Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

যুক্তরাষ্ট্রের আগামী নির্বাচন বিশ্ব রাজনীতিতে কী পরিবর্তন আনবে

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট খুব কমই এসেছে। জর্জ ডব্লিও বুশ মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে ‘ওয়ার মঙ্গার’ বা ‘যুদ্ধবাজ’ হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছিলেন। তিনি খোঁড়া অজুহাতে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে হত্যা করে পুরো ইরাককে এক ধ্বংস স্তুপে পরিণত করেন। আফগানিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হামলা চালিয়ে দেশগুলোকে অশান্ত ও অস্থির করে তোলেন। তার এসব হামলার দুটি উদ্দেশ্য ছিল। এক. মুসলমানদের বিশ্বে জঙ্গী ও সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করা। দুই. মধ্যপ্রাচ্যের তেল লুট করা। এটা এখন স্বীকৃত, বুশের শাসন আমলে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র নিজেই ধ্বংস করে মুসলমানদের ওপর এর দায় চাপিয়েছিল। ওসামা বিন লাদেনকে দায়ী করে আফগানিস্তানসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্যে হামলা চালিয়ে এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করার জন্য ‘আরব বসন্ত’ নামে এক আন্দোলনের সূচনা করেছিল। এসবই এখন ইতিহাস। তবে তার রেশ এখনো রয়ে গেছে। জর্জ বুশের এই বিতর্কিত চরিত্রের চেয়েও ডোনাল্ড ট্রাম্প এগিয়ে। ইতোমধ্যে তিনি মুসলিমবিদ্বেষী এবং চরম বর্ণবাদী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। মূলত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন এই বর্ণবাদকে উস্কে দিয়ে এবং দেশটির চিরায়ত বহুজাতিক অভিবাসী নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে। এছাড়া তার একেক সময় একেক বক্তব্যও সমালোচিত হয়েছে এবং হচ্ছে। ২০১৬ সালে যখন তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তখন দেশটির নীতিনির্ধারকদের অনেকে তার মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার কথা বলেছিলেন। তাদের এমন কথার মধ্য দিয়ে এটাই প্রতীয়মাণ হয়েছিল, বিশ্বের শক্তিধর দেশটিতে একজন ‘পাগলা রাজা’ ক্ষমতাসীন হয়েছে। তাদের এই ধারণা একেবারে ভুল হয়নি। কারণ, তিনি বিভিন্ন ইস্যুতে এমন সব বক্তব্য দিয়েছেন এবং দিয়ে যাচ্ছেন যে, তাতে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্থিরতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তা নাহলে, যে চীনকে তিনি শত্রু মনে করেন, তিনি যাতে পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেন, সেই চীনেরই সহযোগিতা চেয়ে বসেছেন। এছাড়া, ভারত-চীনের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে যে যুদ্ধাবস্থা চলছে, তাতে মধ্যস্থতা করার নামে ফেইক কথাও বলেছেন। নরেন্দ্র মোদির সাথে এ নিয়ে মাস কয়েক আগে তার কথা হয়েছে বলে বললেও ভারত তা নাকচ করে দিয়েছে। সম্প্রতি আবারও তিনি মধ্যস্ততা করতে রাজী বলে বক্তব্য দিয়েছেন। ট্রাম্পের এমন অসংলগ্ন কথাবার্তার কারণে তিনি একজন বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছেন। আগামী ৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এবারও ট্রাম্প নির্বাচন করবেন। তার প্রতিদ্ব›দ্বী ডেমোক্রেট প্রার্থী জো বাইডেন।

দুই.
