Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কাশ্মিরের জনগণের মুক্তি আসবে কবে

মোহাম্মদ আবু নোমান | প্রকাশের সময় : ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মির দক্ষিণ এশিয়ার একটি বিতর্কিত ও আন্তর্জাতিক দিক থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এই অঞ্চলের অধিকার নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিবাদ দীর্ঘ বছরের। অঞ্চলটি কার্যত পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণাধীন। এই অঞ্চলের পশ্চিমে পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশ; উত্তর-পশ্চিমে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আফগানিস্তানের ওয়াখান করিডোর; উত্তরে চীনের জিনজিয়াং উয়েঘুর স্বশাসিত অঞ্চল এবং পূর্বে ভারত-অধিকৃত কাশ্মির। পাকিস্তান ১৯৯০ সাল থেকে প্রতিবছর ৫ ফেব্রুয়ারি কাশ্মিরিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন ও সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান জানাতে ‘কাশ্মির ঐক্য দিবস’ আর ভারতে দিনটি ‘প্রতিবাদ দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে।
১৯৪৭ সালে হিন্দু রাজা হরি শিংয়ের সাথে শেখ আব্দুল্লাহ কাশ্মিরকে ভারতভুক্তির পক্ষে সিদ্ধান্ত নেন। মুসলিম স্বার্থের সাথে এরূপ বিশ্বাসঘাতকতার বিনিময়ে শেখ আব্দুল্লাহ কাশ্মিরের প্রধানমন্ত্রী হন। কারারুদ্ধ করা হয় পাকিস্তানপন্থি নেতা চৌধুরি গোলাম আব্বাসকে। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক নিছক বিশ্বাসঘাতকই, তাদের গুরুত্ব বেশিকাল টিকে থাকে না। এমনকি যাদের কাছে নিজেদের বিক্রি করে তাদের কাছেও না। এই ভারতই শেখ আব্দুল্লাহকে ১৯৫৩ সালের ৯ আগস্ট কারারুদ্ধ করে। শেখ আব্দুল্লাহ যখন জেলে তখন ভারতের শাসনতন্ত্রে কাশ্মিরের যে আলাদা মর্যাদা ছিল সেটিও বিনষ্ট করা হয়। ১৯৬৭ সালে শুরু হয় নতুন উদ্যম ও পরিকল্পনায় স্বাধীনতা সংগ্রাম। নেতৃত্বে ছিল আল ফাতাহ নামে একটি সংগঠন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধের বছরে ভারত সরকার এ আন্দোলনকে ধ্বংস করে দেয়। কারণ তখন ভারতের পালে প্রচ- বাতাস। অবশেষে ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধি শেখ আব্দুল্লাহর সাথে চুক্তি করে। আবার তাকে কাশ্মিরের প্রধানমন্ত্রী করে। শেখ আব্দুল্লাহর মৃত্যুর পর একই চেতনার অনুসারি পুত্র ডা. ফারুক আব্দুল্লাহ প্রধানমন্ত্রী হন।
কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামীদের দমনে ভারত এখন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি রণকৌশলগত বন্ধু ইজরাইলের সহযোগিতা নিচ্ছে। ইজরাইলিরা কাশ্মিরে এসে হাতে কলমে শিক্ষা দিচ্ছে কিভাবে নির্যাতন চালিয়ে বিদ্রোহ দমন করতে হয়। এবং সংখ্যাগুরু মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নির্যাতন করে সংখ্যালঘুতে পরিণত করতে হয়। এ সংখ্যালঘু করাটা তাদের নিছক একটা কৌশল; যার আসল মানে হল, সেখানকার স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। জানা যায়, কারগিল যুদ্ধের সময় ভারতকে জয়ী করতে অস্ত্র এবং সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছিল ইজরাইল।
২০১১ সালের কাশ্মিরের উত্তরাঞ্চলের ৩টি এলাকায় ৩৮টি গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৮৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত কাশ্মিরে ২০ হাজার লোক গুম হয়েছে। ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী তাদের ধরে নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। এরপর তাদের আর কোন খোঁজও পাওয়া যায়নি। এছাড়াও উত্তর কাশ্মিরের বান্ডিপুরা, ব্যারামুল্লা ও কুপওয়ারা জেলার ৫৫টা গ্রামে ২ হাজার ৭শ’ অজ্ঞাত ও অশনাক্ত শহীদ কাশ্মিরিদের গণকবর আছে।
