বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
বাংলাভাষায় ব্যাপকভাবে প্রচলিত একটি শব্দ, আত্মহত্যা। এর মূল ফার্সি হচ্ছে ‘খোদ কুশি’, যা উর্দুতেও স্থায়ীভাবে স্থান করে নিয়েছে। পবিত্র কোরআনে সূরা ‘কাওসারে’ বলা হয়েছে: ‘ফাসাল্লিলি রাব্বিকা ওয়ানহার’। অর্থাৎ নামাজ পড়–ন আপনার প্রভুর জন্য এবং কোরবানি করুন। এখানে আমাদের আলোচনা ‘নহর’ শব্দ নিয়ে।
আরবিতে বলা হয় ‘নাহারা’/‘ইয়ানহারু’, অর্থাৎ সে কোরবানি করেছে বা করবে। শাব্দিক অর্থে ‘নাহরুন’ বলা হয় উটের গলায় বর্ম বা ছুরি দিয়ে জবাই করা বা সামনা সামনি করা। এর বহুবচন ‘নুহুর’। বলা হয়‘ ইয়াওমুন নুহুর বা ইয়াওমুন নাহ্রে। অর্থাৎ হজ্জ্বের সময় কোরবানির দিন ১০ জিলহজ্জ্ব। ‘নাহরুন’ শব্দটির রূপান্তরিত বহুদিকের মধ্যে একটি হচ্ছে ‘ইন্তেহার’। এর আভিধানিক অর্থ হলো আত্মহত্যা করা, একে অপরের গলা চিপে ধরা, লাঠিদ্বারা প্রহার করা ইত্যাদি। আধুনিক আরবিতে আত্মহত্যা করার অর্থ ‘ইন্তেহার’ ব্যাপকভাবে প্রচলিত।
এ সংক্ষিপ্ত তাত্তি¡ক পটভ‚মিকার আলোকে আত্মহত্যার নানা দিক আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করব। কেননা আত্মহত্যা কেবল আমাদের জাতীয় সমস্যা নয়, আন্তর্জাতিকভাবে একটি জটিল সমস্যাও বটে। যেহেতু আত্মহত্যা কোনো জাতি বিশেষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, জাতি-সম্প্রদায় নির্বিশেষে তা সারা বিশ^বাসীর জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক অসমাধানযোগ্য সমস্যারূপে আবহমানকাল হতে বিদ্যমান। এর বিজ্ঞানভিত্তিক কোনো সুরাহা করা সম্ভব হয়েছে বলেও দাবি করার উপায় নেই। এমনকি, ইতিহাসে বিভিন্ন বিজ্ঞানী, মনীষীর আত্মহত্যা করে প্রাণ বিসর্জন দেয়ার দুঃখজনক ঘটনারও অভাব নেই।
মুসলমান হিসেবে আত্মহত্যার মূল কারণগুলো চিহ্নিত করতে হলে ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন না করে গত্যন্তর শেষ নেই। দুনিয়ার সমস্যাবলির মধ্যে আত্মহত্যা কেবল একটি জটিল সমস্যা নয়, ইসলামের দৃষ্টিতে মহাপাপও বটে। এ পাপ হতে আত্মরক্ষার বাস্তব উপায়ও ইসলাম বাতলে দিয়েছে। এ পর্যায়ে প্রথমে আমরা ইতিহাস হতে কিছু দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে চাই, যাতে আত্মহত্যার স্বরূপ স্পষ্ট হয়ে উঠবে। যেহেতু আমাদের আলোচনার মূল বিষয় আত্মহত্যার গর্হিত পাপ রূপটি ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিশ্লেষণ করা। এ ক্ষেত্রে আমরা ‘ওহোদ’ যুদ্ধে সাইয়্যুদুশ শোহাদা হজরত আমির হামজা (রা.)-এর হত্যাকারী ওয়াহশীর ইসলাম গ্রহণের পর শেষ জীবনে আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যুবরণ এবং হজরত উমর (রা.)-এর ওপর প্রাণঘাতী হামলাকারী কুখ্যাত ফিরুজ আবু লুলুর আত্মহত্যার কাহিনীর কথা স্মরণ করতে চাই। দুটি ঘটনাই ইতিহাসখ্যাত, সকলের জানা।
ইমলামী ইতিহাসে দ্বিতীয় যুদ্ধ ‘ওহোদ’ সংঘটিত হয় হিজরি তৃতীয় সালে। কাফেরদের সাথে এ যুদ্ধে রসূলুল্লাহ (সা.)-এর অতি প্রিয় আপন চাচা হজরত আমির হামজা (রা.) ওয়াহশীর হাতে শাহাদত বরণ করেন এবং তাঁর লাশের প্রতি চরম অবমাননা করা হয়। হুজুর (সা.) এতে অত্যন্ত ব্যথিত ও শোকাহত হন। পরবর্তীকালে নানা কৌশলে ওয়াহশী ইসলাম গ্রহণ করে। রসূলুল্লাহ (সা.) তার সম্পর্কে বলে রেখেছিলেন, ওয়াহশী যেহেতু ইসলাম গ্রহণ করেছে, তার সম্পর্কে বলার কিছু নেই, কিন্তু সে যেন হুজুর (সা.)-এর সামনে না আসে। তাকে দেখলে হুজুর (সা.)-এর চাচা ওহোদের শহীদ হজরত আমির হামজা (রা.)-এর কথা মনে পড়ে এবং এতে তিনি খুবই মর্মাহত হন।
হিজরি দ্বাদশ মোতাবেক ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে নবুওয়াতের মিথ্যা দাবিদার বনি হানিফার কুখ্যাত মোসায়লামাতুল কাজ্জাব ‘হাদিকাতুল মওত’ (মৃত্যুর বাগান নামে খ্যাত) যুদ্ধে নিহত হয়। হত্যাকারীদের মধ্যে ওয়াহশীর নামও বর্ণিত হয়ে থাকে। ওয়াহশী গর্ববোধ করে বলত, সে ইসলামের সেরা ব্যক্তিত্বের (হজরত আমির হামজা রা.) যেমন হত্যাকারী, তেমনি কোফরের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি মোসায়লামাতুল কাজ্জাবকে হত্যা করে পাপের প্রায়াশ্চিত্য করেছে। কিন্তু ওয়াহশীর কপাল মন্দ, শেষ জীবনে সে কোনো কারণবশতঃ আত্মহত্যা করে জীবনের সর্বনাশ করেছে বলে ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে।
দ্বিতীয় আত্মহত্যাকারীর নাম ফিরুজ আবু লুলু। দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.)-এর উপর মারাত্মক হামলা করে ধরা পড়লে আত্মহত্যা করে এবং দুনিয়ার শাস্তি হতে সে রক্ষা পেয়ে গেলেও জাহান্নামবাসী হয়ে যায়।
ওয়াহশী ও আবু লুলু, এ দুই কমবখতের আত্মহত্যার ধরণ ও কারণ ভিন্ন ভিন্ন হলেও, মুসলিম নামধারী প্রত্যেক আত্মহত্যাকারীকে বিভিন্ন হাদীসের মাপকাঠিতে তুলনা করতে হবে। বিশেষত রসূলুল্লাহ (সা.)-এর মাদানী জীবনে আত্মহত্যার বিভিন্ন ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা ও বিচার বিশ্লেষণ করলে আত্মহত্যার কারণ ও প্রতিকারের সঠিক উপায় উদ্ভাবন করা সহজ। তাই পরবর্তী আলোচনায় আত্মহত্যা সংক্রান্ত কয়েকটি হাদীসের অর্থ উদ্ধৃত করার আশা রইল।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।