বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
মানুষের প্রাণ আল্লাহ প্রদত্ত, এর মালিকও তিনি। তার যখন ইচ্ছা, তখন তিনি তা হরণ করেন। মানুষকে তার প্রাণ অন্যায়ভাবে হরণ করার অধিকার দেয়া হয়নি, বরং প্রাণ রক্ষা করার যাবতীয় অধিকার দেয়া হয়েছে। এ কারণে হাদীসে মৃত্যুর কামনা করতেও নিষেধ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে হজরত জাবের (রা.) বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মৃত্যু কামনা করবে না, কেননা প্রাণ হরণের ভীতি ও ভয়াবহ তা অত্যন্ত কঠিন এবং এ বিষয়টি সৌভাগ্যের অন্তর্ভুক্ত। কেননা এতে বান্দার বয়স বেশি হয় এবং আল্লাহতাআলা বান্দাকে তার আনুগত্যের দিকে প্রত্যাবর্তন করেন।’ (আহমদ)।
‘সাকরাত’ অর্থ মৃত্যুর বিভীষিকা, বান্দার জন্য অতি কঠিন সময়। ঈমান ও তওবার সাথে এ কঠিন সময় অতিক্রম করতে পারলে মৃত্যু সফল হয়। জীবনকে ধ্বংস না করে জীবিত থাকলে নির্ধারিত সময় বান্দা দীর্ঘায়ু লাভ করার সুযোগ লাভ করে এবং পূণ্যের বহু কাজ করে সৌভাগ্যের অধিকারী হতে পারে।
হজরত আবু হোরায়রা (রা.) বলেন, রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মৃত্যু কামনা করবে না। নেক হলে আশা করা যায় নেকি অধিক হবে, আর যদি বদ (মন্দ) হয় তাহলে সম্ভবত; মন্দ হতে তওবা করা নসিব হবে।’ (বোখারী)
হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো বিপদে বিচলিত হয়ে মৃত্যু কামনা করবে না, যদি একেবারেই বাধ্য হও তাহলে এই দোয়া পড়বে, হে আল্লাহ! আমাকে সে সময় পর্যন্ত জীবিত রাখ, যতক্ষণ পর্যন্ত জিন্দেগী আমার জন্য কল্যাণকর হয় এবং আমাদের জন্য যদি মৃত্যুই শ্রেয় হয় তাহলে আমাকে মৃত্যু দান কর।’ (বোখারী)
উম্মুল মোমেনীন হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, একদিন রসূলুল্লাহ (সা.) মিম্বরে খুৎবা দান কালে বলেন, ‘হে লোকসকল! তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি রাত যাপন করবে না, কিন্তু মৃত্যুকে এতই নিকটবর্তী মনে করবে যে, যেন তা দুই চোখের সামনে।’ (তিবরানী, সংক্ষিপ্ত)
একটি ঘটনা। হজরত ইমাম জাফর সাদেক (রা.) ইবনে মোহাম্মদ আল বাকের (রা.) তার পিতার কাছ থেকে বর্ণনা করেন যে, একবার ‘মালাকুল মওত’ (মৃত্যুর ফেরেশতা)-কে রাসূলুল্লাহ (সা.) এক আনসারী সাহাবীর শিয়রে দেখে বললেন, ‘আমার সাহাবীর ব্যাপারে সদয় আচরণ করবেন, কেননা সে মোমেন।’ ফেরেশতা জবাবে বলেন; ‘আমি প্রত্যেক মোমেনের সাথে সদয় আচরণ করে থাকি। অনুরূপভাবে আমি সকল গৃহবাসীর নিকটে গিয়ে রোজ পাঁচবার পর্যবেক্ষণ করি, আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত আমি রূহ কবজ (প্রাণ হরণ) করতে সক্ষম হই না।’ হজরত জাফর ইবনে মোহাম্মদ বলেন, ‘আমি জেনেছি, মৃত্যুর ফেরেশতা নামাজের সময়গুলোতে পর্যবেক্ষণ করে থাকেন।’
ওপরে বর্ণিত হাদীস ও বিবরণীতে মৃত্যু কামনা না করার এবং প্রতি ওয়াক্ত নামাজের সময় ‘মালাকুল মওত’-এর পর্যবেক্ষণের কথা বলা হয়েছে। মৃত্যুর ফেরেশতা তো সময়মত প্রাণ হরণ করার জন্য নিয়োজিত, আত্মহত্যা করে পাপী হওয়ার প্রয়োজন কি?
এ কথা সত্য যে, যার মধ্যে হত্যা করার প্রবণতা বিদ্যমান, সে অনায়াসে আত্মহত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করে না। তখন তার কাছ থেকে মানবতা বোধ লোপ পেয়ে যায়। এ লোপ পেয়ে যাওয়াটা শয়তানি প্ররোচনারই ফল। এরূপ কান্ডজ্ঞানহীন মানবতাবিরোধী কর্মকান্ড ঘটাতে শয়তানের কোনো জুড়ি নেই। মানুষের মধ্যে গজব তথা (গোস্সা-রাগ) ক্রোধ জন্মে, তার জ্ঞান দুর্বল হয়ে যায়, তখন শয়তান ক্রোধান্বিত ব্যক্তির সাথে এমনভাবে খেলা করে যেমনি শিশুরা বল-মার্বেল নিয়ে খেলা করে। সুতরাং, ক্রোধ দমন করার সহজ উপায় হলো ওজু করা। এ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘গজব অর্থাৎ ক্রোধ শয়তানের পক্ষ হতে এবং শয়তান আগুন দ্বারা তৈরি এবং আগুন কেবল পানিদ্বারা নির্বাপিত করা সম্ভব। সুতরাং, যখন তোমাদের মধ্যে কারো ক্রোধ হয় তখন ওজু করবে।’
(আবু দাউদ)
আত্মহত্যার প্রবণতা ক্রোধের একটি অবস্থা, এ সময় ওজু করলে ক্রোধ থাকবে না। আত্মহত্যার ধর্মীয় দিক সম্পর্কে বর্ণিত বিবরণ হতে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, এ মহাপাপে লিপ্ত করার জন্য শয়তান লেগেই আছে। তাই শয়তানকে এ পাপকাজে প্ররোচিত করা হতে দূরে রাখতে হলে হাদীসে বর্ণিত বিভিন্ন দোয়া পাঠ করার কথা খোদ রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন। কেননা শয়তানকে বিতাড়িত করতে হলে আল্লাহর জিকির একান্ত জরুরি। শয়তানকে দমন করার প্রসিদ্ধ এবং সংক্ষিপ্ত দোয়াটি হচ্ছে এই, ‘লা-হাওলা ওয়া লা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আজীম’। অথবা ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম।’
রাগ-ক্রোধ-আক্রোশ-হিংসা ইত্যাদি অনৈতিক আচার-আচরণ তথা নৈতিক অবক্ষয়ের লক্ষণ। আত্মহত্যা এসব মারাত্মক পাপের কারণ হয় এবং হত্যা-আত্মহত্যা ছাড়াও নানা ঘৃণ্য অপরাধে লিপ্ত হতে মানুষ সঙ্কোচবোধ করে না। তাই ইসলামের অনুশাসনগুলোর মধ্যে নিহিত রয়েছে সর্ব প্রকারের মানব কল্যাণ ও নৈতিক উন্নয়ন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।