দুনিয়ার আর কোথাও মাথাপিছু হারে এত অধিক সংখ্যক দখলদার সৈন্য নেই যা রয়েছে কাশ্মিরে। অধিকৃত কাশ্মিরে ভারতীয় বাহিনীর সেনা সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। অর্থাৎ প্রতি একলাখ মানুষের জন্য কাশ্মিরে সৈন্য সংখ্যা হল প্রায় ৫ হাজারের উপরে। যে গ্রামে ২০০ ঘর মানুষের বাস সেখানে অবস্থান নিয়েছে প্রায় ২৫ জন ভারতীয় সৈন্য। অথচ ভারত বিশ্বজুড়ে বলে বেড়ায়, তারা উদারপন্থী, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক দেশ। এটাই তাদের গণতন্ত্রের নমুনা? সমগ্র ভারত শাসনেও এতজন ইংরেজ সৈন্য ছিল না যা এখন রয়েছে কাশ্মিরে। যেমনটি ইজরাইলী সেনাবাহিনী করেছে সমগ্র ফিলিস্তিনে। কাশ্মিরী জনগণ বহু আগেই প্রমাণ করেছে, তারা ভারতের নাগরিক হতে চায় না। এটি তাদের উপর জোর করে চাপানো হয়ে থাকে।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় কাশ্মির নিয়ে বিবাদে জড়ায় ভারত ও পাকিস্তান। উভয় দেশই প্রদেশটিকে নিজেদের অংশ বলে দাবি করে। উভয় দেশই কাশ্মিরের দুটি আলাদা অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু থেকেই ছিল। সেই দ্বন্দ্ব ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধে রূপ নেয়।
কাশ্মিরীদের বর্তমান গোলামী দশার জন্য শুধু ভারতই দায়ী নয়, দায়ী কাশ্মিরের কিছু নেতৃবৃন্দও। স্বাধীনতা মানে কোন ছেলের হাতে মোয়া বা সাধারণ রিলিফের মাল নয়। যা বহু ত্যাগ, তিতিক্ষা ও কষ্টে অর্জনের বিষয়। এজন্য অপরিহার্য, যোগ্য ও সৎ নেতৃত্ব এবং জনগণের জান-মালের কোরবানি। যুগে যুগে মুসলমানদের অপূরণীয় ক্ষতি শুধু অমুসলিম শত্রুরাই করেনি। মুসলমান নামধারি সেকুলার ও ইসলামের প্রতি প্রচ- বিদ্বেষী মুনাফিক নেতারা বড় বড় ক্ষতি করেছে। আজ মুসলিম বিশ্ব যেরূপ বিভক্ত, শক্তিহীন ও ইজ্জতহীন তার কারণ তো তারাই। সিন্ধু, বাংলা, পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের মুসলমানদের ন্যায় কাশ্মিরীদেরও স্বাধীন হওয়ার মোক্ষম সুযোগ থাকলেও তা সম্ভব হয়নি মুসলমান নামধারি ইসলাম বিদ্বেষী, হিন্দু ও ইহুদিদের পেইড এজেন্ট ও সেকুলার নেতাদের কারণে। এদেরই একজন হলেন শেখ আব্দুল্লাহ। কাশ্মিরের অমুসলিম ডোগরা রাজার বিরুদ্ধে তুমুল গণ আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১৯৩১ সালে এবং সেটি জম্মুতে রাজার সৈন্যদের দ্বারা পবিত্র কুরআনের অবমাননা হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। তখন আন্দোলনে মুসলিম কনফারেন্সের নেতা ছিলেন শেখ আব্দুল্লাহ। তিনি ছিলেন চিন্তা-চেতনায় সেকুলার এবং ইসলামে অঙ্গিকার শূন্য। তার ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব ছিল কংগ্রেস নেতা জওহার লাল নেহেরুর সাথে। নেহেরুর ন্যায় তিনিও মুসলিম লীগের দ্বি-জাতি তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না। বিশ্বাসী ছিলেন ভারতীয় একজাতি তত্ত্বে। ফলে মুসলিম লীগের সাথে সম্পর্ক না গড়ে তিনি সম্পর্ক গড়েন কংগ্রেসের সাথে। তার কাছে যেটি অধিক গুরুত্ব পায় সেটি কাশ্মিরের মুসলমানদের ঐক্য নয়, বরং সেটি কাশ্মিরের হিন্দু প-িতদের সাথে একাত্ম হওয়া। ফলে দুই টুকরায় বিভক্ত হয় কাশ্মিরী মুসলমানরা। ১৯৩৯ সালের ১১ জুনে শেখ আব্দুল্লাহ মুসলিম কনফারেন্সের নাম পাল্টিয়ে রাখেন ন্যাশনাল কনফারেন্স। এভাবে একতার গুরুত্ব যে সময়টিতে সর্বাধিক ছিল তখন অনৈক্যই তীব্রতর হয়। মুসলিম কনফারেন্স দ্বিখ-িত হয়ে যায়। ন্যাশনাল কনফারেন্সের বিপরীতে মুসলিম কনফারেন্সের নেতৃত্ব দেন চৌধুরী গোলাম আব্বাস এবং মির ওয়াইজ ইউসুফ শাহ।