২০১৬ সালের নির্বাচনের মতোই বিভিন্ন জরিপে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এখন পর্যন্ত ডেমোক্রেট প্রার্থী এগিয়ে রয়েছেন। ট্রাম্প পিছিয়ে। তবে নির্বাচনী প্রচারণায় গত বারের নির্বাচনের চেয়েও এবারের নির্বাচনে দুই দলের প্রার্থীর মধ্যে কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি থেকে শুরু করে আক্রমণাত্মক বক্তব্য এবং ভয়াবহ তিক্ততা বিরাজ করছে। ট্রাম্প ও বাইডেন কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলছেন না। তাদের সাথে সমর্থকরাও যুক্ত হয়ে তিক্ততাকে সীমাছাড়া করে দিয়েছে। বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক ব্যবস্থাকে বিভাজনের মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছে। ট্রাম্প তার পুরণো সূত্র ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন। তার বর্ণবাদী নীতিই এখন তার প্রধান হাতিয়ার। বিভিন্ন বক্তব্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদীদের উস্কে দিচ্ছেন। এ নিয়ে ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন ও সহিংসতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। জো বাইডেনের সমর্থকদের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে ট্রাম্প বলেছেন, লুটেরা ও নৈরাজ্যবাদীদের যেভাবেই হোক আমেরিকার মাটি থেকে উচ্ছেদ করা হবে। ব্যক্তিগত আক্রমণ করতেও ছাড় দিচ্ছেন না। বাইডেনকে অথর্ব, অতি বৃদ্ধ ও স্বল্প বুদ্ধিসম্পন্ন হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। এছাড়া বলেছেন, লোকটি ভিতু, একজন ভালো মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ দিয়ে তাকে দেখানো দরকার। তাকে ‘¯েøা জো’ নামে ডাকছেন। জো বাইডেনও ছেড়ে কথা বলেননি। তিনি ট্রাম্পের শাসনকালকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক কালো অধ্যায় হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, মার্কিন জনগণের একতা এই কালো অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটাবে। ট্রাম্প নির্বাচনে জেতার জন্য হেন কোনো পন্থা নেই, যা অবলম্বন করছেন না। তার এসব পন্থার বেশিরভাগই নেতিবাচক। পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিতে নোংরা। এর মধ্যে একটি হলো, আফ্রিকান-আমেরিকান ভোটারদের নির্বাচন থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করা। সর্বোচ্চসংখ্যক ভোটার যাতে ভোট দিতে না পারে, এজন্য তিনি ই-মেইল ভোটের বিরোধিতা করা। বর্তমানে আমেরিকা জুড়ে যে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন চলছে, সেটিকে শ্বেতাঙ্গবিরোধী আন্দোলন ধরে শ্বেতাঙ্গদের মন বিষিয়ে তোলা। সাদা-কালোর মধ্যে ঘৃণা ছড়িয়ে দিয়ে শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের কাছে টানা। এছাড়া উগ্রজাতীয়তাবাদ ও অভিবাসনবিরোধী মনোভাবকে উস্কে দেয়া। অন্যদিকে জো বাইডেনের সমর্থকরা ট্রাম্পের এই নীতির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে অভিবাসী ও কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের আকর্ষণের চেষ্টা করছে। এছাড়া পোস্টাল ব্যালট বা বাড়িতে পাঠানো ব্যালট পূরণ করে চিঠির মাধ্যমে ভোট দেয়ার সুযোগের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে। দুই প্রার্থী এবং তাদের সমর্থকরা যখন প্রচার-প্রচারণা নিয়ে ব্যস্ত, তখন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ ও টেলিভিশন চ্যানলগুলো বরাবরের মতোই জরিপ চালিয়ে যাচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, গত বারের মতোই প্রাথমিক জরিপগুলোতে ডেমোক্রেট প্রার্থী এগিয়ে। গতবার যেমন হিলারি ক্লিন্টন এগিয়ে ছিলেন, এবার জো বাইডেন। সিএনএন-এর সর্বশেষ জরিপে, জো বাইডেন মোট ভোটারের ৫১ শতাংশ ভোট পাবেন, আর