহিতা ও উপস্থিত বিচার ছিল ইসলামী শাসনযুগের সৌন্দর্য্য। আজকের বিশে^ও শতভাগ জুলুম-দুর্নীতি-অনিয়ম মুক্ত সমাজ রাষ্ট্র ও পরিবেশ নির্মানে ইসলামের আদর্শ এবং প্রকৃত খোদাভীতি চর্চার বিকল্প নেই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।