১৯২৫ সালে হরি সিং নামক এক হিন্দু কাশ্মিরের সিংহাসনে বসেন। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময়েও মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মির সেই হিন্দু রাজার শাসনে ছিলো। সে সময় কাশ্মিরের প্রায় ৮০% মানুষ ছিল মুসলমান। দেশ বিভাগের সময় তিনিও কাশ্মিরের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু হঠাৎই ১৯৪৭ সালের ২০ অক্টোবর কিছু পার্বত্য দস্যুদের আক্রমণের শিকার হয় দুর্ভাগা কাশ্মিরের অধিবাসীরা। দস্যুদের হাত থেকে বাঁচতে ও ভারতীয় সেনাদের সাহায্য লাভের আশায় ভারতের সঙ্গে যোগ দেন হরি সিং। হরি সিং এর সেই ভারতের সাথে হাত মিলানোর অঘটন আজো কাশ্মিরিদের গলার কাঁটা হয়ে আছে।
জাতিসংঘ পাকিস্তান ও ভারতকে বহুবার তাদের দখলকৃত ভূমি খালি করে দিয়ে গণভোটের আয়োজন করতে বলেছে। কিন্তু ১৯৫২ সালে ভারত এ গণভোটকে নাকচ করে দেয়, কারণ তারা জানত যে গণভোটে জনগণের রায় ভারতের বিপক্ষেই যাবে। ভারত বলে, সেখানে বহু নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু কথা হল, সে নির্বাচনগুলো হয়েছে কে মন্ত্রী বা এমপি হবে সে প্রশ্নে। কাশ্মিরীদের কাছে এটি গুরুত্বপূর্ণ নয় যে ভোটে কে মন্ত্রী হবে বা এমপি হবে। তাদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ হল তারা কোন দেশের সাথে থাকবে।
কাশ্মিরে এ পর্যন্ত ঠিক কতজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, কত নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে, কি পরিমাণ বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে এবং কত সংখ্যক মানুষকে নিরাপত্তা বাহিনী ধরে নিয়ে ফেরত দেয় নাই তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না। পুরুষ আর মহিলাই নয়, রেহাই পাচ্ছেনা, শিশু, বৃদ্ধ কেউই।
পত্রিকার পাতায় যে প্রতিবেদনগুলা ছাপা হয় সেগুলা আসল ঘটনার খুবই সামান্য চিত্র। কারণ কাশ্মিরে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যে অপরাধ করে সে অপরাধ প্রকাশের আলামত ও উপায়ও বন্ধ করে দেয়। একইভাবে মানবাধিকার কর্মী বা সাংবাদিকদের ওপর সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশে তারা তাদের সুবিধামত বহু বিধিনিষেধ আরোপ করে রেখেছে। যেকারণে গুম, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণসহ অনেক খবর অজানাই থেকে যায়।
কাশ্মিরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের আজ প্রায় ৭০ বছর হতে চলছে। এখনও চলছে তাদের ওপর ভারতীয় শোষণ ও নির্মম নির্যাতন। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন কাশ্মির পুরোটাই মুক্ত হবে। একটি স্বচ্ছ প্রস্তাবনাই কাশ্মির সমস্যা সমাধান এবং এ অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি এনে দিতে পারে। আন্তর্জাতিক আইন মেনে এবং কাশ্মিরের জনগণের ইচ্ছার ভিত্তিতে কাশ্মির সমস্যার সমাধান সম্ভব। কাশ্মিরের জনগণের স্বাধীনতা ও অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে বিশ্বব্যাপী শান্তীকামী রাষ্ট্রগুলোর রয়েছে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন। আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলো চাচ্ছেন, তাদের প্রতিশ্রুতি মোতাবেক একটি গণভোট আয়োজনের মাধ্যমে সাধারণ নাগরিকদের অধিকার আদায় ও মত প্রকাশের পথ সুগম করা।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কাশ্মিরের জনগণের মুক্তি আসবে কবে
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