ডোনাল্ড ট্রাম্প ৪৩ শতাংশ পাবেন। ১০-১২ শতাংশ ভোটার এখনো মনস্থির করেনি কাকে ভোট দেবে। জরিপে সর্বাধিক ভোট পেয়ে বাইডেনের জেতার সম্ভাবনা ৭১ শতাংশ, অন্যদিকে ট্রাম্পের সম্ভাবনা ২৯ শতাংশ। গত তিন মাস ধরে এই জরিপের ধারাবাহিকতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাৎপর্যের বিষয় হচ্ছে, ২০১৬ সালের নির্বাচনী চিত্রও এরকমই ছিল। সে সময় কোনো কোনো নির্বাচনী মডেল অনুসারে হিলারি ক্লিন্টনের জয়ের সম্ভাবনা ছিল ৮৫ শতাংশ। তিনি ট্রাম্পের চেয়ে ৩০ লাখ ভোটও বেশি পেয়েছিলেন। তারপরও ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের জোরে ট্রাম্প জিতে যান। পেনসিলভানিয়া, উইসকনসিন এবং মিশিগান-এই তিন অঙ্গরাজ্যে মোট ৭৭ হাজার ভোট বেশি পেয়ে ট্রাম্প জেতেন। এবারের চিত্রও অনেকটা এরকম। মোট ভোটারের সংখ্যায় জিততে না পারলেও ট্রাম্পকে সেই ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের ওপর নির্ভর করতে হবে। তবে গতবার হিলারি ক্লিন্টন এই তিন অঙ্গরাজ্যে তার জয় অবধারিত ভেবে তেমন একটা প্রচারণা চালাননি। ফলে তিনি হেরে যান। এবার জো বাইডেন এ ভুল করতে চাইছেন না। তিনি জোর প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে তিনি ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়েও আছেন। ইলেকটোরাল ভোট হচ্ছে, সেই ভোট যা চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত করে। দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল নির্ভর করে ৫৩৮ জন ‘ইলেকটর’ বা নির্বাচকের ভোটের ওপর। প্রতিটি রাজ্যের জনসংখ্যার ভিত্তিতে এসব ইলেকটর বা নির্বাচকের সংখ্যা নির্ধারিত হয়। যেমন জনবহুল ক্যালিফোর্নিয়ায় রয়েছে ৫৫ জন ইলেকটর, আবার একেবারে জনসংখ্যা কম মন্টানার রয়েছে মাত্র ৩ জন ইলেকটর। জিততে হলে ৫৩৮ ভোটের মধ্যে প্রার্থীকে পেতে হবে ২৭০টি ভোট। একটি রাজ্যে সবচেয়ে বেশি ‘জনপ্রিয় ভোট’ যিনি পাবেন, সে রাজ্যের নির্ধারিত সব ইলেকটোরাল ভোট তিনি পাবেন। এ কারণে মোট ভোটের হিসাবে এগিয়ে থাকলেও কোনো প্রার্থী প্রয়োজনীয় ইলেকটোরাল ভোট না পেলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন না। মূলত ট্রাম্প এই ইলেকটোরাল ভোট পাওয়ার ওপরই জোর দিচ্ছেন। এছাড়া তিনি মনে করেন, দেশের ‘নিঃশব্দ সংখ্যাগরিষ্ঠ’ মানুষ তার পক্ষে রয়েছে। তার অনুগত সমর্থক বলতে বোঝায়, শ্বেতাঙ্গ, স্বল্পশিক্ষিত ও রক্ষণশীল ভোটার, যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষিপ্রধান অঞ্চলের বাসিন্দা। এ কারণে শ্বেতাঙ্গ ও রক্ষণশীল ভোটারদের প্রভাবিত করতে ট্রাম্প নিজেকে তাদের ‘আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষক’ হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করছেন। আর এ জন্য তিনি ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের বিরোধিতা করছেন।

তিন.
জরিপে এখন পর্যন্ত ডেমোক্রেট প্রার্থী জো বাইডেন এগিয়ে আছেন। তবে এই এগিয়ে থাকা যে এখন আর বিজয়ের ইঙ্গিত নয়, তা ২০১৬ সালে ট্রাম্প জিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন। জরিপ শুরু হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সম্ভবত তিনিই প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি জরিপকে ভুল প্রমাণ করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। যদিও তার জেতার পেছনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ ছিল বলে বহু বির্তক রয়েছে। পরবর্তীতে তার কিছু সত্যতার কথাও জানা যায়। এ সত্যতাকে ট্রাম্প নিজেই ভিত্তি দিয়েছেন চীনের কাছে তাকে জেতানোর ভূমিকা রাখার প্রস্তাব দিয়ে। যদি এটি ট্রাম্পের উল্টাপাল্টা কথা বলার মতো কথার কথা হয়ে থাকে, তবে বলার কিছু নেই। তবে ট্রাম্প যদি পুনরায় জিতে যান, তবে তা আর কথার কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ নাও থাকতে পারে। ট্রাম্পের জেতার নেপথ্যের অনেক কারণের মধ্যে এটিই অন্যতম হয়ে উঠবে। প্রশ্ন হচ্ছে, ট্রাম্প এবার জিতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রে ও বিশ্বে তার ভূমিকা কি হবে? আবার জো বাইডেন জিতলেই বা কি হবে? ট্রাম্প জিতলে কি হবে তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। কারণ, তিনি জেতার জন্য যত ধরনের নোংরা পথ অবলম্বন এবং কথা বলা দরকার, তার সবই নিচ্ছেন, বলছেন। ২০১৬ সালে তার নেয়া অভিবাসী বিরোধী এবং উগ্র জাতীয়তাবাদ বা বর্ণবাদী নীতি বিজয়ে ভূমিকা রেখেছে। সে সময় কে কে কে বা ক্লু ক্ল্যাক্স ক্ল্যান নামে উগ্র শ্বেতাঙ্গবাদী সংগঠন তার পক্ষ হয়ে মাঠে নেমেছিল। এবারও তারা ট্রাম্পের পক্ষ হয়ে মাঠে নেমেছে। ফলে ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ স্লোগানটি আরও দৃঢ়তা পাবে। এর বিপদ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের যে বহুজাতিক জনগোষ্ঠীর সম্মিলনে সমাজ গড়ে উঠেছে বা বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছে, তা পুরোপুরি নস্যাত হয়ে যাবে। অভিবাসী বিতাড়ন বেগবান হওয়া থেকে শুরু করে বর্ণবাদ ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে। যুগের পর যুগ ধরে বসবাস করে আসা অনেক অভিবাসী আমেরিকানকে নিজ দেশে ফিরতে হতে পারে। এমনিতেই ট্রাম্প এসে নতুন করে অভিবাসী হওয়ার ক্ষেত্রে কঠোরতা অবলম্বন করছেন। দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হলে দেখা যাবে, অভিবাসন নীতিকে আরও সংকুচিত করে দেবেন। অথচ যে ট্রাম্প অভিবাসন নীতি কঠিন করা এবং অনেক অভিবাসীকে বিতাড়নের মনোভাব পোষণ করছেন, তার পূর্ব পুরুষই যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হয়ে এসেছে। মূলত প্রকৃত আমেরিকান বা ভূমিপুত্র বলতে যা বোঝায়, তারা হচ্ছে রেড ইন্ডিয়ান। এরাই যুক্তরাষ্ট্র আবিষ্কার হওয়ার আগে এখানে বসবাস করত। এই রেড ইন্ডিয়ানরা বাদে দেশটির জনসংখ্যার এখন যে রেস বা জাতিগোষ্ঠী তার সবই অভিবাসী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তারা যুক্তরাষ্ট্রে এসে দেশটিকে সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত করেছে। অর্থাৎ ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে অভিবাসীর দেশ হিসেবে মানতে রাজী নন। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করে তিনি ‘ট্রু আমেরিকান’ স্লোগান দিচ্ছেন। তিনি বা তার পূর্ব পুরুষরাও যে ‘ট্রু আমেরিকান’ ছিলেন না, তা তিনি অস্বীকার করছেন। এতেই বিশ্লেষকরা শঙ্কা প্রকাশ করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের শত শত বছর ধরে চলে আসা অভিবাসীকেন্দ্রিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ট্রাম্প বিভাজন সৃষ্টি করছেন এবং তা ভেঙ্গে দিতে চাইছেন। এতে দেশটির সমাজ পুরোপুরি বিভক্তির দিকে ধাবিত হবে এবং এক সময় তা বিচ্ছিন্নতার দিকে ধাবিত হবে। অন্যদিকে জো বাইডেন নির্বাচিত হলে কি করবেন, তার সুনির্দিষ্ট কোনো স্লোগান বা নীতি প্রকাশিত হয়নি। ২৯ সেপ্টেম্বর যখন ট্রাম্পের সাথে তার প্রথম টেলিভিশন বিতর্ক অনুষ্ঠিত হবে, তাতে হয়তো বাইডেন কি করতে চান, তা জানা যাবে। তবে সবাই আশা করছে, ট্রাম্প যে পথ ধরে এগুচ্ছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রকে বর্ণবাদ এবং উগ্র জাতীয়তাবাদের কথা বলে একটি অস্থিতিশীল রাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন, সেদিকে বাইডেন পা বাড়াবেন না। ইতোমধ্যে তার বক্তব্যে এ আভাস পাওয়া গেছে। বর্ণবাদ এবং উগ্র জাতীয়তাবাদকে তিনি এড়িয়ে যাবেন। ট্রাম্পের এলোমেলো করে দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক সংস্কৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হবেন।

চার.
ট্রাম্প যদি জিততে না পারেন এবং বাইডেন জিতে যান, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো তার আভ্যন্তরীণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে ফিরে যেতে পারে। তবে বাইডেনের বিশ্ব রাজনীতি কি হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে যতটা মনোযোগী বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে ততটা মনোযোগ দিতে পারেনি। বিশেষ করে তার সকালে এক কথা এবং বিকেলে আরেক কথার কারণে, বিশ্ব রাজনীতিতে তার গুরুত্ব অনেকাংশে কমে গেছে। এখন বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি চীনের সাথে দ্ব›েদ্ব জড়িয়ে কোনো ফায়দা হাসিল করতে পারেননি। যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ক্ষেত্রে চীনের পণ্যেও ওপর অধিক শুল্ক বসিয়ে পুনরায় তা প্রত্যাহার করে নেয়ার মধ্য দিয়ে ট্রাম্প কার্যত নতিস্বীকার করে নিয়েছেন। চীন সাগরে যুদ্ধ জাহাজ দিয়ে মহড়া দিয়েও চীনের কোনো ধরনের সমীহ আদায় করতে পারেননি। বলা যায়, বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের খবরদারিকে ট্রাম্প অনেকটাই খর্ব করে দিয়েছেন। জো বাইডেন বিজয়ী হলে তিনি যে তা পুনরায় প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হবেন, তা অনেকটা নিশ্চিত করে বলা যায়। সে ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি যে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে চেষ্টা করবেন, তাও নিশ্চিত করে বলা যায়। তবে করোনাত্তর বিশ্বে তা প্রতিষ্ঠা করা তার পক্ষে অত্যন্ত দুরুহ কাজে পরিণত হবে। কারণ, ইতোমধ্যে চীন করোনার ক্রান্তিকালের পুরো সুযোগ নিয়ে বিশ্বে তার অবস্থান সুসংহত করে ফেলেছে। সমর শক্তিতেও বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেই ফেলেছেন, চীন কখন যে তলে তলে বিপুল সমরশক্তি অর্জন করেছে, তা যুক্তরাষ্ট্র খেয়াল করেনি। চীন যখন সমর শক্তি অর্জন করে তখন যুক্তরাষ্ট্র ঘুমিয়ে ছিল বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। ফলে আগামী নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষত-বিক্ষত হলেও বিশ্ব রাজনীতিতে অপাংক্তেয় হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। আবার জো বাইডেন জিতলেও বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে খুব একটা সুবিধা করতে পারবেন, এমন ধারনা করা কঠিনই বটে।
[email protected]



 

Show all comments
  • Jullur Rahaman ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ৩:০১ এএম says : 0
    যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দুইদিন আগেই অর্থাৎ ১ নভেম্বরের মধ্যে করে টিকা বিতরণের জন্য সব অঙ্গরাজ্যকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ এবার হবে করোনা রাজনীতি।
    Total Reply(0) Reply
  • ShAhiDuL IsLAm ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ৩:০৩ এএম says : 0
    ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের টেকনিক এপ্লাই করতেছে
    Total Reply(0) Reply
  • Shahidul Islam ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ৩:০৩ এএম says : 0
    যুগে যুগে রাজনৈতিক নেতারা তাদের রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করেছে,এখনো করছে।
    Total Reply(0) Reply
  • MD Sakib ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ৩:০৪ এএম says : 0
    আমেরিকার যে সরকারই আসুক না কেন প্রত্যেকটা সরকারি মুসলিমদের শত্রু
    Total Reply(0) Reply
  • মেহেদী ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ৩:০৫ এএম says : 0
    বিশ্ব রাজনীতিতে আমেরিকার গুরুত্ব কমে যাচ্চে। সেই পথেই হয়তো আগাবে।
    Total Reply(0) Reply
  • গাজী ওসমান ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ৩:০৫ এএম says : 0
    এবারও ট্রাম্প ক্ষমতায় আসলে আমেরিকার বাকি কতৃত্বও হারিয়ে যাবে।
    Total Reply(0) Reply
  • আমান উল্লাহ ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ৫:৪১ এএম says : 0
    টেম্পু জিতলে বিশ্ব পরিস্হিতিতো আরো ভয়াবহ ভাবে হাদীস নির্দেশিত নিষ্ঠুর অবস্হা সৃষ্টি হবে? কিয়ামতের আলামত তথা বিশ্ব চুড়ান্ত ভাবেই ধ্বংশ হতে যাচ্ছে। আল্লাহ রক্ষা কর।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